বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৭ অপরাহ্ন

চর কুকরি মুকরি : বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও সৌন্দর্যের অনন্য ঠিকানা

  • আপডেট সময় সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরের কোলঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে চর কুকরি মুকরি। বাংলাদেশের অন্যতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত এই চরটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ। একসময় এই চরে শুধুমাত্র কুকুর ও ইঁদুরের দেখা মিলত। এ কারণেই এর নামকরণ করা হয় চর কুকরি মুকরি।

চরটির ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। প্রায় ৭০০ বছর আগে পর্তুগিজ জলদস্যুরা এই এলাকায় তাদের আস্তানা গড়ে তোলে। তবে একসময় চরটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ১৯১২ সালে এটি আবার জেগে ওঠে এবং পরবর্তীতে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে এটি দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র।

যাত্রা শুরুর গল্প

১৪ নভেম্বর রাতে ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। চলঘুরি নামের ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে ৩১ জনের বড় দল নিয়ে আমরা রওনা দেই। আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন ট্যুরমেট ছিল। কেবিন খালি না থাকায় আমরা রাত কাটানোর জন্য লঞ্চের ছাদ বেছে নিই।

বুড়িগঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় রাজধানীর চিরাচরিত ব্যস্ততা পেছনে ফেলে চাঁদের আলো আর নদীর নীরবতায় ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল মনোমুগ্ধকর। ভোর ছয়টায় আমরা বেতুয়াঘাটে পৌঁছাই। সেখান থেকে অটোরিকশায় প্রায় এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে কচ্ছপিয়া ঘাটে আসি। ঘাটে সকালের নাস্তা সেরে প্রায় আড়াই ঘণ্টার লঞ্চ যাত্রায় পৌঁছে যাই চর কুকরি মুকরিতে।

 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবেশ

লঞ্চ থেকে নামতেই চর কুকরি মুকরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন জয় করে। নদীর মাঝে চলমান ট্রলারের চারপাশে বিস্তৃত সবুজ বনভূমি, আকাশে উড়ে যাওয়া নানা জাতের পাখি, পাড়ের ম্যানগ্রোভের কিনারায় মহিষের পাল—সবকিছু মিলে এক সম্মোহিত পরিবেশ সৃষ্টি করে।

চরে বিচরণরত বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, বন্য মহিষ, বন মোরগ, শিয়াল, বানর, উদবিড়াল এবং বনের গরু। পাখিদের মধ্যে বক, শঙ্খচিল, কোয়েল, কাঠময়ূরসহ নানা প্রজাতি দেখা যায়। শীতকালে পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় প্রাণীদের কাছাকাছি দেখা কিছুটা কঠিন হলেও চরজুড়ে তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

নদীর পাশের নিরিবিলি পরিবেশ, বিশাল বালিয়াড়ি, আর ঢেউয়ের গর্জন চরটিকে যেন একটি মিনি সমুদ্র সৈকতে রূপান্তরিত করেছে। পাশের ম্যানগ্রোভ বনের বিস্তীর্ণ সবুজ গাছপালা এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য তৈরি করে।

সূর্যাস্তের মোহনীয়তা

ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন জায়গায় আমাদের তাঁবুগুলো গাড়া হয়। বিকেল বেলা তাঁবু থেকে বের হয়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করি। সূর্যের শেষ রশ্মি পশ্চিম আকাশে রূপালী আলো ছড়িয়ে দেয়। এ সময় প্রকৃতি যেন আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। একপাশে বিস্তীর্ন চর-নদী, বিপরীত পাশে জঙ্গল আর নদী কিনারায় ভেঙে- নুইয়ে পড়া বিভিন্ন গাছের শিঁকড়মূল যার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিকরে পরছিল অস্তাচলের শেষ রঙ অভাবনীয় সুন্দর।

রাতের তাঁবু ক্যাম্পিং

৩৪ জনের জন্য মোট ১৩টি তাঁবু ছিল। নির্জন এই পরিবেশে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ। ঘাটে সামান্য মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও প্রকৃতির নিস্তব্ধতা এবং জোছনার আলোতে সেই অভাব পূরণ হয়। আকাশজুড়ে তখন কার্তিক পূর্ণিমার বিশালযজ্ঞতা। জঙ্গল, নদী, চর-সমুদ্র পুরোটা জুড়ে অপরুপ জোছনার নরম আলোর খেলা। এই জোছনা সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী হবার, এই জোছনা পৃথিবীর সব কোলাহল থামিয়ে শরীরের কর্ণকুহর হয়ে মস্তিস্কে পৌঁছে সবটুকু উদ্বেল করার!

পর্যটকদের সুবিধা-অসুবিধা

চর কুকরি মুকরিতে থাকা-খাওয়ার সুবিধা সীমিত। পুরো এলাকায় মাত্র একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যা বড় দল সামলাতে হিমশিম খায়। দুপুরে জাউভাত আর লবণহীন মাংস দিয়ে কোনোভাবে খাবার সেরে নিই। যদিও এটি কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করে, তবে চরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।

চর কুকরি মুকরি ভ্রমণ প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণী, এবং নির্জনতার মেলবন্ধন এই জায়গাটিকে করে তুলেছে স্বপ্নের মতো একটি স্থান। এই দুইটা দিনের জন্য ধোঁয়া, ধুলো, নেটওয়ার্ক, ব্যস্ততা সব ভুলে ডুবেছিলাম রাতের উন্মাতাল জোছনায়, মুগ্ধতায় জড়িয়েছিলাম আকাশ, পাখি, নদী- চরের কাছে- সবুজ বনভূমির কাছে। ভালো থাকুক সবুজ দ্বীপ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি! নিবিড় ভালোলাগার অন্যতম চিরসবুজ প্রশান্তি চর কুকরি মুকরি!!

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com