আর আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার এতকিছু জানার দরকার নেই, এজেন্সির সাহায্য নিয়ে সব কাজ করে ফেলবেন,তাহলে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা আপনার জন্য নয়। কেননা এজেন্সির গৎবাঁধা উত্তর অনুসরণ করলে আপনার অ্যাপ্লিকেশন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯%।
আবেদনের প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানার পূর্বে জেনে নিন, জার্মানির গ্রেডিং সিস্টেম সম্পর্কে।
ধরা যাক, আপনি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলেন সিজিপিএ ৩.৫১ নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর আপনার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমেইল আসলো আপনার জার্মান সিজিপিএ ১.৭৩। ঘাবড়ে যাবেন না। জার্মান গ্রেডিং সিস্টেমে যার গ্রেড যত কম, সে তত বেশি ভালো ফলাফলের অধিকারী।
জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত তাদের আবেদনের জন্য জার্মান গ্রেডিং সিস্টেম অনুযায়ী ২.৫ সিজিপিএ চায়। আপনার সিজিপিএ ২.৫ এর নিচে হলেই আপনি আবেদন করতে পারবেন। এখন জানবেন কীভাবে, জার্মান স্কেলে আপনার সিজিপিএ কত?
জার্মান সিজিপিএ= (সর্বোচ্চ গ্রেড – প্রাপ্ত সিজিপিএ)/ (সর্বোচ্চ গ্রেড – পাশ গ্রেড) * (৩+১)।
বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে,
সর্বোচ্চ গ্রেড = ৪
পাশ গ্রেড = ২
অর্থাৎ আপনার সিজিপিএ ৩.৫ হলে,
আপনার জার্মান সিজিপিএ= (৪-৩.৫)/ (৪-২)*(৩+১) = ১.৭৩
এই স্কেলে আপনার সিজিপিএ হিসেব করে দেখুন। তারপর নিজেই দেখুন, কোথায় কোথায় আবেদন করতে পারছেন।
প্রথমেই জার্মান একাডেমিক ওয়েবসাইটে গিয়ে বামপাশের ঘর গুলোতে নিজের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শব্দ ইংরেজিতে বসিয়ে দিলে পছন্দের সাবজেক্ট গুলো ডানপাশের ঘরে চলে আসবে ৷ যে বিষয়টি পছন্দ হবে, সেখানে ক্লিক করলে বিস্তারিত সবকিছু চলে আসবে। এখানে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাহিদা সম্পর্কে জানা যাবে। এছাড়া আরো তথ্য লাগলে কোর্স কোঅর্ডিনেটরকে ইমেইল করে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
জার্মানিতে সাধারনত দুই ভাষাতে পাঠদান করা হয়ে থাকে, জার্মান ও ইংরেজি ভাষা। যদি কেউ জার্মান ভাষায় মাস্টার্স করতে চান, সেক্ষেত্রে বেসিক১ পর্যন্ত ভাষা কোর্স সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। এই কোর্সটি ধানমণ্ডির গোয়েথে ইন্সটিটিউট থেকে করা যায়। তবে কেউ ইংরেজিতে মাস্টার্স করতে চান, সেক্ষেত্রে একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেক রকম সনদপত্র চেয়ে থাকে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় যদি দেখে শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন, তখন অনেক সময় আইএলটিএস চায় না। আবার কোন বিশ্ববিদ্যালয় আইএলটিএস বা টোফেলে ভালো স্কোরের সাথে সাথে জিআরইর স্কোরও চায়। এক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা যাচাই বাছাই করে নিতে হবে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে বিষয়ে মাস্টার্স করার জন্য আবেদন করছেন, তা যেন আপনার ব্যাচেলরে অধীত বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এজন্য আবেদন করার পূর্বে কোর্স কোঅর্ডিনেটরকে ইমেইল করে আপনার স্নাতক পর্যায়ে অধীত বিষয় নিয়ে একটু ধারণা দিতে পারেন। যেমন, আপনি ব্যাচেলরে কী কী বিষয় পড়েছেন। সাথে আপনার অর্জিত সিজিপিএ উল্লেখ করবেন।
এছাড়া আরো জানতে চাইবেন, উক্ত বিভাগে আপনি মাস্টার্স করার জন্য উপযুক্ত কিনা। হয়তো দুই এক কর্মদিবসের মধ্যেই আপনার ইমেইলের যথাযথ রিপ্লাই চলে আসবে।
সবকিছু সংগ্রহ করার পর কাগজগুলো নিচের সিরিয়াল অনুযায়ী সাজাতে হবে।
কাগজগুলো স্ট্যাপল বা জেন্টসক্লিপে আটকে একটি এফোর (A4) সাইজের মোটা এনভেলপে ইউনিএসিস্টের নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন। তবে সরকারী পোস্ট ব্যবহার না করে ডিএইচএল বা ফেডএক্সে কুরিয়ার করলে আবেদনপত্র কখন পৌঁছালো, তা ট্র্যাক করে জেনে নিতে পারবেন। আপনার চিঠিপত্র ও টাকা ইউনিএসিস্টে পৌঁছানো মাত্রই তারা আপনাকে কনফার্মেশন মেইল পাঠিয়ে জানিয়ে দেবেন।
এছাড়া তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ইউনিএসিস্ট আপনাকে দুইটি মেইলের মাধ্যমে আবেদনের ব্যাপারে আপডেট জানাবে। প্রথম ইমেইলটিতে আপনার ব্যাচেলর ডিগ্রির ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট অর্থাৎ জার্মান গ্রেডে আপনার রেজাল্ট কেমন, সে সম্পর্কে জানানো হবে। দ্বিতীয় ইমেইলটিতে আপনার কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়টি জানানো হবে। এরপর সব ঠিক থাকলে দুই একমাসের মধ্যেই আপনি এডমিশন লেটারটি হাতে পেয়ে যাবেন।
জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন লেটার হাতে পেয়েই ভেবে বসবেন না, আপনি জার্মানি চলে যাচ্ছেন। এখনো আপনার আসল কাজ বাকি রয়ে গেছে। কারণ আপনি যতই অ্যাডমিশন লেটার পান না কেন, জার্মান এমব্যাসি আপনাকে ভিসা না দিলে আপনি কখনোই যেতে পারবেন না। তাহলে চলুন আজ জেনে নেয়া যাক, জার্মান ভিসাপ্রাপ্তির নিয়মকানুন ও পদ্ধতি সম্পর্কে।
প্রথম কাজ হচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত জার্মান এমব্যাসির ওয়েবসাইট ভিজিট করা। সেখানে স্টুডেন্ট ভিসার আবেদনের জন্য চেকলিস্ট দেয়া থাকে। মনে রাখবেন, ভিসার জন্য প্রথমে জার্মান ব্যাংকে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট করে সেখানে ১১,২০৮ ইউরো জমা দিতে হবে৷
ব্লকড অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবেদন করার আগে অবশ্যই সর্বশেষ নির্দেশনা জানার জন্য জার্মান এমব্যাসির ওয়েবসাইট চেক করে নেবেন।
অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য একটি এপ্লিকেশন ফর্ম পূরণ করতে হবে। সর্বশেষ আপডেটেড ফর্ম ডাউনলোড করুন এখান থেকে। ডয়েচে ব্যাংক কিছুদিন পরপরই এই ফর্মটিতে পরিবর্তন আনে। তাই আপনি অবশ্যই ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সবচেয়ে লেটেস্ট আপডেটেড ফাইলটি ডাউনলোড করে নেবেন।
এই ফাইলের প্রথম ৮ পেজে দেয়া সকল নির্দেশনা বা স্যাম্পল খুব ভালো মতো পড়ে নিবেন। এবং এরপর ৯ নম্বর পেজ থেকে ফর্মটি পূরণ করা শুরু করবেন। ফর্মে পেজ রয়েছে ৭ টি (পেজ ৯-১৫)। এই সাতটি পেজই ভালোমতো ফিলআপ করার পর প্রিন্ট করে এমব্যাসিতে জমা দিতে হবে।
ফর্মটি পূর্ণ করার সময় যে বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখবেন,
ব্যাংকের আবেদন পত্র পূরণ করার পর আপনাকে জার্মান এম্বেসি ঢাকার নির্দিষ্ট করা কোনো ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে ইন্সুরেন্স করিয়ে নিতে হবে৷ কোম্পানিভেদে তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে৷ এই লিংকে গেলে ইন্সুরেন্স কোম্পানির তালিকা পাবেন।
এবার চেকলিস্ট অনুযায়ী কাগজপত্র গুলো প্রস্তুত করে ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনের মাধ্যমে এপয়েন্টমেন্ট এর ডেট নিয়ে নিন৷ এপয়েন্টমেন্ট নেবার জন্য এই এড্রেসে ক্লিক করুন। এই লিংকে গেলে চেকলিস্ট দেখতে পাবেন।
মূল কাগজপত্র একসেট সাথে নিয়ে ভিসার জন্য দুইসেট আবেদনপত্র পূরণ করে স্বাক্ষর করতে হবে৷ এছাড়া চেকলিস্ট অনুযায়ী সকল কাগজপত্র দুইসেট ফটোকপি করে সাজাতে হবে৷ সাথে নিতে হবে ছাব্বিশ হাজার মতো টাকা৷ যার মধ্যে ৬০ ইউরো (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা) ভিসা আবেদনের জন্য এবং নগদ বিশ হাজার টাকা আপনার সার্টিফিকেটগুলো ভেরিফিকেশনের জন্য৷
ভিসা ইন্টারভিউর দশ থেকে পনেরো মিনিট আপনার জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন সময়। প্রশ্নকর্তার সব প্রশ্নের উত্তর মার্জিত ভাবে দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে, জার্মানিতে পড়াশোনা করাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য। মনে রাখবেন, তিনি ইচ্ছা করলে তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে আপনার ভিসা বাতিল করে দিতে পারেন৷
প্রশ্ন কর্তার সাথে প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে যদি সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকে এবং তিনিও আপনার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হন, তখন তিনি আপনার মূল কাগজপত্র ফিরিয়ে দিয়ে মূল পাসপোর্ট ও ফটোকপি করা কাগজগুলো রেখে দেবেন। এরপর আপনার অপেক্ষার পালা। সবকিছু ঠিক থাকলে সর্বোচ্চ চল্লিশ দিনের মধ্যে আপনি জার্মানির ভিসা হাতে পেয়ে যাবেন৷