কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটজিপিটির সাহায্যে হরহামেশাই সিভির কাভার লেটার, বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই ও আর্টিকেল লেখা হচ্ছে। এমনকি শিক্ষার্থীরা বাড়ির কাজ করার ক্ষেত্রেও এটির সাহায্য নিচ্ছে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীরা চ্যাটজিপিটি সাহায্যে কোনো প্রবন্ধ বা রচনা লিখে স্কুল শিক্ষকের কাছে তা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
চ্যাটজিপিটির সক্ষমতা অনেককেই বিস্মিত করেছে এবং প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলাবলি শুরু করেছেন যে চ্যাটজিপিটি বা এই ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রযুক্তি ভবিষ্যতে অনেক চাকরি কেড়ে নেবে।
২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল যে, পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৪৭ শতাংশ চাকরি এআই দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। প্রায় ১০ বছর আগে করা ভবিষ্যদ্বাণীটি এখন অনেকটাই সত্যি হওয়ার পথে। সম্প্রতি মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এআই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী অন্তত ৩০ কোটি চাকরি কেড়ে নেবে এবং এটি চাকরির বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে।
চ্যাটজিপিটি বা এআই প্রযুক্তিগুলো ভবিষ্যতে কোন কোন চাকরি কেড়ে নিতে পারে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার।
কম্পিউটার প্রোগ্রামার, কোডার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাটা অ্যানালিস্ট কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং কোডিং বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় চাকরি। তবে ভবিষ্যতে এআই টুলগুলো এক্ষেত্রে পুরোপুরি না হলেও কিছু মানুষের চাকরি খাবে।
ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের পার্টনার অনু মাডগাভকার বলেন, সফটওয়্যার ডেভেলপার, ওয়েব ডেভলপার, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, কোডার, ডাটা সায়েন্টিস্টদের কাজ অনেকটাই এআই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এসব প্রযুক্তির সাহায্যে পুরোপুরি না হলেও এই ধরনের অনেক কাজ করানো সম্ভব হবে। কারণ চ্যাটজিপিটির মতো এআই প্রযুক্তিগুলো এ ধরণের কাজে মোটামুটি নির্ভুল। এই টুলগুলোর নির্ভুলতা ও পারদর্শিতা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মার্কিন চাকরির বাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মার্ক ম্যুরো বলেন, চ্যাটজিপিটির মতো উন্নত প্রযুক্তিগুলো মানুষের চেয়ে দ্রুত কোড লিখতে পারবে। অর্থাৎ, আগের তুলনায় কম লোকবল দিয়েই কাজ সারবে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে একটি কাজ করতে একদল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন হতো, ভবিষ্যতে হয়তো একই কাজে মাত্র কয়েকজনের প্রয়োজন হবে।’
চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে যে প্রতিষ্ঠানটি, সেই ওপেনএআই ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের পরিবর্তে এআই দিয়ে কাজ করানোর কথা বিবেচনা করছে।’
তবে কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ওডেড নেটজার মনে করেন কোডারদের প্রতিস্থাপন করার বদলে এআই বরং তাদেরকে সহায়তা করতে পারে।
সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘চাকরির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয় সবাইকে প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে এআই কাজের গতি ও মান বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। কোডিং এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং দুটি ভালো উদাহরণ। এআই প্রযুক্তি দিয়ে এখন মোটামুটি ভালো মানের কোড লেখা সম্ভব। ‘
বিজ্ঞাপন, কনটেন্ট তৈরি, টেকনিক্যাল রাইটিং, সাংবাদিকতা
বিজ্ঞাপন, কনটেন্ট তৈরি, টেকনিক্যাল রাইটিং, সাংবাদিকতার মতো চাকরিগুলো চ্যাটজিপিটির মতো প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কারণ, মাডগাভকার মনে করেন, এআই টুলগুলো টেক্সট ভিত্তিক ডেটা ভালোভাবে লিখতে, পড়তে এবং বুঝতে সক্ষম।
তিনি বলেন, ‘আপনি অনুমান করতে পারেন যে বিশাল পরিমাণ তথ্য বোঝা ও বিশ্লেষণ করার কাজটি ভবিষ্যতে এআই খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে।
নোবালজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান নিউইয়র্ক টাইমসে তার কলামে লিখেছেন, রিপোর্টিং এবং রাইটিংয়ের মতো কাজগুলো ভবিষ্যতে মানুষের চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে এআই।
বিশ্বজুড়ে মিডিয়া শিল্প ইতিমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব দেখতে শুরু করেছে। প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সিনেট এআই টুল দিয়ে আর্টিকেল লেখাচ্ছে। চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইর সঙ্গে বাজফিড চুক্তি করেছে যাতে সংবাদমাধ্যমটির বিভিন্ন রকমের কনটেন্ট তৈরিতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানো যায়।
কিন্তু মাডগাভকার মনে করেন, কনটেন্ট নির্মাতাদের অধিকাংশ কাজই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব না। কারণ এসব কাজের প্রতিটিতেই প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা শুধু মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব।
আইনি পেশা
গোল্ডম্যান স্যাকসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আইন পেশার কর্মীরা এআই প্রযুক্তির কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন।
এই প্রতিবেদনের লেখক মানভ রাজ বলেন, ‘আইন পেশায় কর্মী সংখ্যা এমনিতেই কম এবং দেখা গেছে এই পেশার অনেক কাজই এআই প্রযুক্তির মধ্যমে করা সম্ভব।’
