মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানে পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তনের পর থেকেই ক্রমাগত বিকাশ ঘটছে শিল্পটির। সেখানে পোশাক শিল্পের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন প্রবাসী শ্রমিকরা, যাদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশী। আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে, জর্ডানের পোশাক শিল্পে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালের ৪৯ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৬ শতাংশ। এর পরই করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানায় সংখ্যাটা কমে আসে অনেকাংশেই।
সম্প্রতি পরিস্থিতির আবার উন্নতি হচ্ছে। জর্ডানের শিল্প খাতের কমপ্লায়েন্স পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) যৌথ উদ্যোগ ‘বেটারওয়ার্ক’। ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০২২: অ্যান ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স রিভিউ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জর্ডানের পোশাক শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার বেশি। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই অভিবাসী, পাশাপাশি তাদের প্রায় ৭৪ শতাংশই নারী। সংখ্যার হিসেবে এসব শ্রমিকের ৪৫ শতাংশই বাংলাদেশী এবং জর্ডানে থাকা বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে ৯২ শতাংশই নারী।
সেখানে যেমন অনেক শ্রমিক কাজ করছেন, তেমনই কাজ করছে কিছু ইউনিয়ন অর্গানাইজারও। শ্রমিক ও প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্টের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজটা মূলত তারাই করেন। যেসব মানুষ নিজের কথা বলতে পারে না, তাদের হয়ে কথা বলেন এসব ইউনিয়ন অর্গানাইজার। তাদেরই একজন মায়া।
জর্ডানের পোশাক খাতে ৬৫ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেন। যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। দেশটির মোট শ্রমিকের ৭৬ শতাংশই অভিবাসী, আর যাদের ৮০ শতাংশই গিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে। সেখানে ভাষা এবং অন্যান্য অনেক কিছু নিয়েই নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন অভিবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকরা। তাদেরই সহায়তা দেয়ার কাজ করেন মায়া। জেনে নিন তার গল্প।
ছয় বছর আগে যখন একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়ে জর্ডানের পথে পা বাড়ান মায়া, তখন তিনি নিজেও জানতেন না, ভবিষ্যৎ তার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে সময়ে ডেমরায় দুটি শোবার ঘরের ছোট একটি বাসায় পরিবারসহ বসবাস করতেন বর্তমানে প্রবাসী এই নারী। সেখানে ফল ব্যবসায়ী বাবা আর কাপড় সেলাই করে বিক্রি করা মায়ের আয়ই ছিল উপার্জনের পথ। তা দিয়ে ছয়জনের সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খেতেন তারা। যে টাকা সংসারে আসত তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলেনি মায়ার। তাই পরিবারকে সাহায্য করা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কিছু সঞ্চয় করার জন্য জর্ডানে চলে আসেন তিনি। তখন মায়া আক্তারের বয়স মাত্র ১৯ বছর।
নর্দান জর্ডানে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের এক আত্মীয়কে অনুসরণ করেন মায়া। ইরবিদে একটি পোশাক কারখানার রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন মায়া। তিনি বলেন, সেখানেই আমি মানুষ ও প্রশাসনিক বিষয়াদির সঙ্গে মানিয়ে চলা শিখি। যখন আমার চাকরির চুক্তি শেষ হয়ে যায়, আমি আবার বাংলাদেশে ফেরত আসি। ফিরে এসে দেখি, আমাদের বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই বাবার শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার।
সেই সময়ে পরিবারকে আরেকটু বাড়তি সহযোগিতা করার মনোভাব থেকে আবার জর্ডানে ফেরত যান মায়া। মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ও ইংরেজিতেও বেশ দক্ষতা ছিল মায়ার। ফলে সহজেই শাহাবের একটি পোশাক কারখানায় লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়ে যান তিনি। সেখানে ম্যানেজমেন্ট এবং কর্মীদের মধ্যে ভালোভাবে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য সহায়তা করাই হয়ে ওঠে তার কাজ।
একদিন তার সঙ্গে দেখা হয় টেক্সটাইল, গার্মেন্ট এবং ক্লদিং ইন্ডাস্ট্রির কর্মীদের জেনারেল ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ক এরশাদের সঙ্গে। সেটারই একটি সভায় তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইউনিয়ন অর্গানাইজারের কাজটা কী। পরবর্তী সময়ে তিনিই মায়াকে একজন নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি এই পোস্টে কাজ করেন।
পুকুর থেকে নদীতে: মায়া বলেন, তখন এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি বেশ খুশি হই আর এরশাদকে ইউনিয়ন অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করার জন্য আমার সুপ্ত ইচ্ছার কথাও জানাই। আমার মনে হয়েছিল, অন্য কর্মীদের সাহায্য করার সুযোগ পেলে সেটা আমার জন্য স্বপ্ন পূরণের মতো হবে। ভাবছিলাম, কাজটি আমাকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ দেবে সেই সঙ্গে আরো বেশি অভিজ্ঞতা বাড়াতে সাহায্য করবে, পাশাপাশি তাদের হয়ে কথা বলতে সাহায্য করবে যারা বলতে পারে না।
