চট্টগ্রামের মেজবান এর কথা শুনলেই যে কথাটি সবার আগে কানে ভাসে সেটি হচ্ছে – “মেইইজ্জান হাইলে আইয়ূন আঁরার শহর চট্টগামে”
যার অর্থ মেজবান খেতে হলে আসুন আমাদের শহর চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত কিছু বিষয় নিয়ে যদি কাউকে লিস্ট করতে দেয়া হয়, তবে সে লিস্টে “চট্টগ্রামের মেজবান” এর নাম নিঃসন্দেহে সবার প্রথমে চলে আসবে। কারণ চট্টগ্রামের মেজবান মানে আলাদা ট্রেডমার্ক। আর এই ট্রেডমার্ক সম্পর্কে শুনেননি বা জানেন না, এমন চাটগাঁইয়া (চট্টগ্রামের বাসিন্দা) খুব কমই আছে।
অনেকের ভ্রান্ত ধারণা চট্টগ্রামের মেজবান মানে হলো বিশেষ কোনো খাবার, যা গরুর মাংসের তৈরি।সত্যিকার অর্থে কেবল চট্টগ্রাম বাসীরা এর সঠিক মানে টা বলতে পারে। সাধারণত কেউ মারা গেলে “জিয়াফত”, “চল্লিশা”, “কুলখানি” এর খাবারের নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠান হিসেবে মেজবান কররা হয়। শুধু যে শোকের কারণে মেজবান করা হয় তা নয়। কেউ কেউ আকিকার সময় মেজবানের আয়োজন করে। এছাড়া ব্যক্তিগত সাফল্যেও অনেকে করে থাকেন। তবে সবথেকে বেশি প্রচলিত মৃত্যুর পর চল্লিশাতে মেজবান দেয়া। বলা বাহুল্য, সুখের হোক কিংবা দুঃখের উভয় কারণে,অনুষ্ঠান করে পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর নামই মেজবান।
“মেজবান” একটি ফারসি শব্দ। যার অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। চট্টগ্রামের ভাষায় একে বলে “মেইজ্জান”
মতান্তরে কেউ কেউ “মেজ্জান” ও লিখে থাকেন।
মেজবান বা মেইজ্জান প্রকৃতপক্ষে কোনো আলাদা শব্দ নয়। মেইজ্জান হলো মেজবানের একটি আঞ্চলিক রুপ। তাই চট্টগ্রামে কেউ যদি আপনাকে মেইজ্জান খেতে ডাকেন তাহলে বিভ্রান্ত হবেন না তিনি আসলে আপনাকে মেজবান খেতেই ডাকছেন। নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবান কে জেয়াফত বলে থাকে। ঢাকায় সাধারণত কুলখানি নামে এটি পরিচিত।
ঠিক কবে থেকে আসলে মেজবানের প্রচলন হয়েছে তা আসলে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, ১৫০০, ১৬০০ সালে মেজবানের প্রচলন পাওয়া যায়। কেননা কাব্যগ্রন্থে কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় মেজবান শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই “মেজমান” (আপ্যায়ন) এবং “মেজোয়ানি” (আপ্যায়ন কারি) দুটি শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা থেকে পরবর্তীতে “মেজবান” শব্দটি কালের পরিক্রমায় আসে।
এই মেজবান এতোটাই জনপ্রিয় যে, মেজবান কেবল এখন চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নয় তা চট্টগ্রামের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় যেমন আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামের বাইরে মেজবানি সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি। ঐতিহাসিক দলিল ঘাটলে জানা যায়, ষাটের দশকে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু করেন। চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি থাকাকালীন তাঁর অনুপ্রেরণায় তেজগাঁও বাবলী ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক প্রয়াত মোজাম্মেল হক ঢাকায় মেজবানির আয়োজন করেন। বর্তমানে ঢাকা সমিতির মেজবানে দেশের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা বলে এখনো খ্যাতি রয়েছে। তারা প্রতি বছর অর্ধ লক্ষাধিক লোকের খাবারের আয়োজন থাকে। সাতকানিয়া, রাউজান, বাঁশখালী, নোয়াখালী সিলেট খুলনা, ঢাকা, গোপালগঞ্জ সহ বিভিন্ন জায়গায় মেজবানের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে মেজবান কেবল দেশে নয় দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকায় ও উদযাপিত হয়।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মেজবানকে চট্টগ্রামের বাইরে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে গিয়ে অন্তত ২০ মতান্তরে ৩০ হাজার লোককে মেজবান খাওয়াচ্ছেন। এটা সাধারণত বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজন করে। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চসিক মেয়র মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এর প্রচলন শুরু করেন। রাউজান আসনের সাংসদ এ বি এম ফজলে করিমও টুঙিপাড়ায় মেজবানের আয়োজন করে আসছেন।
২০১৭ সালে চট্টগ্রামের নগরপিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর মহাপ্রয়াণে ১২টি কমিউনিটি সেন্টারে ৮০হাজার মানুষের জন্য মেজবান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এরমধ্যে রিমা কমিউনিটি সেন্টারে হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্যি, মেজবানে অংশ নিতে এসে পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছেন ১০ জন।
