দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি বিনিয়োগের প্রধান গেটওয়ে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মিত্র মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান এবং এ অঞ্চলে চীনের ক্রমশ আগ্রাসী বিনিয়োগ টোকিওকে দক্ষিণ এশিয়ামুখী হতে বাধ্য করেছে। আর এর পুরো সুফলই পেতে যাচ্ছে ঢাকা।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও বঙ্গোপসাগরীয় সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে জাপানের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত কূটনীতিতে ভূমিকা রাখছে। এর সুবিধাও এসে ধরা দিচ্ছে। সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের নীতিই ঢাকাকে এ সুবিধা এনে দিয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনকে দিন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে হাতছানি দেয়া সুবিধা পেতে আমাদের কূটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে।
‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন হতে হবে, যেখানে যার সঙ্গে কাজ করলে আমাদের সুবিধা হবে, যাদের বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আমরা তাদের সঙ্গেই কাজ করব।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও আর্থিক সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে জাপান। এ অঞ্চলে প্রচুর উন্নয়ন সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে টোকিও। এর মধ্যে বাংলাদেশেই জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশও জাপানকে দেখছে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে।
বিগত দশকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে মিয়ানমার পরিচিতি পায় এশিয়ার ‘ফ্রন্টিয়ার মার্কেট’ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল জাপান। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক সরকারের পতন এবং সেনা অভ্যুত্থানে নাখোশ জাপানি বিনিয়োগকারীরা চাইছে মিয়ানমার থেকে বিদায় নিতে। তাদের কাছে এ অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় গন্তব্য।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশ চীনা প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়ায় সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
যদিও সামরিক জোটের বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ঢাকা। তার পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে হিসেবে দেশটির বিনিয়োগকারীদের কাছে দিনে দিনে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপান খুব পরিচ্ছন্ন ব্যবসা করে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বর, কারো সঙ্গে বৈরিতার নয়। সে ক্ষেত্রে এখানে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির কোনো প্রভাব থাকবে বলে আমি মনে করি না।’
সবচেয়ে বেশি জাপানি ওডিএ বাংলাদেশে
আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা (ওডিএ) কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে আসছে জাপান। বর্তমানে জাপানি ওডিএর সবচেয়ে বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে জাপানের মোট সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশটির কাছ থেকে আরও ২৬৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
গত বছরের আগস্টে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হয়। এখন পর্যন্ত ওডিএ কর্মসূচির আওতায় এটিই জাপান-বাংলাদেশের বৃহত্তম ঋণ চুক্তি, যার পরিমাণ প্রায় ৩২০ কোটি ডলার। জাইকার মাধ্যমে সাতটি সরকারি প্রকল্পে এ অর্থ ঋণ দিচ্ছে জাপান।
অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর তুলনায় বেশ শিথিল শর্তেই বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে থাকে জাপান। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সাম্প্রতিক স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তিগুলোয় সুদহার ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর। এর সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়েছে আরও ১০ বছর।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর
২০২২ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। একই বছরে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উদ্বোধন হওয়ার প্রত্যাশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। তবে শেষ পর্যন্ত বন্দরটির নির্মাণকাজ শেষের অনুমিত সময় ধরা হয়েছে ২০২৬ সাল।
জাপানি অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় নির্মাণাধীন সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থায়ন করছে জাইকা। বন্দরটি নির্মাণ হচ্ছে জাপানের কাশিমা ও নিগাতা বন্দরের আদলে।
শুরুতে শুধু মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা করা হলেও পরে তা সংশোধন করে এটিকে পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। দেশের প্রথম এ গভীর সমুদ্রবন্দরকে জাপানিরা দেখছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যকার যোগসূত্র স্থাপনকারী বন্দর হিসেবে। জাপানি কূটনীতিকদের বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল
জাপানি বিনিয়োগে বাস্তবায়নাধীন আরেকটি মেগাপ্রকল্প হলো রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকায় নির্মীয়মাণ প্রকল্পটিতে জাইকার অর্থায়ন ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে লক্ষ্যের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনেই এটি উদ্বোধন করা সম্ভব হবে।
মেট্রো ও পাতাল রেল
রাজধানীর সড়ক অবকাঠামোয় চলমান মেগাপ্রকল্পগুলোর মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছে জাপানি বিনিয়োগ। এর মধ্য দিয়ে ঢাকায় গণপরিবহনের যাতায়াত উন্নয়নে গৃহীত মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার।
মোট ১২৮ দশমিক ৭১ কিলোমিটার (উড়াল ৬৭ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার এবং পাতাল ৬১ দশমিক ১৭ কিলোমিটার) দীর্ঘ, ১০৪টি স্টেশন (উড়াল ৫১টি এবং পাতাল ৫৩টি) বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার এই প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এতে বড় বিনিয়োগ করছে জাপানি সাহায্য সংস্থা- জাইকা।
