রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৬ পূর্বাহ্ন

চিনের আশ্চর্য স্টোন ফরেস্ট

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪

ইউনেসকো তাকে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দিয়েছে। এই স্থানটির নাম হল স্টোন ফরেস্ট বা শিলিন।

কুনমিং হল অন্যতম গেটওয়ে অফ চায়না। সেই প্রবেশদ্বার দিয়ে যদি দক্ষিণ চিনে প্রবেশ করে যায় তাহলে যাওয়া যাবে য়ুনান প্রভিন্সে। যেখানে রয়েছে একটি অসাধারণ ট্যুরিস্ট স্পট। যাকে চিন তাদের দ্রষ্টব্য স্থানেখর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বর অর্থাৎ ‘ফাইভ-এ’ শিরোপা দিয়েছে। ইউনেসকো তাকে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দিয়েছে। এই স্থানটির নাম হল স্টোন ফরেস্ট বা শিলিন। প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা এই প্রস্তর অরণ্য দেখতে সাগর, ভূখণ্ড আর পর্বতমালা পেরিয়ে দূর দূর দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে। কাছাকাছি জায়গা থেকেও দর্শনধারীরা নিয়মিত এসে পৌঁছয় এর দরজায়। এই স্টোন ফরেস্ট-এ খাওয়ার জন্য কয়েকটি উপায় আছে। কুলমিং এয়ারপোর্ট থেকে বাসে যাওয়া যায়। তাছাড়া কুনমিং ইস্ট বাস স্টেশন থেকে বাসে করে যাওয়া যেতে পারে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। কুনমিং রেল স্টেশন থেকে ট্রেনেও যাওয়া যায় স্টোন ফরেস্ট। সময় লাগবে দু’ঘণ্টা। আর প্রাইভেট গাড়ি তো পাওয়া যায়ই সর্বত্র। একটু বেশি দক্ষিণা দিয়ে গাড়ি করেও পৌঁছে যাওয়া যায় স্টোন ফরেস্টের দোরগোড়ায়।

এই যাত্রাপথটি ভারি সুন্দর। রাস্তা এমন পরিচ্ছন্ন, এমন ঝকঝকে যে বালিশ-তাকিয়া নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যাওয়া যায়। আর দু’পাশে রয়েছে অসংখ্য চেরীব্লসমের রোমান্টিক ইশারা। যদি বসন্তর আগমনের সময় হয় সেটা। আমাদের রক্তিম পলাশের হুড়োহুড়ি দেখেছি পুরুলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে। সেও মন কেড়ে নিতে জানে। সেই রাঙাহাতছানি যেমন আমাদের মুগ্ধ হতে বাধ্য করে, তেমন এই চেরী ব্লসমের সৌন্দর্য অপূর্ব মান্যতা দিয়ে যায়।

আগেই বলা হয়েছে বাইরের যানবাহন ফরেস্টের ভেতরে প্রবেশ করে না। সেখানে রয়েছে ব্যাটারিচালিত গাড়ি। গাড়িগুলো এক কোচের টয়-ট্রেনের মতো দেখতে। মাথার ওপর ছাউনি আছে কিন্তু চারপাশটা খোলা। জোড়া-জোড়া কুড়ি সিটের এক একটা গাড়ি। এই গাড়ি কিছুটা ভেতর অবধি নিয়ে যাবে তারপর নির্দিষ্ট একটা জায়গায় নামিয়েও দেবে। স্টোন ফরেস্ট তোমাকে দেখতে হবে পায়ে হেঁটেই। স্টোন ফরেস্ট জাতীয় উদ্যান পরিদর্শনের সময় সকাল সাড়ে আট’টা থেকে সন্ধে ছ’টা। তারপর আর কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না। তার আগে বলে নেওয়া দরকার যে স্টোন ফরেস্টে ঢুকতে টিকিট কাটতে হবে। ব্যাটারী কার-এ চড়ার জন্যও আলাদা টিকিট লাগে। তবে ব্যবস্থাপনা নিখুঁত। টিকিট কাটার জন্য লাইন পড়ে কিন্তু সেই লাইন নিরন্তর চলমান। কোথাও দাঁড়িয়ে এতটুকু সময় নষ্ট হবে না।

