শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯ পূর্বাহ্ন

টিউলিপের স্বর্গরাজ্যে

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০২৩

ব্রাসেলসের আবহাওয়া লন্ডনের মতোই। এই রোদ, এই বৃষ্টি। সকালে রোদ দেখলে যেমন আনন্দে লাফিয়ে ওঠার কিছু নেই, তেমনি বৃষ্টি দেখেও গোমড়ামুখে বসে থাকার মানে হয় না। এমনকি মাঝে মাঝে আবহাওয়ার ফোরকাস্টও মেলে না।

লন্ডন থেকে আসা শান্তা-রুমু আর তারানা-ইমন দম্পতিকে এসব বলে আশ্বস্ত করতে চাইছিলাম। কথা হচ্ছিল, আমার ব্রাসেলসের ফ্ল্যাটে, নাশতার টেবিলে। ওরা মাত্র দু’দিনের সফরে এসেছে। ইতোমধ্যে একদিন মাটি। আজো সকাল থেকে ‘মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা।’ আমার আশাবাদী কথাতেও তাই মুখ থেকে মেঘ সরছিল না ওদের। ইউটিউবে শ্রীকান্ত আচার্য্যরে গানটা ভেসে আসায় কিছুটা কাজ হলো। একসঙ্গে কেটে যেতে দেখলাম মুখের আর আকাশের মেঘ।

আজকের প্ল্যান কিউকেনহফ। আমস্টারডামের অদূরে লিসে শহরে এই বিশাল ফুলবাগান। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিলে ব্রাসেলস থেকে সোজা শিফল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। সেখান থেকে ৩৬১ নম্বর বাস। আরো ৩০ মিনিট। ফুলের সিজনে স্পেশাল শাটলও থাকে এয়ারপোর্ট থেকে। বছরের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে শুধু সপ্তাহ আষ্টেক খোলা থাকে টিউলিপের স্বর্গরাজ্য- কিউকেনহফ। বাকি সময় চলে ফুলের চাষ, আনুষঙ্গিক কাজ আর মেলার প্রস্তুতি।

অনুজ শান্তা ৯ বছরের কন্যা ইফরিত আর নবজাতক আফরাদকে নিয়ে এসেছে পতিসহ। সঙ্গে অগ্রজপ্রতিম ইমন ভাইয়ের পরিবার। সেভেন সিটার গাড়িতেও একবিন্দু জায়গা অবশিষ্ট রইল না।

ডাচ শব্দ কিউকেনহফ অর্থ ‘হেঁশেল বাগিচা। এর মূল আকর্ষণ প্রাক গ্রীষ্মের এই পুষ্প প্রদর্শনী। আসলে টিউলিপের স্বর্গরাজ্য। ঊনআশি একর জায়গার ওপর এ বাগান। প্রতি বছর অন্তত সত্তর লাখ টিউলিপের মুকুল ফোটে এ সময়ে।

এ যাত্রা ইতিহাস কপচানো শিকেয় উঠল। আমরা পৌঁছে গেছি। বেলাও প্রায় দ্বিপ্রহর। মেঘ কেটে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। পার্কিংয়ের হ্যাপা পেরিয়ে তোরণের সামনে পৌঁছতে আরো মিনিট বিশেক লাগল।

ঝটপট টিকিট কেটে প্রবেশাধিকার পেলাম। স্বেচ্ছাসেবীরা হাতে বাগানের মানচিত্র ধরিয়ে দিল। মানচিত্র আর ব্রশিউরের কাজ তখন? যেদিকে তাকাই, ফুল আর ফুল। যেন পুষ্পরাজির সমুদ্রে এসে পড়লাম। হাজারো বরণ, হাজারো ধরন। শুধু টিউলিপই প্রায় দু’হাজার প্রজাতির। চলছে নিরন্তর গবেষণা। প্রতি বছর বাগানে যুক্ত হয় অন্তত শ’খানেক নতুন প্রজাতি।

প্রায় মিনিট ত্রিশেক ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক চলল, বলতে গেলে ঠায় দাঁড়িয়ে। কে যেন মনে করিয়ে দিলেন, বাগান ৩২ হেক্টরের। আর ফুল আছে ৭০ লাখ। এক জায়গায় এতক্ষণ দাঁড়ালে পুরো বাগান দেখতে সপ্তাহখানেক লাগবে।