এর মধ্যে এমআরটি-৬ মেট্রোরেল প্রকল্পটি ২০২২ এর মধ্যে শেষ হবে। আর শেষটা অর্থাৎ এমআরটির শেষ প্রকল্পটি ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হবে। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
এসবের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে মেট্রোরেল-লাইন-৬ প্রকল্পটি। অন্যগুলো হলো মেট্রোরেল লাইন-১ এবং মেট্রোরেলের লাইন-১ (ই/এস), মেট্রোরেল লাইন-৫ এর নর্দার্ন রুট এবং সাউদার্ন রুট।
২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্পে (এমআরটি-৬) জাইকার বিনিয়োগ ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। হেমায়েতপুর-ভাটারা পর্যন্ত মেট্রোরেল (এমআরটি-৫) নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী বছর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা দিচ্ছে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। আগামী মার্চে শুরু হচ্ছে ঢাকার পাতাল রেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ মেট্রোরেল প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পেও প্রধান অর্থায়নকারী জাইকা।
জাপানি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপান বাংলাদেশের পরীক্ষিত ও অকৃত্রিম বন্ধু দেশ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৩ সালের ঐতিহাসিক জাপান সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এটি ছিল অংশীদারত্বের সূচনা, যা দিনে দিনে শক্তিশালী হয়েছে।’
অর্থমন্ত্রী জানান, জাপানি অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু সড়ক ও যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু, ঢাকা শহরের মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল, মাতারবাড়ী পাওয়ার প্লান্ট, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ চলমান বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প চলমান রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু
দেশের অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামোর মেগাপ্রকল্পগুলোতেও বড় বিনিয়োগ রয়েছে জাইকার। যমুনা নদীর ওপর ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুটি। প্রকল্প ব্যয়ের ৭২ শতাংশ বা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে জাইকা।
পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় সেতু অবকাঠামো নির্মাণে চলমান ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের মোট ব্যয় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার অর্থায়ন ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। আন্তসীমান্ত সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে গৃহীত ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের অনুমিত ব্যয় ৩ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার মধ্যে সংস্থাটি দিচ্ছে ২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতে জাপানি বিনিয়োগ
গত কয়েক বছরে দেশে জাপানি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেআইটিও) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে চালু জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৭০।
এর প্রায় এক যুগের মাথায় (চলতি বছরের এপ্রিল) দেশে চালু জাপানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে ৩২১টিতে দাঁড়িয়েছে বলে জাপান দূতাবাসের তথ্যে উঠে এসেছে। নামিদামি জাপানি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশে কারখানাও স্থাপন করছে।
মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হোন্ডা এরই মধ্যে কারখানা স্থাপন করেছে। এ ছাড়া দেশে ইয়ামাহা মোটরসাইকেলের কারখানা ও বিপণন করছে এসিআই।
তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান জাপান টোব্যাকো সম্প্রতি আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নেয়। এতে জাপানের কোম্পানিটি বিনিয়োগ করছে ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা।
বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিপ্পন স্টিল অ্যান্ড সুমিতমো মেটাল দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রডাক্টসের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইস্পাত কারখানা করছে। এ জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দের বিষয়ে বেজার সঙ্গে চুক্তিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকায় একের পর এক স্টোর খুলছে জাপানি পোশাকের ব্র্যান্ড ইউনিক্লো ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড মিনিসো।
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (জেবিসিসিআই) মহাসচিব তারেক রাফি ভুঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাপানি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখানোর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী।
‘বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় আগের চেয়ে অনেক বেশি। মাথাপিছু আয়ে ভারতকে আমরা ছাড়িয়ে গেছি। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বড়। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেলে ভোক্তারা দ্রুত উন্নতি করে। এ কারণে ফুডস আইটেমসহ নানা ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎকেন্দ্রে জাপানি বিনিয়োগ
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে জাপান। জাইকার অর্থায়নে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৩৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে জাইকার অর্থায়ন ২৯ হাজার কোটি টাকা।
টোকিওভিত্তিক কোম্পানি জাপানস এনার্জি ফর আ নিউ এরার (জেরা) বিনিয়োগ পরিকল্পনায় এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ঢাকার অদূরে মেঘনাঘাটে বাস্তবায়নাধীন রিলায়েন্স পাওয়ারের বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৪৯ শতাংশ ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে জেরা।
এর বাইরেও দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর আগ্রহ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্য দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রভাব বিস্তারকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে জেরা।
বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের জোয়ার: ব্লুমবার্গ
করোনা মহামারি, চীনের প্রতিবেশীদের ওপর খবরদারি, মিয়ানমারের সেনাশাসনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাপানের উদ্যোক্তারা তাদের কোম্পানিগুলোকে চীনের বাইরে স্থানান্তরে উৎসাহিত করছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাপানি বিনিয়োগের জোয়ার আসতে পারে বলে ধারণা করছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
তাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানের উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে আনার জন্য জাপান সরকার নানাভাবে উৎসাহিত করছে। জাপান এমন সময় কারখানাগুলোকে স্থানান্তরে উৎসাহিত করছে, যখন বাংলাদেশে দেশটির জন্যই শুধু একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হচ্ছে।
ব্লুমবার্গ জানায়, বাংলাদেশে এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ বিলিয়ন ডলার জাপানি বিনিয়োগ আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ।
জাপানি রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো নাওকি গত ফেব্রুয়ারিতে ব্লুমবার্গকে বলেন, বাংলাদেশে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের শিল্পাঞ্চল তৈরিতে বিশেষ ঋণ হিসেবে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে জাপান। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিতে গোটা এশিয়ার মধ্যেই এত বড় সহযোগিতা আর হয়নি।
১ বিলিয়ন ডলারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আসবে ২০ বিলিয়ন ডলারের।
২০২২ সালের শেষের দিকে উৎপাদনে যাবে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এক বিলিয়ন ডলারের জাপানি বিনিয়োগে এটি করা হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক এক লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান ইউসুফ হারুন নিউজবাংলাকে বলেন, জাপান এ ইকোনমিক জোনে ২০২২ সালের শেষের দিকে উৎপাদনে যাবে কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় এক হাজার একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতিমধ্যেই ৬২০ একর জায়গা সরকার দিয়েছে। বাকি ৩৮০ একর জায়গা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আছে।
২০১৯ সালে বেজা ও জাপানের সুমিতোমো করপোরেশনের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ভূমি উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে সুমিতোমো করপোরেশন। বেজার তত্ত্বাবধানে জমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) যৌথভাবে প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
বেজার তথ্য মতে, এখানে বাংলাদেশের শেয়ার ৩০ শতাংশ আর জাপানের ৭০ শতাংশ। জাপান সরকার সুমিতোমো কোম্পানিকে তাদের ডেভেলপার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬০ একর জমি উন্নয়নের মাধ্যমে সুমিতোমো করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে বিনিয়োগের জন্য এরই মধ্যে ২২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। মার্চের মধ্যে আরও ১৬০ একর জমি সুমিতোমো বুঝে পাবে।
বেজা চেয়ারম্যান জানান, তালিকাভুক্ত কোম্পানি দ্রুতই তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান করবে। অধিকৃত বাকি জমিরও উন্নয়নের কাজ চলছে। নতুন জমি অধিগ্রহণের কাজও চলমান আছে।
এই অর্থনৈতিক জোনে অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলি, মোটরসাইকেল, মোবাইল হ্যান্ডসেটসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য ও যন্ত্রপাতি, অ্যাগ্রো ফুড, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে বেজা।
এরইমধ্যে এখানে বিনিয়োগ করতে জাপানের টয়োটা, মিতসুবিশি, সুমিতোমো, তাওয়াকি, সুজিত লিমিটেডের মতো কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান, এই শিল্পাঞ্চলে ১০০ জাপানি কোম্পানি থাকবে। এই অঞ্চল তৈরিতে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে জাপান। আর কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কারখানা করবে জাপানি বিনিয়োগকারীরা।
আড়াইহাজারের এই অর্থনৈতিক অঞ্চল সফল হলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জাপান আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবে। সেটি সফল হলে কক্সবাজারের মহেশখালীতে পরবর্তী অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে বলে জানান ইতো নাওকি।
ঢাকায় জাপান দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে জাপানের ক্রমবর্ধমান প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৯০ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৩২১টিরও বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছিল। এ সংখ্যা ২০১০ সালে কাজ করা ৮৩টি কোম্পানির সংখ্যার প্রায় চারগুণ।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ২০২০ অর্থবছরে জাপানের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬০ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১০ অর্থবছরের প্রায় তিনগুণ বেশি।
আড়াইহাজার হবে গেমচেঞ্জার
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত হলে জাপানভিত্তিক কোম্পানি ও যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের একটি নতুন ঢেউ আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে জাপান ও বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নে অথবা আইসিটির মতো উদীয়মান খাতে উন্নয়ন অংশীদার হতে পারে। ক্রমবর্ধমান ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী যেহেতু জাপান বাংলাদেশের বিদেশি শীর্ষ পাঁচটি বিনিয়োগকারী দেশের অন্যতম। তাই অর্থায়ন, নির্মাণ, পুঁজি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মেগা-প্রজেক্টগুলোতে দেশটি আমাদের অন্যতম প্রধান অংশীদার হতে পারে।
‘জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক এখন এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। জাপানে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং জাপান থেকে আমদানির পরিমাণ ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের বিনিয়োগ, পণ্য ও রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য চাই। আমরা সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে শিল্প ও ভোক্তা উভয় বৈশ্বিক বাজারেই সেবা দিতে চাই। বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোতে সহায়তা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে জোরদার, বিস্তৃত ও গভীর সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে।’