আড়াইশো হাজার বছর (২৭০ মিলিয়ান ইয়ার্স) বয়সী এই অসাধারণ স্টোন ফরেস্ট গড়ে উঠল কি করে, সেটা সকলেরই জানতে ইচ্ছে হবে। প্রকৃতিরই অযাচিত খেয়ালে গড়ে উঠেছে মূলত লাইমস্টোনের তৈরি এই শত শত গুচ্ছ গুচ্ছ নাতিউচ্চ পাহাড়। যা একটু জায়গা জুড়ে বা কিছুটা জায়গা জুড়ে নয়। অনেক, অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাইলের পর মাইল। প্রকৃতির এই দাম্ভিক আত্মপ্রকাশ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

গাইড বলে, এরা নাকি একসময় জলতেলের নিচে ছিল। হয়তো তাই-ই ছিল। দৈর্ঘে-প্রস্থে অনেকটা পাথরে অংশ (লাইম স্টোন রকস) জলের ঘায়ে ঘায়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। জল সরে গেলে তারা যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন নিজের শরীরেই সংকোচন শুরু করে দেয় (কমপ্রেস)। আর সংকুচিত হতে হতে ভেঙে যেতে থাকে বা ফেটে যেতে থাকে (ফ্রাকচারড)। এর ফলে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি ভাবে ফাটল তৈরি হয়। বিশাল প্রস্তর খণ্ডের মধ্যে এই ফাটল দিয়ে অবাধ গতিতে জল তো ঢুকছেই কখনও কখনও বাতাসও ঢুকছে। ঘর্ষণ চলছে (ইরোথান) বছরের পর বছর ধরে। এইভাবে ফাটলগুলো বড় হতে হতে পাশাপাশি কতগুলো স্তম্ভ বা থামের (কলাম) আকার নিয়েছে। ধীরে ধীরে বিশাল প্রস্তরখণ্ডের মধ্যে নিজেরাই পিলারের মতো দেখতে হয়ে গেছে। জল সরে গিয়েছে। এরা তখন যে রূপ নিয়েছে, মনে হয়েছে আলাদা আলাদা পাথরের গাছ পরস্পর জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। চিনের এই স্টোন ফরেস্ট প্রকৃতপক্ষে কার্স্ট টোপোগ্রাফির এক অত্যাশ্চর্য উদাহরণ।

স্টোন ফরেস্টকে আকর্ষণীয় তোলার ব্যাপারে সরকারি তৎপরতাও লক্ষ্য করার মতো। ফরেস্টের ভেতর পায়ে চলা পথগুলো সুন্দর করে বাধিয়ে দেওয়া, কোথাও কোথাও রঙিন টাইলসও চোখে পড়বে। ব্যাটারিকার চলার জন্য কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা। পরিষ্কার, ঝকঝকে, মসৃণ। কোথাও একটা গাছের পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই দেখলে মনে হবে ধোয়ামোছা হয় নিয়মিত।

আর আছে অসংখ্য সুন্দর বাগান। বাগান জুড়ে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাস। অজস্র গাছ। নানা রূপে নানা আকর্ষণে। কোথাও ঝোপ ঝোপ (বুশ টাইপ) ধরনের। কোথাও লতানো। কোথাও নাতিউচ্চ লম্বায়মান। ফুলগুলো শুধু সুন্দর নয়, পাতাগুলোও সুন্দর। মন ভরিয়ে দেবে।

পথ চলতে চলতে দেখা যাবে নানা ভঙ্গিমায়— লম্বা, বেঁটে, মোটা-খাটো লাইমস্টোনের পাহাড়গুলো। কোথাও মনে হবে এই পাহাড়টা উঠতে উঠতে পা থেবড়ে বসে পড়েছে। কাউকে মনে হবে ঘুম পেয়েছে বলে ঘাসের মধ্যে গড়িয়ে পড়েছে। কোথাও তারা একা, কোথাও বা দোকা। এদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া যায়, হেলান দিয়ে ছবিও তোলা যায়। গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের কুশল প্রশ্নও করে নেওয়া যেতে পারে।

আর যেগুলো বড় বড়, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বা মিছিল করে চলেছে, তাদের দূর থেকে স্যালুট করে নেওয়ার ইচ্ছে জাগতে পারে। আবার অনেকের কাছেও যাওয়া যায়। লম্বা লম্বা পাহাড়গুলো দেখে মনে হবে ওখানে গেলে আমাদের পথ রুদ্ধ। আর ফেরা যাবে না। হয়তো বা হারিয়েই যেতে হবে। কিন্তু খুব কাছে গিয়ে দেখা যাবে সরু একটা পথ পাথরের বুকের মধ্য দিয়ে কিংবা হাতের মধ্য দিয়ে পাশের বাগানে গিয়ে পৌঁছেছে। হয়তো সেইপথ বাঁকাচোরা ঘোরানো, কুন্তলী পাকানো। কিন্তু পরিষ্কার আর ছমছমানিতে ভর্তি।
স্টোন ফরেস্টের কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে ছোট ছোট বাজার। ফল, ভূট্টাপোড়া বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। চারপাশের লম্বা লম্বা পাথর-প্রাচীরের মধ্যেখানে কোথাও চলেছে নাচের মহড়া। সঙ্গে বাজনাও আছে। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে সেই আনন্দের ভাগীদার হতে পারে পথচারী দর্শক।

