শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৯ অপরাহ্ন

জার্মানি কেন অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্বপ্নের দেশ

  • আপডেট সময় বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ইউরোপে অভিবাসীদের জীবনে করোনা অতিমারির প্রভাব বুঝতে হলে কেবলমাত্র প্রতিদিনকার টেলিভিশনের সংবাদ দেখলেই চলবেনা, চোখ রাখতে হবে সবশেষ পরিসংখ্যানগুলোর দিকেও।শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১৩ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উপকূলে পৌঁছেছেন। সংখ্যাটি গতবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেশি।হঠাৎ করে ইউরোপমুখী অভিবাস প্রত্যাশীদের ঢল এত বেড়ে গেলো কেন?

ইউরোপিয় সরকারগুলোর সাথে কাজ করে, এমন একটি গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মাইগ্রেশন পলিসি ডেভেলপমেন্ট।এই সংস্থাটির মতে, ‘বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট’ আর ‘ইউরোপের উন্নত স্বাস্থ্য সেবা’- এ দুইটি কারণেই মানুষ ইউরপোমুখী হচ্ছেন।নতুন অভিবাসন প্রত্যাশীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপিয় ইউনিয়ন তাদের আগের নীতিই মেনে চলছে।অর্থাৎ নিরপেক্ষ থেকে এই অভিবাসীদের যথাযথ এবং সুশৃঙ্খলভাবে ভাগ করে নেবে সদস্য দেশগুলো।

জার্মানিতে অভিবাসি বন্টনের প্রক্রিয়া বেশ স্বচ্ছতা এবং খোলামেলা ভাবেই করা হয়ে থাকে।ফেডারেল পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগের সদস্য, বিভিন্ন শহর কর্তৃপক্ষ, প্রোটেস্ট্যান্ট গীর্জাগুলো এবং দাতা সংস্থাগুলো শরণার্থীদের জন্য জার্মানির দরজা খুলে দিতে সবসময়ই ফেডারেল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে তারা এমন দাবিও তোলেন যে, প্রয়োজনে জার্মানিকে সবকিছু একাই করতে হবে।কারণ তারা বিশ্বাস করেন, ‘এখনো অনেক কিছু করার আছে’।

যদিও অভিবাসীদের প্রতি কর্তব্য পালন এবং তাদের সুরক্ষায় জার্মানির দৃষ্টিভঙ্গি এখনো রাজনৈতিকভাবে অবমূল্যায়িত। আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার দাবিটা তাই বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল থেকে তোলা হচ্ছে অবিরতভাবে।

আইনী বাধ্যবাধকতায় কিংবা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অথবা মানবিক কারণেও যদি বিচার করা হয়, সন্দেহাতীত ভাবে ইউরোপিয় ইউনিয়নকে এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে, ‘গভীর সমূদ্র থেকে যাদের উদ্ধার করা হচ্ছে, তাদের বিষয়ে করণীয় কি?’ ক্ষীণভাবে হলেও একটি আলোচনা আছে যে, ইউরোপের দেশগুলোতে যে ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়, সেটিও অভিবাসন প্রত্যার্শীদের আকর্ষণ করছে।বিপরীতে একটি পক্ষ আছে, যারা এই আলোচনাটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা কিংবা অস্বীকার করেন।আশ্রয় প্রার্থীদের সবাইকে উদার অভ্যর্থনা দেয়ার দাবিই করেন তারা।

অভিবাসীদের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছুক এই পক্ষটি মনে করে যে, নৈতিকভাবে তারা সঠিক পথেই আছেন।আর একারণেই তারা অভিবাসীদের জন্য খুবই দরকারি কিছু বিষয়কে উপেক্ষা করে যান।যেমন বাচ্চাদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং স্কুলগুলোর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা কিন্তু আছেই। আবার বিশাল সংখ্যক অভিবাসীদের প্রয়োজনীয় আবাস স্থলের ব্যবস্থা কিন্তু চাইলেই হয়ে যায় না। এরজন্য সময় লাগে, অর্থ লাগে।এরপর রয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি। কারণ কর্মসংস্থান হলে অভিবাসীরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উপর থেকেও কিন্তু অর্থৈনিতক চাপ কমে যায় অনেকাংশে। কিন্তু চাইলেই রাতারাতি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা যায় না।একারণেই অভিবাসন প্রত্যশীদের সাহায্য করার ব্যাপারে যাদের কোনো দ্বিমত নেই, তাদেরও কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়।

জার্মান ফেডারেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোর্স্টসে হোফারের মতে, অভিবাসনকে কিভাবে সীমাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা বিবেচনার ক্ষেত্রে পুল ফ্যাক্টরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।যদিও জনসাধারণের কাছে এই বিষয়গুলোকে তিনি খুব একটা প্রকাশ করেন না।২০২০ সালের সাত জুলাই ইইউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের নথি থেকে জানা যায় যে, ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা অভিবাসন প্রত্যাশীদের গ্রহণের বিষয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রস্তুতিতে ব্যাপক ঘাটতি আছে। ‘ভি-ফোর’ কিংবা ‘ভিসগ্রাড-ফোর’ হিসেবে পরিচিত পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া এমনকি ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া এবং এস্তোনিয়াও ‘শরণার্থী বন্টন’ বিষয়ে খুবএকটা আগ্রহী নয়।ওই নথি অনুযায়ী, এই দেশগুলোকে পুল ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাতটি দেশেই কেন অভিবাসন- বিতর্কে পুল ফ্যাক্টরকে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যেখানে জার্মানিতে এ নিয়ে খুব একটা আলোচনাই নেই? সংখ্যার দিকে তাকালেই এর উত্তর মিলবে।জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার পরিসংখ্যা নঅনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শরণার্থী এবং অর্থনৈতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকা অত্যন্ত চমকপ্রদ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের থেকেও এগিয়ে। সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের শরণার্থী ছাড়াও পশ্চিম বলকান ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসা আশ্রয় প্রার্থীরাও জার্মানিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।২০১৫/১৬ সালের শরণার্থী সঙ্কটের সময় শক্ত অবস্থান নিয়েছিলো জার্মানি। এটি সম্ভব হয়েছিলো ইউরোপিয় ইউনিয়নে দেশটির বিশেষ আধিপত্যের কারণে। রাজনৈতিক ভাবে নেয়া সিদ্ধান্তে জার্মানির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কয়েক লাখ শরণার্থী। সমূদ্রে উদ্ধার কাজে জার্মানি যেমন ছিলো তৎপর, তেমনি সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলো দেশটি।

অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুল ফ্যাক্টরের বিশেষ ভূমিকা আছে।কারণ রাজনৈতিক নীপিড়ন ও গৃহযদ্ধ, দারিদ্র এবং বেকারত্বের মতো পুশ ফ্যাক্টরগুলোর চাইতে পুল ফ্যাক্টরগুলোর উপর রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি। যদিও দাতাসংস্থা গুলো পুল ফ্যাক্টর ধারণাটিরসাথেই একমত না।কিন্তু বাস্তবতাকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। অভিবাসন প্রত্যাশীরা আসছেন, হয়তো আসতেই থাকবেন।

জার্মানিই কেন?

শরণার্থী এবং অভিবাসী মিলিয়ে জার্মানিতে এখন প্রায় ৯০ লাখ বিদেশির বাস।অভিবাসীদের পছন্দের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পরই রয়েছে জার্মানি।উন্নত জীবনের আশায় প্রতিবছর হাজারো অভিবাসন প্রত্যাশী ঢুকছেন জার্মানিতে। ভিন্নদেশ, ধর্ম বিশ্বাস, শিক্ষা আর নানা পেশার মানুষ মিলিয়ে জার্মানিতে দারুণ একটি মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে তুলছেন।ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং কল্যাণ ব্যবস্থার জন্য জার্মানির সুনাম রয়েছে গোটা বিশ্বে। কল্যাণ ব্যবস্থার মূলনীতিটি জার্মান আইনের অন্তর্ভূক্ত।দেশটি প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা এবং মৌলিক চাহিদা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।কোনো ব্যক্তি যদি নিজের দায়িত্ব নিতে না পারেন, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রই তার দায়িত্ব নেয়। আরো ভালো করে বললে, একজন ব্যক্তি হয়তো নিজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। কিন্তু তাতে তার পূর্ণ মর্যাদা নিশ্চিত হচ্ছেনা।সে ক্ষেত্রে তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র নিজেই।তার পেশাগত উচ্চতর প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের আর্থিক সহায়তাই সরবরাহ করে রাষ্ট্র।

দেশটিতে কেউ যদি বেকার হয়ে পড়েন তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেকার ভাতা পেতে শুরু করবেন। যারা নিঃসন্তান, তারা পাবেন সবশেষ মূল বেতনের ৬০শতাংশ। আর সন্তানের বাবা-মা হলে পাবেন ৬৭ শতাংশ। এটি কেবলমাত্র জার্মান নাগরিকদের জন্য নয়, বরং দেশটিতে বাস করা সব অভিবাসী এবং শরণার্থী এই সুবিধা পেতে পারেন খুবই সহজে।

ভবিষ্যতের সঞ্চয় নিয়েও কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।কারণ পূর্ণবয়স্ক একজন ব্যক্তি যেদিন থেকে কাজ শুরু করেন, সেদিন থেকেই তিনি পেনশন বা ভবিষ্যত সঞ্চয় প্রকল্পের আওতায় চলে আসেন।অবসর নেয়ার পর প্রতিমাসে পেনশন বাবদ যে অর্থ আসে, তাতে বেশ ভালোভাবেই একজনের জীবন কেটে যায়। এরপর রয়েছে সন্তান-সুবিধা। অর্থাৎ প্রত্যেক করদাতা বাবা-মা সন্তানের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সহায়তা পান। এই সুবিধাটি সন্তানের ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে, যদি তাদের শিক্ষাজীবন তখনও চলমান থাকে। প্রথম দুই সন্তানের জন্য বাবা-মা মাসে ১৯০ ইউরো করে পাবেন। তৃতীয় সন্তানের জন্য পাবেন ১৯৬ ইউরো। কারো যদি তিন সন্তানের বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে চতুর্থ থেকে শুরু করে প্রত্যেক সন্তানের জন্য বাবা-মা পাবেন মাসে ২২১ ইউরো করে।এই সুবিধাটি ও নাগরিকদের পাশাপাশি অভিবাসীরাও পেয়ে থাকেন।

তরুণ জার্মানদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের তরুণদের কাছেও উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি ভীষণ পছন্দের।শিক্ষার মান যেমন অনেক উন্নত, তেমনি এখানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সব শিক্ষাই অবৈতনিক।অবশ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর কথা আলাদা।

সবশেষে রয়েছে মোটা বেতনের ভালো চাকরি।নির্মল পরিবেশের পাশাপাশি অপরাধের হারও এখানে অনেক কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিবাসীরা তাই এখানে নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ্য বোধ করন।নানা কারণেই মানুষ জার্মানিতে পাড়ি জমাতে চান।তবে সব থেকে বড় আর গুরুত্বপূর্ণ কারণ দুইটি সম্ভবত দেশটির শক্তিশালী অর্থনীতি আর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

বিপ্লব শাহরিয়ার :জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com