বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩০ অপরাহ্ন

জেদ্দার আল-বালাদ: ইতিহাসের শহরে একদিন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ, ২০২৫

আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেল ঝকমকে শহর সৌদি আরবের জেদ্দা। এ শহরে পুরোনো ইতিহাসের স্বাদ নিতে যেতে হবে আল-বালাদ। শত শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়নের ঢেউ এলেও এলাকাটি এখনো ধরে রেখেছে অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।

আধুনিক জেদ্দার কোলাহলপূর্ণ রাস্তা পেরিয়ে যখন পুরোনো শহর আল-বালাদে পৌঁছালাম, তখন যেন সময় থমকে গেল।

সরু গলি, প্রাচীন শৈলীর ভবন, আরবের ঐতিহ্যবাহী বাজার—সবকিছু এক অনন্য অনুভূতি এনে দিল।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বাবে মক্কা। এটি জেদ্দার ঐতিহাসিক প্রবেশপথ। শত শত বছর ধরে হাজিরা এই পথ দিয়ে মক্কার পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতেন। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়েছি।

পরবর্তী গন্তব্য ছিল নাসিফ হাউস। ১৯২০ সালে বাদশা আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর কাঠের জানালা ও মাটি-পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি স্থাপত্য সৌদি আরবের প্রাচীন জীবনযাত্রার গল্প বলে। জানা গেল, একসময় এই ভবন রাজপরিবারের সদস্যদের আবাসস্থল ছিল।

এরপর গিয়েছিলাম বেদুইন মার্কেটে। মনে হলো, যেন কয়েক দশক আগের সৌদি আরবে চলে এসেছি। পুরোনো আসবাব, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, হাতে তৈরি গয়না, এমনকি সৌদিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় এখানে। সন্ধ্যার পর এখানকার পরিবেশ জমে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা মেতে ওঠেন প্রাচীন খেলা, গান, গল্প ও আড্ডায়।

আল-বালাদের বেশ কিছু ভবন ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সৌদি সরকার ২০৪০ সাল পর্যন্ত এসব স্থাপনা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে দুটি ভবন—একটি প্রাচীন জেলেদের প্রতীক, অন্যটি সৌদি আরবের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

২০২১ সালে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ জেদ্দার ঐতিহাসিক জেলা পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প চালু করেন। এ প্রকল্পের লক্ষ্য জেদ্দার ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে পুনরায় বিকশিত করা, বসবাসের জন্য উন্নত করা এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দা শত শত বছর ধরে সমুদ্রপথে আসা হজযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছে এবং ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যপথের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য গ্রহণ করেছে। এটি ৯টি প্রবেশদ্বারসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহর। প্রতিটি প্রবেশদ্বারের নিজস্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। একসময় এটি প্রাচীরবেষ্টিত শহর ছিল। এর প্রাচীর ১৫১৭ সালে পর্তুগিজদের অবরোধ থেকে জেদ্দাকে রক্ষা করেছিল।

ঐতিহ্যবাহী জেদ্দার ইউনেসকো স্বীকৃতি লাভের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

এই শহর রেড সি অঞ্চলের মানবিক মূল্যবোধ, নির্মাণসামগ্রী ও স্থাপত্যকৌশলের আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাণিজ্য ও হজযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু এবং রেড সি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের একমাত্র টিকে থাকা নগর। এ ছাড়া হজের সঙ্গে প্রতীকী, অবৈষয়িক, স্থাপত্য ও নগর-পরিকল্পনার স্তরে এটি গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সম্প্রতি সৌদি ট্যুরিজম অথরিটির (এসটিএ) আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম জেদ্দার আল-বালাদ সফরে। দলে আমরা আমন্ত্রিত পাঁচ বাংলাদেশি ও তিনজন পাকিস্তানি সাংবাদিক। এসটিএর পক্ষ থেকে আমাদের সফরের ব্যবস্থাপনায় ছিল স্থানীয় ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘হামজা ক্যামেল ট্যুরস’। আমাদের গাইড ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও ইমাদ এম কাশমিরী। তাঁর তথ্যবহুল বর্ণনায় আল-বালাদের প্রতিটি স্থাপনার ইতিহাস, সৌদি অর্থনীতিতে এর অবদান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা গেল।

আল-বালাদের বড় একটি এলাকা ঘুরে মনে হলো, আধুনিক সৌদি আরবের পেছনে লুকিয়ে থাকা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে এক দিনের জন্য ছুঁয়ে দেখলাম। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে; কিন্তু আল-বালাদের এই পুরোনো স্থাপনাগুলো এখনো সৌদি আরবের অতীতের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। জেদ্দার আল-বালাদ শুধু একটি জায়গা নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি, একটি অনুভূতি—একবার ঘুরতে গেলে হৃদয়ে গেঁথে যায়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com