মেজবান যে খাবারের জন্য সব থেকে বেশি জনপ্রিয় তা হলো, বাবুর্চির হাতে রান্না করা গরুর মাংস। অন্যান্য জেলার গরুর মাংসের তুলনায় চট্টগ্রামের মানুষদের হাতে রান্না করা গরুর মাংসের স্বাদ আলাদা। তা ছাড়া গরু উৎপাদনের দিক দিয়ে ও চট্টগ্রাম পিছিয়ে নেই। মূলত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশসহ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে এ গরু উৎপাদন হয় বেশি। তবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা গরুর পরিবর্তে এখন ছাগল কিংবা মহিষ ও জবাই করেন মেজবান উপলক্ষে।
গরম সাদা ভাতের সাথে মেজবানী গরুর মাংস খাওয়ার পর ওর স্বাদ আলাদা করা বুঝা যায়।শুধু যে মেজবানে গরুর মাংস রান্না করা হয় তা নয়।এছাড়া মেজবানে পরিবেশন করা হয় নলা কাঁজী, যার অন্য নাম নিহারী।নিহারী কাঁজী, একটু হালকা টক স্বাদযুক্ত হয়।এর সাথে পরিবেশন করা হয়, ঘুনা ডাল কিংবা মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে রান্না করা গরুর হাঁড়ের মাংস।অনেক সময় এতে বুটের ডাল ও ব্যবহার করা হয়।এছাড়া থাকে, লাউয়ের তরকারি।তবে সব জায়গায় এটা করা হয় না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায়,পশ্চিম্বঙ্গের কলকাতার মানুষেরা একসময় এখানে আসতো। হিন্দু সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা চট্টগ্রামের মেজবান খেতে এসে বিপাকে পড়তেন। একসময় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফেনী জেলার জমিদার শমসের গাজী তার মা কোয়ারা বেগমের নামে একটি বড় পুকুর খনন করেছিলেন এবং সে উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করেছিলেন। এই ভোজের জন্য চট্টগ্রামের নিজামপুর এলাকায় প্রতিবেশী পুকুর হতে মাছ ধরে আনা হয়। হিন্দু ঐতিহ্যে তারপর থেকে মেজবান রান্নার সময় গরুর পরিবর্তে মাছ ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় প্রতি বছর “চট্টগ্রাম পরিষদ” ব্যানারের অধীনে মেজবানি আয়োজন করে, মাছ, সবজি এবং শুকনো মাছ থেকে তৈরি কারি দিয়ে।
মাটির শানকিতে মেজবানের খাবার পরিবেশন করা হলো এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মেজবানের দিন সকালে গরু জবাই করে বাবুর্চিরা সারি সারি ডেকচিতে মেজবানী গরুর মাংস রান্না করেন। মাংস রন্ধন প্রক্রিয়ায় কি কি মশলা ব্যবহার করা হয় তা একমাত্র বাবুর্চি জানেন।সাধারনত ২২ প্রকারের মসলা এতে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত রন্ধনের স্বাদের অকৃত্রিমতা রক্ষায় আসল মসলাগুলোর কথা তিনি তারা কাউকে জানান না। চট্টগ্রামের মেজবান গুলো সাধারণত দুপুরে আয়োজন করা হয়। তবে বর্তমানে বড় ক্লাবগুলোতে রাতে ও মেজবান হয়।
গীতিকার, সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন মেজ্যান দিএ শিরোনামে একটি গান লিখেছেন। ১৯৯৩ সালে ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া ও চট্টগ্রামের মেজবান নিয়ে একিটি ছড়া লিখেছেন। এছাড়া তরুণ লেখক রশীদ এনাম বর্তমান প্রজন্মের কাছে মেজবান সম্পর্কে তুলে ধরার জন্য “চাটগাঁইয়া মেজ্জান ” নামক একটি রম্যগল্প লিখেছেন। চট্টগ্রামের মেজবান কোথায় নেই। চট্টগ্রামে অবস্থিত ৫ তারকা হোটেল “র্যাডিসন ব্লু” এর একটি হলের নাম ও মেজবান হল।
রেস্টুরেন্টের মেজবানের খাবার আর বাবুর্চির রান্না করা মেজবানের মধ্যে আকাশ পাতালের ব্যবধান।
হাজার চেষ্টা করেও সেই অথেন্টিক স্বাদ টা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা আনতে পারেন না। হালে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট মেজবানের খাবারের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, চট্টগ্রামের মধ্যে সেইসকল রেস্টুরেন্ট হলো: মেজবান হাইলে আইয়ুন, জামান হোটেল (কোর্ট বিল্ডিং), ওরিয়েন্ট রেস্টুরেন্ট, বাঙালীয়ানা, ক্যাফে বায়েজীদ। ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোঃ চিটাগং বুল, প্রিয় মেজবান, মেজবান রেস্টুরেন্ট, ফ্লোরিশ রেস্টুরেন্ট, মেজবান রেস্টুরেন্ট এন্ড কাবাব ঘর। বর্তমানে চট্টগ্রামের মেইজ্জান হাইলে আইয়ূন ঢাকায় একটি শাখা খুলেছে।
একজন খাঁটি চাঁটগাইয়া হিসেবে শেষে দুটি কথা বলবো। খুব কম চাটগাঁইয়া আছে যারা গরুর মাংস পছন্দ করেন না। চট্টগ্রাম বিখ্যাত দুটি রান্না হলো মেজবান এবং কালো ভুনা। কিন্তু দিন দিন ভেজাল খাবারের সাথে সাথে বর্তমানে রান্না করা অথেনটিক মেজবানী স্বাদের গরুর মাংস হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই অথেন্টিক মেজবান স্বাদ টা পাই না এবং মেজবানের ঐতিহ্য ও ভুলে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংকট উত্তরণের জন্য, সকলের উচিত মেজবানের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা এবং ঐতিহ্যবাহী কিছু বাবুর্চি যারা অনেক বছর যাবৎ মেজবান খাইয়ে সুনাম পেয়েছেন। তাদের কথা সকলের সামনে তুলে ধরা।