ধীর পায়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকি। পথের দু’পাশে সারি বাঁধা টিউলিপ বাগান। কোনোটি টকটকে লাল, কোনোটি কমলা, আবার কোনো বাগান বেগুনি, ফিরোজা, মেরুন, হলুদ কিংবা সাদা টিউলিপের। পথের পাশে যেন নানা প্রিন্টের গালিচা বিছানো। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, বিশাল সমুদ্রে ছোট ছোট টিউলিপের ব্লকগুলো বর্ণিল ডিঙি নৌকা- যেখানে বাতি, মাস্তুল আর পাল- সবই অদ্বিতীয় বর্ণে সজ্জিত। বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে এক ভুবনমোহিনী বিন্যাস। এ যেন মুহূর্তে মন আকুল করে দেয়া সম্মোহনী সূত্র! নাকি এ কোনো ইন্দ্রজাল।

শুধু রূপ-রস-গন্ধের বুলি শুনিয়ে বাণিজ্যের দিকটাকে অবহেলা করা ঠিক হবে না। নেদারল্যান্ডসের যে কয়টা ফুল বা পুষ্পজাত পণ্যের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য- কিউকেনহফকে তার রাজধানী বলা যেতে পারে। শুধু দর্শনার্থী নয়, এখানে অগণিত বায়ার আসেন বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে, নানান ফরমায়েশ নিয়ে। শুধু ফুল রফতানি থেকেই নেদারল্যান্ডস আয় করে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। দর্শনার্থী আর আনুষঙ্গিক নানান আয় তো রয়েছেই।

ঘণ্টাধিককাল পুষ্পশোভা আস্বাদনের পর যখন রেস্তোরাঁ পার হচ্ছি, নাসান্দ্রিয় তখন অস্থির হয়ে উঠেছে। সবারই মনে পড়ল, লাঞ্চ টাইম শেষের পথে। খাবার পাওয়া গেলেই হয়।

খাবার ঘরে ভিড় কমে এসেছে। ততক্ষণে বেশ অবসন্ন আমরা। অনেকটা সময় নিয়েই স্যান্ডউইচ, আইসক্রিম আর কফি খেলাম। ফুডকোর্টের পাশেই বেশ কয়েকটি স্যুভেনির শপ আর প্যাভিলিয়ন। এসব প্যাভিলিয়ন থিম স্পেসিফিক। প্রথম যেটি দেখলাম ওয়েডিং ফ্লাওয়ার্স। হার্ট শেপে সাজানো পুষ্পরাজি। অনেক রঙের। তবে সাদা ও গোলাপিই বেশি। এ অংশের নাম রাখা হয়েছে উইলহেমিনা।

লেক ছাড়িয়ে বেষ্টনী ধরে এগিয়ে গেলে জুলিয়ানা প্যাভিলিয়ন। সেখানে প্রদর্শনী চলছে ‘টিউলিপের ইতিহাস’ শীর্ষক।

লেক পশ্চিম থেকে পূর্বে এগিয়েছে। মাঝ বরাবর এসে দু’পাশে দুটি বিশাল প্যাভিলিয়ন- অরেঞ্জ নাসাউ এবং উইলেম আলেকজান্ডার। এখানেও চলছে তাজা ফুলের প্রদর্শনী। দুটি প্যাভিলিয়নেরই সিলিং স্বচ্ছ কাচের। আলোর অভাব নেই। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ফুলের টব আর তাজা ফুল বিক্রিও হচ্ছে দেখলাম। উইলেম আলেকজান্ডারে হিবিসকাস প্রদর্শনী। জবা এবং সমগোত্রীয় ফুলের সমাহার এখানে। জবা ফুল যে এত ধরনের হয়, কল্পনায়ও আসেনি কখনো।

ফুল দেখা আর আস্বাদনে ক্লান্তি নেই বড়দের। তবে ছোটরা ততক্ষণে একটু মিইয়ে গেছে। দুটি দলে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা। একদল বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম মেইজ, প্লেগ্রাউন্ড, মিফি হাউস আর চিড়িয়াখানার দিকে। অন্য দল ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী দেখছে। কিউকেনহফ পার্কের যে জায়গায় জুলিয়ানা প্যাভিলিয়ন, তার ঠিক বিপরীত কোনায় ব্রিয়েট্রিস অর্কিড প্রদর্শনী। পাশেই পুরনো স্টাইলের কাঠের উইন্ডমিল। এটিও রাখা হয়েছে প্রদর্শনার্থে।

লেখক মোহাম্মদ এহতেশামুল হক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com