অভিবাসী বিরোধী অভিযান ও কঠোর নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সহ বিভিন্ন স্টেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চরম দু:শ্চিন্তা ও বিপাকে পড়েছেন। অনেক শিক্ষার্থী কর্মস্থলে কাজে যেতে আতংকে রয়েছেন। বিশেষ করে এক স্টেটের ভার্সিটিতে পড়ে অন্য স্টেটে থেকে কাজ করছেন এবং নির্দিষ্ট ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন সে সকল শিক্ষার্থীরাই বিপাকে রয়েছেন। এতে এখানে থাকা শিক্ষার্থীরা অভিবাসনবিরোধী ধরপাকড়ের অভিযানের দু:শ্চিন্তার পাশাপাশি টিউশন ফি’র খরচ মেটাতে ও একইসাথে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বেশ কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে।
নিউইয়র্কে বসবাসরত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে সম্প্রতি কথা হয় বাংলা পত্রিকার এ প্রতিবেদকের সাথে। তারা নাম পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে জানান, তাদের অনেকেই স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে শর্তকে পাশ কাটিয়ে এখানকার ব্যায় নির্বাহের জন্য অতিরিক্ত সময় কাজ করছেন। সম্প্রতি অবৈধ অভিবাসী বিতাড়নে আইস এর অভিযান শুরুর পর থেকে তারা এখন সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারছেন না। তাছাড়া যারা অন্য স্টেটের ভার্সিটির শিক্ষার্থী হয়ে নিউইয়র্কে কাজ করছেন এবং বসবাস করছেন তারা এখন পুরোপুরি কাজ বন্ধ রেখেছেন ভয়ে। কারণ তারা অনলাইনে ক্লাস করার পাশাপাশি নিউইয়র্কে বিভিন্ন চেইন ফুড স্টোর, গ্রোসরীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। এতে ভার্সিটির টিউশন ফি ও আবাসনসহ যাবতীয় খরচের সংস্থান হতো এ আয় থেকে। এখন কাজে যেতে না পারায় আর্থিক সংকটে চরম হতাশায় রয়েছেন। গত কয়েকদিন আগে স্টুডেন্ট শর্ত ভঙ্গের দায়ে তিন শিক্ষার্থীকে ডিপোর্টেশনের খবরে তাদের আতংক আরো প্রকট হয়েছে। এতে তাদের পড়াশুনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ম্যানহাটনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থী বলেন, ২০২৩ সালে আমি স্টুডেন্ট ভিসায় নিউইয়র্কে আসি। এখানে প্রথমে একটি রেস্টুরেন্টে এবং পরে ডানকিনে কাজ শুরু করি। কারণ ভার্সিটির সেমিস্টার ফি ও বাসা ভাড়ার খরচ মেটাতে নির্দিষ্ট আওয়ারে কাজ করে চালানো সম্ভব হচ্ছিলোনা। তাই কিছুদিন পর ডানকিনে নির্দিষ্ট ওয়ার্ক আওয়ারে কাজের পাশাপাশি আরেকটি রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত সময় কাজ করতেছি। এখন আইসের অভিযান ও গ্রেপ্তার দেখে ভয়ে আছি। শুধু অবৈধ অভিবাসী না, স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত ভঙ্গের দায়ে শিক্ষার্থীরাও গ্রেপ্তার হতে পারেন এমনটা শুনছি। এরকম পরিস্থিতিতে এখানে থেকে পড়াশুনা চালানোও অসম্ভব।
ওহাইয়ো’র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জানান, তিনি ওহাইয়ো’র একটি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসেন। সেখানে নিয়মিত থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি কাজের তেমন সুযোগ পাচ্ছিলেন না। নিউইয়র্কে থাকা তার আত্মীয় স্বজনদের পরামর্শ নিয়ে তিনি অনলাইনে ক্লাসের আবেদন করেন। পরে নিউইয়র্কে চলে আসেন। এখান থেকে অনলাইনে ক্লাস করে দুই মাস পর পর একবার অফলাইনে ক্লাস করে আসছিলেন। নিউইয়র্কে একটি পিৎজা শপে ক্যাশ বেতনে কাজ করছেন। কিন্তু তিনি যে নিউইয়র্কে থাকছেন ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সে বিষয়টি অবগত নয় এবং এ রকম নিয়ম নেই। অভিবাসীসহ শর্ত ভঙ্গকারী স্টুডেন্টদের ধরপাকড়ের ঘটনায় আতংকিত তিনি এখন কাজ বন্ধ রেখেছেন। সেখানে গিয়েও থাকা সম্ভব না। কি করবেন এখন সেই দু:শ্চিন্তায় রয়েছেন।
নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বাংলাদেশি এক ছাত্র বলেন, আমি ফ্লোরিডার একটি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভিসা নিয়ে এসেছি ২০২৩ সালে। এসে সেই ভার্সিটি পরিবর্তন করে নিউইয়র্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। পরবর্তীতে আই-২০ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সমস্যায় পড়ি। এটা নিয়ে এখনো স্টুডেন্ট স্ট্যাটাস সংক্রান্ত জটিলতায় রয়েছি। পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে পারছিনা। এখন স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত ভঙ্গের কারণে শিক্ষার্থীরাও অভিবাসনবিরোধী অভিযানে ডিপোর্টেশনের শিকার হচ্ছে। এটা নিয়ে ভয়ে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এরকম কতদিন থাকতে পারবো জানিনা।
চেইন শপে কাজ করছেন এমন এক শিক্ষার্থী জানান, মার্চের আগে দেশে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু ফেরত আসার সময় শুনেছি অনেক শিক্ষার্থীকে জেএফকে এয়ারপোর্ট এ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ডিপোর্ট করে দিচ্ছে শুনছি। তাই আপাতত দেশে যাওয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি। সবকিছু নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
ম্যানহাটনের একটি গিফট শপে কাজ করতেন নিউজার্সীর একটি ভার্সিটির শিক্ষার্থী। তিনি জানান, আমি অনলাইনে ভার্সিটি ক্লাস করি। তাই কাজের জন্য নিউইয়র্কে আছি। কিন্তু এ মাসের প্রথম দিকে শপের মালিক আমাকে আপাতত কাজে না যাওয়ার জন্য বলেন। কারণ তিনিও ভয়ে আছেন যদি তার এখানে ওয়ার্কপারমিট ছাড়া কেউ কাজ করছেন, আইসের অভিযানে এমনটি ধরা পড়ে তখন ব্যবসাসহ তিনি বড় বিপদে পড়তে পারেন। তাই এখন কাজ বন্ধ রেখেছি। এভাবে দু’এক মাসের বেশি কাজ ছাড়া থাকতে পারবোনা। বাসা ভাড়াসহ সকল খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এতে পড়াশুনার ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ছে।
তাদের মতো অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বর্তমান ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট এজেন্ট এর অভিবাসনবিরোধী অভিযানে আতংক গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা স্টুডেন্ট ভিসায় এসে শর্ত ভঙ্গ করেছেন তাদের অবশ্যই এখন সচেতন থাকতে হবে। কারণ স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত ভঙ্গ করলে ইমিগ্রেশন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এখন যেকোন ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ব্যাপারে আগের থেকে তারা আরো কঠোর হয়েছে। তাছাড়া যারা নতুন এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায় তাদেরকে নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। এসে হুট করে ভার্সিটি পরিবর্তন করা এবং নির্দিষ্ট ওয়ার্কপারমিট ছাড়া কাজ করার বিষয়ে আরো সতর্ক হতে হবে।