শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন

ছুটির বিকেলে অন্টারিও লেকে

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩

বিকেলের রোদে দুই লেনের অপরিসর রাস্তাটা এগিয়ে গেছে নীল লেইকের ধার ধরে। দুই পাশে প্রচুর গাছ। অনেক গাছেই বেগুনী…সাদা…গোলাপী ফুলে ছেঁয়ে আছে। ঝকমকে রোদ আজ। বাতাস আরামদায়ক। রাস্তা একেবেকে এগিয়ে গেছে। তাই অন্টারিও লেকের নীল জল আমাদের কাছাকাছি চলে আসছিল মাঝে মাঝেই। গাড়ী এভাবে চালাতে হচ্ছিলো যেন চারিদিকের এই বিছিয়ে থাকা নিরব সৌন্দর্যের ঘুম না ভেঙ্গে যায়।

ছন্দ একটু পর পর বলছিলো..”কি সুন্দর! কি সুন্দর!”

“গোস্ট টাউন মানে কিন্তু ভুতুরে শহর না।” গাড়ীতে সহযাত্রী তরঙ্গ আর ছন্দ। ড্রাইভার আমি হলেও কথা আমিই বলছিলাম। সব সময় আমিই বলি। বাকিরা আশা করি শোনে। না শুনলেও করার কিছু নেই। কথা আমাকে বলতেই হয়।

“শহর মরে যায়। লোকালয় পাত্তারী গুটিয়ে ফেলে। যে কারনে বসতি গড়েছিলো মানুষ……সে কারন ফুরিয়ে গেছে। মানুষ চলে গেছে। ব্যস্…..শহর পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে…..সেই সব শহরগুলোকে ইংরেজীতে গোস্ট টাউন বলে। এই রাস্তাটাকেও গোস্ট সড়ক বলতে পারো। এক সময় খুব ব্যস্ত প্রধান সড়ক ছিল। এখন ঝিম মেরে পড়ে থাকে। আমার মতো বেড়াতে আসা লোকজন এ রাস্তায় গাড়ী চালায়। উইকএন্ডগুলোতে সৌখিন লোক জন আসে। আর কেউ আসে না। নতুন প্রধান সড়কগুলো আরো উত্তরে সরে গেছে। এই পুরনো সড়ক আর এই সড়কের উপর গড়ে উঠা পাশাপাশি তিনটি শহরও সেই সংগে মরে গেছে। সেই আঠারোশো সালের দিকে তৈরী হয়েছিলো লোকালয়গুলো। একশ বছর পরে এসে…১৯৫০-৬০ সালের দিকে পুরোপুরি পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে।“

“সেই সময়ের দেখার কিছু আছে?” প্রশ্ন শুনে সন্তুষ্ট হলাম। তরঙ্গ আমার কথা তাহলে শুনছিলো। 😀

“আছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা চার্চ। একটা স্কুল ঘর। কিছু ভাঙ্গা হাউস…আর একটা পরিত্যাক্ত সিমেটারী…মানে কবরস্থান। অনেক পুরনো কবর আছে।“

আমি একটা কাঠের ভাঙ্গা ইমারত দেখে গাড়ী দাঁড় করালাম। পাশ দিয়ে পাথর বিছানো রাস্তা চলে গেছে। যত্ন নেই। চলাচল নেই। রাস্তায় ঘাস জন্মে গেছে। কি বিষন্ন! কি নিরব! মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে কান পাতলে অতীতের কোলাহল শোনা যাবে।

তরঙ্গ তাড়াতাড়ি বললো, “আমরা কিন্তু ওল্ড সেই সিমেটারী দেখতে যাচ্ছি না।“

আমি হেসে দিলাম।  “ঠিক আছে…চলো অতীত ভুলে যাই…এ এলাকায় এখনো লেকের পাড়ে বেশ বিশাল বিশাল বাড়ী বানিয়ে বড়লোকেরা সামারে থাকে। সেখানে পাথুরে বীচ আছে।“

আমরা একটা পুরনো সাইড রোড ধরে লেকের একেবারে কিনারায় চলে আসলাম। পাশাপাশি বিশাল বিশাল বাংলো। সবুজ ঘাসে ঢাকা ব্যাকইয়ার্ড। সেখানে বসার চেয়ার-টেবিল বসানো। প্রাইভেট ব্যাক ইয়ার্ড শেষে শুরু হয়েছে পাথুরে সৈকত। সাদা সাদা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সেই মাটিতে। বসার মতো বড় বড় পাথরও আছে। আমরা খুঁজে পেতে যে যার মতো বসে গেলাম।

তরঙ্গ গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে খোঁটাখুঁটি করছিলো। “আসো..আব্বা-আম্মা তোমাদের একটা ছবি তুলে দেই।“

ছন্দ মুখ ঘুরিয়ে বললো, “বিরক্ত করো না। ছুবি তুলতে ভালো লাগছেনা। তুমি নেচারের ছবি তোলো। যাও।“

ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল। ছন্দ আস্তে আস্তে বললো,”তোমার শহর মরে যাওয়ার গল্প শুনে মনটা খারাপ হয়ে আছে।“ দেখলাম তার মুখটা আসলেই বিষন্ন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম…”আরে সেই কথা….গল্পতো আমি এখনো শেষ করিনি। শেষটা শোনো। যে স্কুলটা পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে..সেই স্কুলটাই ছিল সেই সময়ে এই লোকালয়ের প্রান। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসতো। ১৯৬৭ সালে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই স্কুলের জীবিত ছাত্র-শিক্ষকরা কেউ তাদের স্কুলকে কিন্তু ভোলেনি। ২০১৩ সালে তারা এই স্কুলে আবার সমবেত হয়েছিলো! তারা সবাই মিলে সংগঠন করে তাদের প্রিয় স্কুলের পুরনো লাল ইটের ইমারত টিকিয়ে রেখেছে এবং রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে।“

“সত্যি বলছো? নাকি বানিয়ে বানিয়ে আমাকে খুশি করার জন্য বলছো?”

আমি তাকিয়ে দেখলাম ছন্দর চোখের বিষন্নতা কমে যাচ্ছে। কেমন স্বস্থি ঝিলিক দিচ্ছে। মানুষ বড় অদ্ভুত! কোথাকার কোন গল্প মানুষের মন দুম করে পাল্টে দেয়…..কখনো ভালো করে দেয়…..কখনো খারাপ করে দেয়…..গল্পের এই অসীম ক্ষমতা আমি যতবার দেখি ততবার অবাক হই।

হেসে দিয়ে বললাম..”ধুর..এতো মিথ্যা কথা বানিয়ে বলা যায়?…গুগল করে দেখাবো?”

“না থাক…মন ভালো হয়েছে..ভালোই থাকুক। খারাপ করার দরকার নাই। তরঙ্গ….আসো ছবি তুলি।“

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com