পাথর দেখে দেখে পথ চলতে চলতে হঠাৎ সামনে এসে যাবে একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের খানিকটা উঠে তার পেছনে চলে যাওয়া যাবে। ভারি চমৎকার। আরও অবাক লাগে যখন বিশাল দুই পাথরগাছের পায়ের ফাঁকে পাথরের টেবিল আর চেয়ার সাজানো দেখা যায়। ক্লান্ত পথিক টেবল-চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে। মনুষ্য নির্মিত এই চেয়ার টেবিলে বসে যেন চায়ের অর্ডার দিয়ে দেয় না কেউ। কিছু তো নেই আর সেখানে। পাথরই পাথর।

স্টোন ফরেস্টের একটি খোলামেলা জায়গায় দেখা যাবে ছোট্ট একটা ভিড়। সেখানে পৌঁছলে স্থানীয় মেয়েদের দল পর্যটকদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেবে। ওদের কাছে রয়েছে সুন্দর সুন্দর চাইনীজ ড্রেস আর সাজিভর্তি ফুল। কয়েকজন ফোটোগ্রাফারও আছে ওদের দলে। হেসে হেসে ওরা আবদার করেই যাবে। কিন্তু ওদের ভাষা তো কিছুই বোঝা যাবে না। ওরাও বুঝবে না দর্শকদের ভাষা। তখন ওরা ইশারায় ওদের পোশাকে ফুলের সাজি নিয়ে পছন্দমতো পোজ দিয়ে ছবি তুলতে অনুরোধ করবে। আর ছবিগুলো ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলীভারি দিয়ে দেবে। আসলে এটা ওদের এক রকমের রুজিরোজগার। গাইড সঙ্গে থাকলে দরদাম করতে সুবিধা হবে। নিজের ক্যামেরা দিয়েও ছবি তোলা যাবে। তখন ওরা পোশাক আর সাজিভরা ফুলের ভাড়া নেবে শুধু। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওরা ডলার নেয় না। শুধু চাইনিজ় কারেন্সি অর্থাৎ য়ুয়ানেই দাম মেটাতে হবে। তাই পকেটে ইউয়ান মজুত রাখতে ভোলা চলবে না।

স্টোন ফরেস্টের প্রস্তরীভূত বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য দর্শককে সত্যিই অভিভূত করে দেয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বহুতল বাড়ির লাইন পড়ে গেছে যেন। মাঝের খাঁইউনেসকো তাকে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দিয়েছে। এই স্থানটির নাম হল স্টোন ফরেস্ট বা শিলিন।

কুনমিং হল অন্যতম গেটওয়ে অফ চায়না। সেই প্রবেশদ্বার দিয়ে যদি দক্ষিণ চিনে প্রবেশ করে যায় তাহলে যাওয়া যাবে য়ুনান প্রভিন্সে। যেখানে রয়েছে একটি অসাধারণ ট্যুরিস্ট স্পট। যাকে চিন তাদের দ্রষ্টব্য স্থানেখর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বর অর্থাৎ ‘ফাইভ-এ’ শিরোপা দিয়েছে। ইউনেসকো তাকে ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দিয়েছে। এই স্থানটির নাম হল স্টোন ফরেস্ট বা শিলিন। প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা এই প্রস্তর অরণ্য দেখতে সাগর, ভূখণ্ড আর পর্বতমালা পেরিয়ে দূর দূর দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে। কাছাকাছি জায়গা থেকেও দর্শনধারীরা নিয়মিত এসে পৌঁছয় এর দরজায়। এই স্টোন ফরেস্ট-এ খাওয়ার জন্য কয়েকটি উপায় আছে। কুলমিং এয়ারপোর্ট থেকে বাসে যাওয়া যায়। তাছাড়া কুনমিং ইস্ট বাস স্টেশন থেকে বাসে করে যাওয়া যেতে পারে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। কুনমিং রেল স্টেশন থেকে ট্রেনেও যাওয়া যায় স্টোন ফরেস্ট। সময় লাগবে দু’ঘণ্টা। আর প্রাইভেট গাড়ি তো পাওয়া যায়ই সর্বত্র। একটু বেশি দক্ষিণা দিয়ে গাড়ি করেও পৌঁছে যাওয়া যায় স্টোন ফরেস্টের দোরগোড়ায়।

এই যাত্রাপথটি ভারি সুন্দর। রাস্তা এমন পরিচ্ছন্ন, এমন ঝকঝকে যে বালিশ-তাকিয়া নিয়ে আড্ডা দিতে বসে যাওয়া যায়। আর দু’পাশে রয়েছে অসংখ্য চেরীব্লসমের রোমান্টিক ইশারা। যদি বসন্তর আগমনের সময় হয় সেটা। আমাদের রক্তিম পলাশের হুড়োহুড়ি দেখেছি পুরুলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে। সেও মন কেড়ে নিতে জানে। সেই রাঙাহাতছানি যেমন আমাদের মুগ্ধ হতে বাধ্য করে, তেমন এই চেরী ব্লসমের সৌন্দর্য অপূর্ব মান্যতা দিয়ে যায়।

আগেই বলা হয়েছে বাইরের যানবাহন ফরেস্টের ভেতরে প্রবেশ করে না। সেখানে রয়েছে ব্যাটারিচালিত গাড়ি। গাড়িগুলো এক কোচের টয়-ট্রেনের মতো দেখতে। মাথার ওপর ছাউনি আছে কিন্তু চারপাশটা খোলা। জোড়া-জোড়া কুড়ি সিটের এক একটা গাড়ি। এই গাড়ি কিছুটা ভেতর অবধি নিয়ে যাবে তারপর নির্দিষ্ট একটা জায়গায় নামিয়েও দেবে। স্টোন ফরেস্ট তোমাকে দেখতে হবে পায়ে হেঁটেই। স্টোন ফরেস্ট জাতীয় উদ্যান পরিদর্শনের সময় সকাল সাড়ে আট’টা থেকে সন্ধে ছ’টা। তারপর আর কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না। তার আগে বলে নেওয়া দরকার যে স্টোন ফরেস্টে ঢুকতে টিকিট কাটতে হবে। ব্যাটারী কার-এ চড়ার জন্যও আলাদা টিকিট লাগে। তবে ব্যবস্থাপনা নিখুঁত। টিকিট কাটার জন্য লাইন পড়ে কিন্তু সেই লাইন নিরন্তর চলমান। কোথাও দাঁড়িয়ে এতটুকু সময় নষ্ট হবে না।

আড়াইশো হাজার বছর (২৭০ মিলিয়ান ইয়ার্স) বয়সী এই অসাধারণ স্টোন ফরেস্ট গড়ে উঠল কি করে, সেটা সকলেরই জানতে ইচ্ছে হবে। প্রকৃতিরই অযাচিত খেয়ালে গড়ে উঠেছে মূলত লাইমস্টোনের তৈরি এই শত শত গুচ্ছ গুচ্ছ নাতিউচ্চ পাহাড়। যা একটু জায়গা জুড়ে বা কিছুটা জায়গা জুড়ে নয়। অনেক, অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাইলের পর মাইল। প্রকৃতির এই দাম্ভিক আত্মপ্রকাশ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

গাইড বলে, এরা নাকি একসময় জলতেলের নিচে ছিল। হয়তো তাই-ই ছিল। দৈর্ঘে-প্রস্থে অনেকটা পাথরে অংশ (লাইম স্টোন রকস) জলের ঘায়ে ঘায়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। জল সরে গেলে তারা যখন বাইরে বেরিয়ে আসে তখন নিজের শরীরেই সংকোচন শুরু করে দেয় (কমপ্রেস)। আর সংকুচিত হতে হতে ভেঙে যেতে থাকে বা ফেটে যেতে থাকে (ফ্রাকচারড)। এর ফলে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি ভাবে ফাটল তৈরি হয়। বিশাল প্রস্তর খণ্ডের মধ্যে এই ফাটল দিয়ে অবাধ গতিতে জল তো ঢুকছেই কখনও কখনও বাতাসও ঢুকছে। ঘর্ষণ চলছে (ইরোথান) বছরের পর বছর ধরে। এইভাবে ফাটলগুলো বড় হতে হতে পাশাপাশি কতগুলো স্তম্ভ বা থামের (কলাম) আকার নিয়েছে। ধীরে ধীরে বিশাল প্রস্তরখণ্ডের মধ্যে নিজেরাই পিলারের মতো দেখতে হয়ে গেছে। জল সরে গিয়েছে। এরা তখন যে রূপ নিয়েছে, মনে হয়েছে আলাদা আলাদা পাথরের গাছ পরস্পর জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। চিনের এই স্টোন ফরেস্ট প্রকৃতপক্ষে কার্স্ট টোপোগ্রাফির এক অত্যাশ্চর্য উদাহরণ।

স্টোন ফরেস্টকে আকর্ষণীয় তোলার ব্যাপারে সরকারি তৎপরতাও লক্ষ্য করার মতো। ফরেস্টের ভেতর পায়ে চলা পথগুলো সুন্দর করে বাধিয়ে দেওয়া, কোথাও কোথাও রঙিন টাইলসও চোখে পড়বে। ব্যাটারিকার চলার জন্য কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা। পরিষ্কার, ঝকঝকে, মসৃণ। কোথাও একটা গাছের পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই দেখলে মনে হবে ধোয়ামোছা হয় নিয়মিত।

আর আছে অসংখ্য সুন্দর বাগান। বাগান জুড়ে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাস। অজস্র গাছ। নানা রূপে নানা আকর্ষণে। কোথাও ঝোপ ঝোপ (বুশ টাইপ) ধরনের। কোথাও লতানো। কোথাও নাতিউচ্চ লম্বায়মান। ফুলগুলো শুধু সুন্দর নয়, পাতাগুলোও সুন্দর। মন ভরিয়ে দেবে।

পথ চলতে চলতে দেখা যাবে নানা ভঙ্গিমায়— লম্বা, বেঁটে, মোটা-খাটো লাইমস্টোনের পাহাড়গুলো। কোথাও মনে হবে এই পাহাড়টা উঠতে উঠতে পা থেবড়ে বসে পড়েছে। কাউকে মনে হবে ঘুম পেয়েছে বলে ঘাসের মধ্যে গড়িয়ে পড়েছে। কোথাও তারা একা, কোথাও বা দোকা। এদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া যায়, হেলান দিয়ে ছবিও তোলা যায়। গায়ে হাত বুলিয়ে তাদের কুশল প্রশ্নও করে নেওয়া যেতে পারে।

আর যেগুলো বড় বড়, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বা মিছিল করে চলেছে, তাদের দূর থেকে স্যালুট করে নেওয়ার ইচ্ছে জাগতে পারে। আবার অনেকের কাছেও যাওয়া যায়। লম্বা লম্বা পাহাড়গুলো দেখে মনে হবে ওখানে গেলে আমাদের পথ রুদ্ধ। আর ফেরা যাবে না। হয়তো বা হারিয়েই যেতে হবে। কিন্তু খুব কাছে গিয়ে দেখা যাবে সরু একটা পথ পাথরের বুকের মধ্য দিয়ে কিংবা হাতের মধ্য দিয়ে পাশের বাগানে গিয়ে পৌঁছেছে। হয়তো সেইপথ বাঁকাচোরা ঘোরানো, কুন্তলী পাকানো। কিন্তু পরিষ্কার আর ছমছমানিতে ভর্তি।

স্টোন ফরেস্টের কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে ছোট ছোট বাজার। ফল, ভূট্টাপোড়া বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। চারপাশের লম্বা লম্বা পাথর-প্রাচীরের মধ্যেখানে কোথাও চলেছে নাচের মহড়া। সঙ্গে বাজনাও আছে। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে সেই আনন্দের ভাগীদার হতে পারে পথচারী দর্শক।

পাথর দেখে দেখে পথ চলতে চলতে হঠাৎ সামনে এসে যাবে একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের খানিকটা উঠে তার পেছনে চলে যাওয়া যাবে। ভারি চমৎকার। আরও অবাক লাগে যখন বিশাল দুই পাথরগাছের পায়ের ফাঁকে পাথরের টেবিল আর চেয়ার সাজানো দেখা যায়। ক্লান্ত পথিক টেবল-চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারে। মনুষ্য নির্মিত এই চেয়ার টেবিলে বসে যেন চায়ের অর্ডার দিয়ে দেয় না কেউ। কিছু তো নেই আর সেখানে। পাথরই পাথর।

স্টোন ফরেস্টের একটি খোলামেলা জায়গায় দেখা যাবে ছোট্ট একটা ভিড়। সেখানে পৌঁছলে স্থানীয় মেয়েদের দল পর্যটকদের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দেবে। ওদের কাছে রয়েছে সুন্দর সুন্দর চাইনীজ ড্রেস আর সাজিভর্তি ফুল। কয়েকজন ফোটোগ্রাফারও আছে ওদের দলে। হেসে হেসে ওরা আবদার করেই যাবে। কিন্তু ওদের ভাষা তো কিছুই বোঝা যাবে না। ওরাও বুঝবে না দর্শকদের ভাষা। তখন ওরা ইশারায় ওদের পোশাকে ফুলের সাজি নিয়ে পছন্দমতো পোজ দিয়ে ছবি তুলতে অনুরোধ করবে। আর ছবিগুলো ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলীভারি দিয়ে দেবে। আসলে এটা ওদের এক রকমের রুজিরোজগার। গাইড সঙ্গে থাকলে দরদাম করতে সুবিধা হবে। নিজের ক্যামেরা দিয়েও ছবি তোলা যাবে। তখন ওরা পোশাক আর সাজিভরা ফুলের ভাড়া নেবে শুধু। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওরা ডলার নেয় না। শুধু চাইনিজ় কারেন্সি অর্থাৎ য়ুয়ানেই দাম মেটাতে হবে। তাই পকেটে ইউয়ান মজুত রাখতে ভোলা চলবে না।

স্টোন ফরেস্টের প্রস্তরীভূত বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য দর্শককে সত্যিই অভিভূত করে দেয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বহুতল বাড়ির লাইন পড়ে গেছে যেন। মাঝের খাঁজগুলো দেখে মনে হবে ওগুলো বোধহয় দরজা-জানলা। কারুকাজ করা লম্বালম্বি ভাঁজগুলো ঠিক যেন বারান্দা। এ যেন পাহাড় অথবা গাছ, গাছ কিংবা বাড়ি, বাড়ি কিংবা দানো। যতোই দেখা যাবে ততই অবাক লাগবে। আরও অবাক লাগে ওই পাথরের বাগানে ছোট ছোট সরোবরগুলো দেখলে। পাথর দেখার একঘেয়েমি কাটানোর জন্যই যেন সরোবরে ফুটে আছে সুন্দর সুন্দর পদ্মের মতো দেখতে অসংখ্য ফুল। আর সেই ফুলের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছ। সরোবরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎই খেয়াল হবে, সরোবরের সূটিক স্বচ্ছ জলের আয়নায় ফুটে উঠেছে স্টোন ফরেস্টের আস্ত প্রতিবিম্বখানি তার অসাধারণ গাম্ভীর্য আর ব্যপ্তি নিয়ে।

এত পাথরের কথা, এত প্রস্তরীভূত বৃক্ষবন্দনা, এত ভূতাত্বিক বিশ্লেষণ জানতে জানতে মনে হয়, এখানে কি শুধুই প্রকৃতির খামখেয়ালীর গল্প। হৃদয়ের উত্তাপে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে এমন মানুষের গল্প নেই এখানে? তাও আছে। চিনের একটি প্রাচীন লোকগাথায় আছে, স্থানীয় ঈ প্রজাতির মধ্যে অসীমা নামে এক সুন্দরী তরুণী ছিল। সে ভালবেসেছিল আহেই নামের এক তরুণকে। কিন্তু গ্রাম-সর্দারের ছেলে আজ়হী এদের ভালবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ঘটনাক্রমে অসীমার আর ঘর বাধা হয় না আহেই-এর সঙ্গে। ভালবাসার মানুষটিকে না পেয়ে দুঃখে পাথর হয়ে গেছিল অসীমা। গাইডকে অনুরোধ করলে তোমাকে দেখিয়ে দেবে অভিমামিনী প্রস্তরময়ী অসীমাকে। যে রয়েছে এই স্টোন ফরেস্টেই। এর পরেও কী কেউ চিনের অত্যাশ্চর্য ট্যুরিস্ট স্পট স্টোন ফরেস্ট না দেখে চিন থেকে চলে আসবে? চিনের একটি স্থানীয় প্রবাদ আছে— কুনমিং-এ এসে যদি স্টোন ফরেস্ট না দেখেই চলে যাও তাহলে তোমার সময়টাই বরবাদ। কথাটা যে কতখানি সত্য, দর্শকের স্টোন ফরেস্ট দেখার পরই প্রমাণিত হবে। তার আগে নয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com