‘আমাকে অবাক করে দিয়ে এরশাদ কয়েক মাস পরে আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে। আর বলে আমি এ কাজের জন্য আগ্রহী কিনা। সম্মতি দিলাম, মনে হলো স্বাধীনতা পেলাম। এর আগে আমি একটি পুকুরে বাস করা মাছের মতো ছিলাম, যাকে নদীতে বাস করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শাহাবের পোশাক কারখানায় অভিবাসী কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করার কাজ পেয়ে খুব সম্মানিত বোধ করছিলাম। সেটাই আমার জীবনের ক্যারিয়ার মাইলস্টোন ছিল, যেটা আমার জীবনকে বদলে দেয়।’
স্বপ্নে বাঁচা: ২০২০ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন অর্গানাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন মায়া। সেখানে তার মূল লক্ষ্য ছিল অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করা এবং পোশাক কারখানার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে মুক্তভাবে যোগাযোগ করে সমাধান খুঁজে বের করা।
তবে ইউনিয়ন অর্গানাইজার হিসেবে মায়ার সুযোগ গ্রহণ করাটা জর্ডানে যারাই অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, তাদের সবার সাফল্য হিসেবে মনে করেন তিনি। বিভিন্ন ভাষাভাষী হওয়া এবং কথা বলার ভালো দক্ষতা থাকার কারণেই মায়া তাদের হয়ে কাজ করতে পেরেছেন, যারা মাতৃভাষা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। তার মতে, এসব কর্মীর ভাষার বাধা পেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পেরে আমরা ধন্য বোধ করছি। সেটাই বিভিন্নভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে সমতা আনার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) যৌথ প্রোগ্রামের নাম বেটার ওয়ার্ক। এখানে বৈচিত্র্যময় দলগুলোকে একত্রে আনা হয়। সেখানে সরকার, বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, ফ্যাক্টরির মালিক এবং ইউনিয়ন ও কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হয়। সেই সঙ্গে এ খাতকে আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা হয়।
বেটার ওয়ার্ক জর্ডানের কিছু কাজেও অংশ নেন মায়া, সেখানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, যেমন কাজের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, কার্যকর যোগাযোগ, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, একসঙ্গে দরদাম করা, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিক আইন। এসবই মায়াকে আরো ভালোভাবে তাদের হয়ে কথা বলতে সাহায্য করে।
চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে: তবে কাজ শুরুর প্রথম দিকে শ্রমিকদের লম্বা কর্মঘণ্টার কারণে তাদের সঙ্গে মিটিং আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়ত। অনেকে তো নিজের কথা বলতেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন না, এমনকি বাংলাদেশী কোনো প্রতিনিধির কাছেও তারা কথা বলতে চাইতেন না। কেউ কেউ চাকরি হারানোর ভয় পেতেন, আবার কারো কারো ম্যানেজার তাদের পরামর্শ দিত ইউনিয়ন অর্গানাইজারদের সহযোগিতা না করতে কারণ তাদের ধারণা এতে সমস্যা তৈরি হবে।
কিন্তু সেই জায়গা থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে আসেন মায়া নিজেই। তিনি বলেন, এসব শ্রমিকের নিজেদের কণ্ঠস্বর শোনানোর লক্ষ্যে আমি অবিচল ছিলাম। আমি তাদের নাম প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতি দিই এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে তাদের সঙ্গে দেখা করি যেন তারা নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে আবার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন মায়া। এ সময়ে করোনার কারণে কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কোনো মিটিং আয়োজন করতে পারেননি। সেই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নজর রাখার জন্য টেলিফোন কলের ওপর নজর রাখতে হতো আর দেখতে হতো কর্মীরা কেমন আছেন। ওই লকডাউনের মধ্যে অনেকেই তাদের নিজের দেশে ফেরত যেতে চাইত। কিন্তু তারা সেটা পারছিল না, কারণ বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় কোনো ফ্লাইট চলাচল করছিল না। সেই সময়ে জর্ডানে আটকা পড়ে থাকাদের এই কঠিন পরিস্থিতি বোঝান মায়া।
সামনে এগোনো: অনেক কর্মীই সেই সময়ে ইউনিয়ন অর্গানাইজারের কাজ সম্পর্কে জানতেন না। ফলে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যখন তারা কোনো সমস্যায় পড়তেন তখন যে তারা ইউনিয়ন অর্গানাইজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তাও তারা জানতেন না। সেই কারণে ইউনিয়ন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিটিংগুলোতে কর্মীদের সংযুক্ত করা হতো। তাহলে কীভাবে ইউনিয়ন বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে পারে সেই তথ্য সবার কাছে ছড়ানো যেত সহজেই।
অভিবাসী কর্মীদের সাহায্য করা এবং তাদের ক্ষমতায়ন করা নিজের জীবনের সবচেয়ে পুরস্কৃত অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। মায়া বলেন, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করাটা আমাদের কিছু উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে এবং আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশে আমার পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পেরে আবার অনেক খুশি হয়ে উঠি এবং অন্য বাঙালিদের প্রতিনিধি হতে পেরে সম্মানিত বোধ করি।
আগামী দিন নিয়েও কিছু ভাবনার কথা জানান মায়া। তার মধ্যে অভিবাসী কর্মীদের বাড়তি সহায়তা দেয়ার জন্য প্রশিক্ষক হওয়ার ইচ্ছাও রয়েছে তার। ইচ্ছে রয়েছে মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি নেয়ার। তাতে তার জীবনে বাড়তি মূল্য যুক্ত হবে। মায়া বলেন, তখন শুধু কর্মীদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করব না, বরং সম্ভবত তাদের ভালোমতো বুঝতেও পারব।
শর্মিলা সিনড্রেলা