কেরালায় কয়েকদিন বেড়িয়ে এসে দেখে এলাম ভিন্ন রকম এক ভারত। যে ভারতের সাথে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তেমন কোন রকম মিলই নেই। মানুষ থেকে শুরু করে, তাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, আর পুরো পরিবেশগত পার্থক্য। যা অন্যান্য ভারত থেকে এই ভারত থেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলেছে। অবাক চোখে দেখেছি, থেকেছি, খেয়েছি, ঘুরেছি আর ভেবে গিয়েছি, এ কোন ভারত ? এক কোন জগৎ? এ কোন পরিবেশ? এখানে শুধু দুইদিন কেরালা আর কোচিন ঘুরে যেসব পার্থক্য চোখে পড়েছে সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
কেরালা স্টেশনে নেমেই একরাশ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছি,ঝকঝকে স্টেশন, স্টেশনে যাত্রীদের জন্য অল্প খরচে দারুণ আরামদায়ক এসি বিশ্রাম কক্ষ আর বাথ পরিচ্ছন্ন বাথরুমের ব্যবস্থা দেখে, সাথে আরাম করে নিশ্চিন্তে গোসলের সুব্যবস্থা। টিকেট থাকা সাপেক্ষে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ২৫ রুপির বিনিময়ে।
দ্বিতীয়ত অবাক করার মতো ছিল খাবারের ব্যাপার। যখন কেরালা যাওয়ার কথা হয়েছে, তখন থেকেই সবাইকে বারবার বলে আর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ওদিকে গিয়ে কেউ যেন ভুলেও মাংস খেতে না চায়। মাংসের নামই যেন না নেয় মুখে, বিফের কথা যেন ভুলেও উচ্চারণই না করে। শুধু সবজি, ডিম আর খুব বেশি হলে মাঝে মাঝে মাছ খুঁজে দেখা যেতে পারে। কিন্তু গিয়ে দেখি একদম ভাবনার উল্টো সব ব্যাপার। হোটেলগুলোতে প্রায় সব রকম খাবার পাওয়া যায়, সবজি আর মাছ থেকে শুরু করে সব রকম মাংস, এমনকি গরুর মাংস পর্যন্ত আছে। রান্না বা কাবাব। আর সব খাবারের দামও সাধ্যের চেয়েও তুলনামুলক কম।
তৃতীয় অবাক করার মতো আর সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপার ছিল ওদের ভাষা। হ্যা ভাষাই, ওরা ভারতীয় হলে কি হবে? না জানে হিন্দি না তেমন ইংরেজি। ওরা শুধু ওদের তামিল ভাষা ছাড়া তেমন কিছুই জানে না। অধিকাংশই এমন। যে কারণে একদিন সকালে নাস্তা খেতে হোটেলে গিয়ে ডিম পোঁচ বা ভাজি খাবো সেটা বোঝাতে ৪০ মিনিট অপেক্ষা করার পরে দুরের এক দোকান থেকে হিন্দি বোঝে এমন একজনকে খুঁজে নিয়ে আসার পরে তাদের বোঝাতে হয়েছে।
চতুর্থত, কেরালা প্রদেশের মুল যে শহরটি, সেটির নাম ইরনাকুলাম। আর কেরালার এই মুল শহরটিকে পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ইরনাকুলাম যেটা আধুনিক কেরালা। একদম ঝকঝকে, তকতকে, আধুনিক, আর ব্যস্ততম এক শহর। যে শহরের রাত আর দিনকে আলাদা করা মুশকিল। যে শহরের কিছু কিছু জায়গা তো এমন যে, গাড়ির শোরুম, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, ব্যস্ততা আর অতি আধুনিক ছেলেমেয়েদের দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটা ভারত নাকি পশ্চিমা কোনো দেশ।
অথচ মাত্র কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই চোখে পড়বে পুরোনে, নিরব, নির্জন, কোচিন শহরের অন্য এক কেরালার। যেখানে আলো আছে কিন্তু ঝলমলে নয়, শপিংয়ের জায়গা আছে কিন্তু অতি আধুনিক নয়, রেস্তোরাঁ আছে কিন্তু অভিজাত নয়, মানুষ আছে কিন্তু ব্যস্ততা নেই, ছেলেমেয়েদের আড্ডা আছে, কিন্তু সাধারণ মানের। এখানে সবকিছু পুরোনো, বনেদী, ধীরস্থির আর ঐতিহাসিক। কোচিন শহর তার সবটুকু পুরোনো ঐতিহ্য যেন ধরে রেখেছে।
কোচিনের সরু রাস্তাঘাট, খোলা ময়দান, পুরোনো ঘরবাড়ি, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, দুর্গ, বিমানবন্দর, সমুদ্রতীর, খোলা প্রান্তর, সাগরের সাথে লাগোয়া গভীর নদী, পুরোনো সেতু, জেটি, ডক ইয়ার্ড, নোঙ্গর, ফেরিঘাট, হোটেল ইত্যাদি। সবকিছুই যেন ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তেমনই রয়ে গেছে বা রাখা হয়েছে। দারুণ লেগেছে এই কোচিনকে। কিন্তু আফসোস সেখানে থাকা হয়নি, সেই সময় মেলেনি ধীর স্থির আর নীরব, আর ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে দেখে অনুভব করতে পারিনি বলে।
আর সর্বশেষ, হল কেরালার ঐতিহ্যবাহী আর বিখ্যাত কাঞ্চিভরন এবং সিল্ক শাড়ি। এই শাড়ি এমনি এক শাড়ি যে নারী কেন, যেকোনো পুরুষ মানুষই এই শাড়ির দোকানে ঢুকলে তার মাথা ঠিক রাখতে পারবে না আমি নিশ্চিত। কী রঙের, কী ধরনের, কেমন দামের, কোন ডিজাইনের, কোন ধরনের মানুষের জন্য কেমন শাড়ি আপনি চান? সব আছে সব। এসব শাড়ির কোনো একটা দোকানে ঢুকে পড়লে আপনি কোনোভাবেই ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে পারবেন না পরিবারের চিরন্তন খোটা থেকে মুক্তি পেতে, আর টাকা থাকলে পারবেন না, সব কীভাবে কীভাবে নিঃশেষ হয়ে গেল সেই আফসোসে জ্বলে-পুড়ে।
মোট কথা এই শাড়ির দোকানে একবার ঢুকতে পারলে আপনি কোনোভাবেই ভাগ্যের কাছে জয়ী হয়ে খুশি মনে ফিরতে পারবেন না। ভাগ্য এখানে আপনাকে পরাজিত করবেই। সেটা যেভাবেই হোক।
আর কেরালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বইচিত্রের কথা তো বলাই হলো না। কী চান আপনি? পাহাড়-সমতল সমুদ্র-অরণ্য-নদী-ঝরনা-চা বাগান নাকি জলপ্রপাত? সব আছে সবই পেতে পারেন দুই থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বের মধ্যেই। একই সাথে এমন সব রকম প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ভারতের আর কোনো প্রদেশের আছে বলে আমার জানা নেই।