গোধূলিলগ্নে আমাদের বাস পেত্রায় পৌঁছাল। বিকেল পার হয়ে সূর্যটা তখন ডুবি ডুবি করছে। দলে আমরা ১২ জন বাংলাদেশি নারী। যতই মূল শহরের কাছাকাছি হই, বিস্ময়ে চোখ যেন সরে না! এসেছি তো পুরোনো শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে, কিন্তু এখনকার পেত্রা, যেখানে কিনা ২০ হাজার মানুষের বাস, সেটাও যে এত সুন্দর, ধারণা ছিল না। ছবির মতো সুন্দর ও ছিমছাম শহরটা মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে আমরা হোটেলে পৌঁছে যাই। বাস থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস আমাদের অভ্যর্থনা জানাল।
হাতে সময় আছে, তাই হোটেল রুমে গিয়ে তৈরি হয়েই যাঁর যাঁর মতো বের হয়ে পড়লাম। স্থানীয় খাবার খেতে রিভিউ দেখে এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেখি, বিভিন্ন দেশের পর্যটকে গিজগিজ করছে। মেনু ঘেঁটেঘুঁটে জর্ডানের ঐতিহ্যবাহী খাবার মানসাফ দিতে বললাম। ইউটিউবে মানসাফ প্রস্তুত করার যে রাজকীয় আয়োজন দেখেছি, তার বিপরীতে ছোট্ট এক বাটি ভাত আর ভেড়ার মাংস এল দেখে একটু দমেই গেলাম। মানসাফ মুখে দিয়েও তত আহ্লাদিত হতে পারলাম না; ভেড়ার নরম মাংসটা একটু মজার, কিন্তু বাদাম দেওয়া ভাতটা অত সুবিধার নয়। যা–ই হোক, খাবার শেষ করে রাস্তার দুই পাশে পর্যটকের জন্য রকমারি সম্ভার নিয়ে সুন্দর গোছানো দোকানগুলো ঘুরে দেখে হোটেলের পথ ধরলাম।
পরদিন আমাদের মূল আকর্ষণ পুরোনো শহর, মানে মূল পেত্রা দেখতে যাওয়ার কথা।
সকাল ছয়টায় উঠতে হবে।
সকাল ছয়টার মধ্যেই বাসে উঠে বসলাম। যদিও হোটেল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। ভিড় শুরু হওয়ার আগেই আমরা যেন সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পাই, তাই এই পাঁচ ডিগ্রির শীতের ভোরে পেত্রায় ছুটে যাওয়া। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শুনলাম, মার্চের শেষে এমন আবহাওয়া পেত্রায় নাকি খুবই অস্বাভাবিক!
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি পেত্রা। জায়গাটা লোহিত সাগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে জর্ডানের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর ওয়াদি মুসার ঠিক আগে হুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। ৪০০ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল আরবের নাবাতীয় রাজ্যের রাজধানী। তখন সমৃদ্ধির শীর্ষে ছিল এই নগরী। বহু বছর মানুষের আলোচনার বাইরে থাকার পর ১৮২২ সালে সুইস পরিব্রাজক জোহান লুডিগ দুই বছর ধরে মুসলিম ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বেদুইন, যাযাবরদের সঙ্গে থেকে এই শহরের সন্ধান পান। ‘সম্পদ আর ক্ষমতায় পেত্রাবাসীরা যে একসময় কতটা সমৃদ্ধ ছিল, তা প্রমাণ করতে পেত্রাদের ধ্বংসাবশেষই যথেষ্ট।’ ১৯৮৫ সালে পেত্রা নগরীকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে এই কথাটাই বলেছে ইউনেসকো।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে মূল শহরে ঢুকতে হয়। বিশাল বড় বড় পাথরের দেয়ালের মধ্য দিয়ে পুরো রাস্তা। প্রচণ্ড ঠান্ডায় এই বিশাল এলাকা পায়ে হেঁটে দেখা কষ্টকর। ইলেকট্রিক কারের টিকিট কিনে মূল পেত্রা নগরীর দিকে অগ্রসর হলাম। যেতে যেতে মনে হলো রূপকথার প্রাচীন কোনো পাথুরে নগরে ঢুকে পড়ছি, কোনো এক কারণে হঠাৎ করে এখানকার বাসিন্দারা মনে হয় অন্য কোথাও চলে গেছে!
একসময় পেত্রা অত্যন্ত সুন্দর ও সুরক্ষিত একটি দুর্গ ছিল, চারধারে ছিল উঁচু পাহাড়ি দেয়াল। কিছু দূর পরপর বর্গাকার-গোলাকার উঁচু উঁচু স্তম্ভ আর পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা পাথুরে কারুকার্য! পেত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, সম্পূর্ণ নগরীটি মূলত পাথরের। নগরীর দালানের ভেতরের রুমগুলো পাহাড় কেটে কেটে নিপুণভাবে কোথাও ১২ ফুট, কোথাও তার থেকেও উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাসাদের ভেতরে মোজাইক করা মেঝে দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, পঞ্চম শতকে বাইজেনটাইনদের আমলে এই মোজাইক করা।
নগরীটি এমন সুবিধাজনক জায়গায় নির্মিত হয়েছিল, যেখান থেকে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মূলত এ কারণেই নগরীটি অর্থনৈতিকভাবে বেশি সমৃদ্ধ এবং নিরাপত্তার দিক দিয়েও অনেক সুরক্ষিত ছিল। এই নগরীর চারপাশের উঁচু পাহাড়গুলোতে অনেক ঝরনাও ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
হঠাৎ চোখের সামনে বিভিন্ন জায়গায় দেখা সেই অতি পরিচিত ছবি! যে রাস্তা ধরে এলাম, সেটা এসে হঠাৎই যেন থামল একেবারে সেই সুবিখ্যাত ট্রেজারি বা কোষাগার ভবনের সামনে! পেত্রার মূল আকর্ষণই এই ‘খাজানাতে ফেরাউন’ মন্দির। যা একসময় ‘ফারাও রাজাদের ধনভান্ডার’ নামেও পরিচিত ছিল। এই স্থানের ছবি আমরা কমবেশি দেখেছি কোনো না কোনো সময়। পেত্রা নগরীর মূল গুহার ঠিক পাশেই রয়েছে কঠিন পাহাড়ের ওপর কারুকাজ করা দালানগুলো। যার মধ্যে ‘খাজানাতে ফেরাউন’ নামের এই মন্দির অন্যতম।
আমাদের সঙ্গে ওয়ালিদ নামের একজন গাইড আছেন। প্রথম দিন থেকেই জর্ডানের সব পর্যটন স্থান ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ালিদ ভাই আমাদের ঐতিহাসিক তথ্য গল্পের মতো বলতে লাগলেন।
নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী থাকার সময়ই পেত্রারা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। পরে রোমানরা সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য শুরু করলে পেত্রাদের আধিপত্য কমে যায়, একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে পেত্রারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ১০৬ সালে এসে রোমানরা পেত্রা দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির কিছুটা উন্নতি হলেও পরে প্রতিদ্বন্দ্বী শহর ‘পালমিরা’ অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে ফেললে পেত্রার গুরুত্ব কমে যায়। পেত্রার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। এভাবে যুদ্ধ–বিদ্রোহ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই নগরী একসময় প্রায় ধ্বংসই হয়ে যায়। গল্পের মতো কথাগুলো শুনতে শুনতে পেত্রাবাসীদের জন্য আমার মন কেমন ভারী হয়ে ওঠে। ভাবি, তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রিয় এই জায়গা পরিত্যাগ করে যখন পেত্রাবাসীদের যেতে হয়েছিল, কেমন ছিল সেই মুহূর্ত!
অনেকটা সময় এই ধনভান্ডারের সামনে কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম নাট্যশালার দিকে। দালান, মন্দির ছাড়াও পেত্রার অন্যতম আকর্ষণ বিনোদনের জন্য স্টেডিয়ামের মতো করে তৈরি করা এই নাট্যশালা; যেখানে প্রায় চার হাজার দর্শক একসঙ্গে বসতে পারতেন!
আবহাওয়ার চরম বৈরিতা সত্ত্বেও ঘুরে দেখলাম পঞ্চম শতকের শেষের দিকে তৈরি হওয়া এক অনিন্দ্যসুন্দর চার্চের ধ্বংসাবশেষ! যতটুকু টিকে আছে, সেটার সৌন্দর্যেও মোহিত হতে হয়।
একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এক চায়ের দোকানে বসে চা পান করার ফাঁকে দোকানির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই। চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে তাকিয়ে দেখি, মাঝেমধ্যেই ঘোড়া বা উটের পিঠে স্থানীয় বাসিন্দারা সওয়ারির খোঁজে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ঠকঠক শব্দ করে চলে যান।
২৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই নগরী ভালো করে ঘুরে দেখার জন্য অবশ্যই গোটা একটা দিন দরকার। ঢোকার আগে ওখান থেকে পাওয়া ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘুরতে পারলে সবকিছু ভালোভাবে দেখা সম্ভব।
আমাদের পেত্রা ঘুরে দেখার শেষের দিকে শুরু হলো বৃষ্টি। ষোলোকলা পূর্ণ! তবে শীত আর বৃষ্টির শত্রুতার মধ্যেও যে সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম, তা জীবনের মূল্যবান সঞ্চয়। বিষণ্ন, মেঘলা, বৃষ্টিস্নাত প্রাচীন নগরীকে স্মৃতির মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখলাম চিরদিনের জন্য।