লিগ্যাল ইন্ডাস্ট্রির লিগ্যাল অ্যাস্টিস্ট্যান্টদের কাজ মূলত নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে সংক্ষিপ্ত আকারে উপনস্থাপনযোগ্য করা। এই কাজটি এআই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে খুব ভালোভাবে করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারপরও এআই এই ধরনের সব চাকরিকেই প্রতিস্থাপিত করতে পারবে না, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সবসময়ই মানুষের বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে।
মাডগাভকার মনে করেন, এআই প্রযুক্তিগুলোকে কাজের গতি ও মান বাড়াতেও ব্যবহার করতে পারেন কর্মীরা।
শিক্ষকতা
শিক্ষার্থীরা চ্যাটজিপিটির সাহায্যে বাড়ির কাজ করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ায় অনেক শিক্ষকই ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে রোচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের সহযোগী ডীন পেংচেং শি মনে করেন, শিক্ষকদের নিজেদের চাকরির নিরাপত্তা নিয়েও ভাবার সময় চলে এসেছে।
নিউইয়র্ক পোস্টকে তিনি বলেন, ‘চ্যাটজিপিটি ইতিমধ্যেই খুব সহজে পাঠদান করতে পারছে। যদিও এটিতে এখনো ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতা আছে। আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব।’
কিন্তু শ্যারন আহেম নামের একজন উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষক, যিনি তার পাঠপরিকল্পনার কাজে ইতোমধ্যে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছেন, মনে করেন না যে প্রযুক্তি তার চাকরি কেড়ে নেবে।
‘সবসময়ই আমাদের প্রয়োজন হবে এবং সামনাসামনি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই মানুষের সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন আছে,’ বলেন তিনি।
ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট
ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার এবং এই ধরনের আরও চাকরি যেখানে অনেক তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয়, এআই প্রযুক্তির কারণে এখন হুমকির মুখে আছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের মার্ক ম্যুরো বলেন, ‘এআই খুব সহজেই বাজারের প্রবণতা বুঝতে পারবে, কোন বিনিয়োগটি ভালো করছে আর কোনটি খারাপ করছে, সহজেই তা বের করতে পারবে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারবে কীভাবে এবং কোথায় বিনিয়োগ করলে সফলতার সম্ভাবনা বেশি।’
এই কাজগুলো এখনো করছে বাজার বিশ্লেষকরা। তারা অনেক অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু তাদের কাজের একটা অংশ বা পুরোপুরি এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
ট্রেডার্স
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ওয়াল স্ট্রিটের মতো স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর ট্রেডিং থেকে শুরু করে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং- সবই এআই টুলের সাহায্যে করা সম্ভব হতে পারে।
এসব কাজের কিছু কিছু স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। ফলে এখন যারা এসব তথ্য নিয়ে কাজ করছেন, তারা তাদের জ্ঞান অন্যত্র কাজে লাগাতে পারবেন।
রোচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পেংচেং শি-ও স্বীকার করেছেন যে ওয়ালস্ট্রিটের কিছু কিছু চাকরি হুমকির মুখে আছে।
নিউইয়র্ক পোস্টকে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো কলেজ থেকে বের হওয়ার শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করে এবং তারা ২-৩ বছর ধরে রোবটের মতো বিশাল তথ্য-উপাত্ত এক্সেলে বিশ্লেষণ করে বিজনেস মডেল তৈরি করে। এই কাজটি ভবিষ্যতে এআইর সাহায্যে সহজেই করা যাবে।
গ্রাফিক ডিজাইনার
গত ডিসেম্বরে হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের এক পোস্টে তিনজন অধ্যাপক বলেছিলেন ডাল-ই নামক একটি এআই ইমেজ জেনারেটর টুল গ্রাফিক ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। ডাল-ই তৈরি করেছে ওপেনএআই। এই টুলটি লিখিত নির্দেশনা থেকে যেকোনো বিষয়ের ছবি তৈরি করে দিতে পারে।
ওই পোস্টে বলা হয়, ‘লাখ লাখ মানুষ যখন নিজেরাই ছবি তৈরি করতে পারবে তখন এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এআই প্রযুক্তির কারণে যেসব খাতের চাকরি বিলীন হওয়ার হুমকিতে আছে, তারা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়তে পারে।’
কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. কার্ল বেনেডিক্ট ফ্রে মনে করেন, চ্যাটজিপিটির মতো টুলগুলো গ্রাফিক ডিজাইনের মতো সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রগুলোতে কর্মীদেরকে আরও মানসম্পন্ন কাজ প্রদানে সহায়তা করবে। তবে এসব প্রযুক্তিগুলো এ খাতের কর্মীদের আয়ের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা নিয়েই বেশি শঙ্কিত তিনি।
হিসাবরক্ষক
অ্যাকাউন্টিং বা হিসাবরক্ষণ কাজকে মোটামুটি স্থিতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ খাতের কর্মীরাও এখন এআই প্রযুক্তির কাছে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর কমিউনিকেশন, কালচার, ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ব্রেট কারাওয়ে বলেন, ‘প্রযুক্তি এখনো সবার চাকরি কেড়ে নেয়নি। কিন্তু এটি কিছু কিছু মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে। আইনজীবী এবং হিসারক্ষকরাও এর অন্তর্ভুক্ত।’
গ্রাহক সেবা
এখনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে রোবটের মাধ্যমে গ্রাহককে সেবা দেওয়া হয়। চ্যাটজিপিটি বা এই ধরনের প্রযুক্তির ফলে এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং সেবার পরিসর আরও বিস্তৃতত হবে।
বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান গার্টনারের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৭ সাল নাগাদ অন্তত ২৫ শতাংশ কোম্পানির মূল গ্রাহক সেবা প্রদানকারী হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার