শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৬ অপরাহ্ন
Uncategorized

টোকিওর হানামি উৎসব

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১

টোকিও থেকে ইমেল করেছে আমার বাংলাদেশী বন্ধু মেহবুব। কর্মসূত্রে ও এখন সপরিবারে টোকিওতে, থাকবে আগামী মার্চ পর্যন্ত। উত্তরে শুধু লিখলাম, যেভাবেই হোক, এপ্রিল পর্যন্ত থেকে ‘চেরি ব্লসম’ দেখে এসো। রিও দে জেনেরিও-র দুনিয়া মাতানো কার্নিভাল যদি মানুষের তৈরি হয়, জাপানের কার্নিভাল একেবারেই প্রকৃতির অবদান। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃজন করা এই উৎসব। ‘নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগলো’-র বাস্তব প্রতিরূপ বলতে পারেন।  প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপহাক এই চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল। জাপানে তেরি গাছের সংখ্যা বিশাল। স্থানীয়রা বলেন ‘সাকুরা’, কোথাও কোথাও বা আবার দেখা যায় চেরির বন।

আমার চেরি ফেস্টিভালের অভিজ্ঞতা ২০১৫। টোকিও পৌঁছেছিলাম ২৯ মার্চ। ঘটনাচক্রে দিনটা সেবছরের ‘হানামি’র দিন। জাপানি ভাষায় ‘হানা’ মানে ফুল, আর হানামি হল ফুল দেখবার উৎসব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই হানামি। চেরি গাছে থোকা থোকা ফুলের সমাহার, আর তার নিচে পিকনিকের আয়োজন। অনেক আগে অবশ্য রাজাদের বা রাজপরিবারের একচেটিয়া ছিল এই উৎসব। এখন অবশ্য তা গনউৎসবের চেহারা নিয়েছে। হাজার বছরের বেশি চলছে এ আনন্দযজ্ঞ। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছে উনো পার্ক চেরি ব্লসম ফেস্টিভালের অন্যতম প্রধান স্থান। বন্ধু ফুমিয়াসু উৎসাহে চলে এসেছিলাম হানামি-তে সামিল হতে। আর এসে যা দেখলাম তাতে আমি বাকরুদ্ধ। সুবিশাল উনো পার্ক। দূরে দেখা যাচ্ছে টোকিও টাওয়ার। পার্কের মধ্যে জলাশয়, ট্র্যাডিশনাল জাপানি মন্দির-কানেইজি টেম্পল, কিওমিজ়ু টেম্পল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মুগ্ধ করে প্রস্ফুটিত চেরি গাছের সারি। গোলাপি আর সাদা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। র আর মাঝে মাঝে আবার পলাশের রঙে রাঙানো লাল ফুলের উষ্ণ উপস্থিতি। এ যেন রঙের ক্যালাইডোস্কোপ। চোখ ফেরানো যায় না! আর এই উৎসব ক্ষণস্থায়ী বলে তার আকর্ষণ অনেক বেশি। মাত্র সপ্তাহখানেকেই চেরির আগুনে রাঙা হয়ে থাকে এই পৃথিবী। বসন্তের শুভ সূচনা এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে!


বসন্তে কত ফুল ফোটে তা দেখবার জন্যে কাতারে কাতারে লোক ভেঙে পড়ে পার্কের রাস্তায় রাস্তায়, ভিড় জমায় গাছের নীচে, ঘাসের উপরে। স্পেনের পাম্পলোনাতে যেমন বাৎসরিক ষাঁড়ের দৌড় দেখতে লোক জড়ো হয়, কিংবা পুজোর রাতগুলোতে কলকাতার প্যান্ডেলে যেমন বয়ে যায় জনগনের স্রোত, তেমনি জাপানে এই হানামিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবস্থা। দেশ বিদেশ থেকে মানুষেরা চলে আসেন শুধুমাত্র কাছ থেকে এই চেরি ফুলের মেলা দেখতে। জাপানিরাও সমান তালে সামিল হন হানামি-তে। জাপানের মানুষরা পরিবারকেন্দ্রিক। যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠান সপরিবারে উপভগ করতে পছন্দ করেন। হানামি-তে প্রস্ফুটিত চেরি গাছের নীচে পিকনিকের রীতি তাই আজও অমলিন। কোথাও হচ্ছে বার-বে-কিউ, কোথাও আবার বাড়ি থেকেই নিয়ে আসা হয়েছে পছন্দের খাবার। আড্ডা, হাসিঠাট্টা তো আছেই, এখন আবার যোগ হয়েছে চেরি গাছের প্রেক্ষিতে সেলফি তোলার ধুম। এই উৎসবের নবতম সংযোজন বলতে পারেন।


পার্কের ঠিক সামনেই টোকিও মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজ়িয়ম। মানুষের ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলাম মিউজ়িয়মে। উদ্দেশ্য প্রাচীন জাপানকে আর একটু কাছ থেকে জানা। কাঠ ও ধাতুতে তৈরি অসংখ্য বুদ্ধের স্ট্যাচু এখানে সাজানো। বিভিবিভিন্ন শাষকদের আমলে তৈরি এই মূর্তিগুলো আমাদের চেনা তথাগতের রূপ থেকে বেশ  আলাদা। বুদ্ধের অমিতাভ রূপ ভীষণ জনপ্রিয় পৃথিবীর এই প্রান্তে। রয়েছে অজস্র পুরনো পেন্টিং, জাপানের সমাজ জীবনের চালচিত্র। অনেক পেন্টিংয় আর বেশ কিছু কাঠের খোদাই করা কাজের মধ্যে আবার সেই হানামির ছবি-চেরি ফোটার রূপমাধুর্য। ছবিগুলো দেখলে জাপানের সভ্যতা, সমাজীবল কীভাবে বদলেছে তার আভাস পাওয়া যায়। শুদু বদলায়নি হানামির মাদকতা, তার আবেদন।


মিউজ়িয়ম থেকে বেরলাম। বুঝলাম ভালই খিদে পেয়েছে। সমুদ্রের  নাম না জানা মাছ আর চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি অদ্ভুত এক খাবার খেলাম। মন্দ লাগল না। আস্তে আস্তে সন্ধ্যের আলো-আধাঁরি ক্রমে গাঢ় অন্ধকার হয়ে উঠল। তাতে হানামির উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা, ভিড় কোনওটারই কমতি নেই। রাতের উৎসবের জন্য উনো পার্কে টানানো হয়েছে অজস্র কাগজের লন্ঠন। রাতের হানামিকে বলে ইয়োজোকুরা। ফুল্ল যামিনীর সেই অপার্থিব সৌন্দর্যে আমি বিস্ময়াভিভূত। প্রকৃতির এই অপার মহিমায় নিজেকে ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হল। মনে পড়ল নিজেদের কথা। আমাদেরও তো পলাশ আছে, শিমূল আছে। তাদের রূপ আমাদের আশ্চর্য করে, সাহিত্যে, কাব্যে তারা বার বার ফিরে আসে, কিন্তু আমাদের সমাজজীবনে এতটা সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলেনি। তাই আমাদের হানামিতে না আছে এমন গণনিমন্ত্রণ, না আছে তার এমন বিশ্বময় বিপণণ। ভাবতেই যেন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তবে হানামির আকর্ষণ এমনই যে উদাসীন হয়ে হসে থাকার সুযোগ নেই। পুরোটাই মনে হয় অলীক, অবাস্তব। দেশ-কালের সীমারেখা অতিক্রম করে প্রকৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সমস্ত মালিন্য, বিষন্নতা দূর হয়ে যায়। চোখে রঙের মায়া নিয়ে ফিরে আসি।

ও হ্যাঁ, মেহবুবের উত্তর পেয়েছি। টোকিোতে এ বছর হানামি ২-১১ এপ্রিল। মেহবুব তার ফেরার টিকিট তার পরেই কাটছে!

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে টোকিওর সরাসরি বিমান নেই। সিঙ্গাপুর বা হংকং হয়ে যেতে হয়।

কখন যাবেন

হানামির জন্য মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে যাওয়াই ভাল।

কোথায় থাকবেন

বাজেট থেকে লাক্সারি সব ধরনের হোটেলই আছে। ফ্যামিলি ইন সাইকো, ইন্টারকন্টিনেটাল টোকিও বে, সেলেস্টাইন হোটেল ভাল।

মনে রাখুন

জাপানের ভিসা হতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। সেইভাবে পরিকল্পনা করুন।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com