শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১১ অপরাহ্ন

ঘুরে এলাম মালয়েশিয়া

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩
Portrait of beautiful woman at Chinese market

ঘুরে এলাম মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুর আর ঐতিহাসিক শহর মালাক্কা। আমাদের চার জনের দল নিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে। ডিসেম্বরের ভোর। ঘড়ির কাঁটা আমাদের থেকে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে। সবে সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ আর সোনালি রোদ্দুর, তেলের মতো মসৃণ চওড়া রাস্তা আর দুপাশে ঘন সবুজ রাবার গাছের বন, বাতাসে হালকা হিমের পরশ… এক মনোরম অনুভূতি। এর আগ ইউরোপে অনেক বড় বড় শহর ঘুরেছি।

কিন্তু কুয়ালা লামপুর না গেলে ধারণা করতে পারতাম না, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই শহর এত উন্নত। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, সুউচ্চ অট্টালিকা, ঝাঁ চকচকে শপিংমল, উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, উন্নততর জীবন ব্যবস্থা সব কিছুতেই আমাদের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। শহরটাকে এরা অসংখ্য ফ্লাইওভার দিয়ে ঘিরে রেখেছে।আমাদের প্রথম দিনের প্রথম গন্তব্য পেট্রোনাস টু-ইন টাওয়ার। এটা ২০০৪ পর্যন্ত পৃথিবীর উচ্চতম বাড়ি ছিল। পাশাপাশি সিলিন্ড্রিক্যাল আকৃতির দুটি ৮৮ তলার সুউচ্চ বাড়ি, ৪১ আর ৪২ তলায় একটা স্কাইব্রিজ দিয়ে জোড়া। টাওয়ারের মোট উচ্চতা ৪৫১.৯ মিটার।

আমাদের শহিদ মিনারের উচ্চতা ৪৮ মিটার। তুলনা করলে সহজেই উচ্চতার তফাৎটা বোঝা যাবে। দ্রুতগামী লিফ্ট আমাদের পৌঁছে দিল সেই ডেকে। ব্রিজের ডেক থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যেন প্লেনের জানলা থেকে নীচে দেখছি। দ্বিতীয় লিফ্ট ধরে আরও উপরে উঠলাম। উপরে একটা মার্বেলের তৈরি টাওয়ারের মডেলও রাখা আছে। নীচে নেমে এসে সুভেনির শপ থেকে কিছু কেনাকাটা করে, ফোটো তুলে বেরিয়ে পড়লাম কুয়ালা লামপুর টাওয়ার বা কে. এল. টাওয়ারের উদ্দেশে। এটাও পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ারগুলোর একটা। মোট উচ্চতা ৪২১ মিটার। সুউচ্চ টাওয়ারের ওপারে একটা গোলাকৃতির ডেক।

সেই ডেকে ঘুরে ঘুরে রাতের আলো ঝলমল কুয়ালা লামপুরের অপার ঐশ্বর্য চাক্ষুষ করা। এত উপর থেকে মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার হিরে আলোয় ঝকমক করছে। এখানেও অনেকগুলো সুভেনির শপ আছে। নেমে এসে হোটেল ফেরার পালা। রাতে সিফুড দিয়ে চৈনিক আহার সারলাম। শোওয়ার আগে সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে বাথটাবে হট বাথ নিয়ে আমার চোদ্দ তলার রুমের জানলার ভারী পরদাটা যখন সরিয়ে দিলাম, অবাক বিস্ময়ের পালা। আলোয় ঝলমল করছে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, কুয়ালা লামপুর টাওয়ার আর অসংখ্য সুউচ্চ হোটেল আর অট্টালিকা।

খাঁটি মালয় খাবারের সঙ্গে চিনা, তাই, কন্টিনেন্টাল, নর্থ ইন্ডিয়ান আর আর বাঙালি খাবার (বাংলাদেশি রেস্তরাঁয়) খাবার খেয়েই চারটে দিন কাটালাম। আর এখানে প্রচুর বাংলাদেশি, বাংলাভাষী। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, চচ্চড়ি, ভাজি, ভর্তা সবই পাওয়া যায়। সকালে হোটেল থেকে যে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দিত সেটাও অসংখ্য পদ, বুফে সিস্টেম, পর্যাপ্ত পরিমাণ। দ্বিতীয় দিনেও কুয়ালা লামপুর ঘুরলাম। ক্যাব সার্ভিস খুব ভাল। ভাড়াও বেশি নয়। মনোরেলও চড়লাম। গেলাম চায়না টাউন, চিনা মার্কেটে। দরকষাকষি করে কিনতে পারলে সস্তাতেই পাওয়া যায়। আর ঘুরলাম বুটিক বিনতাং, শহরের কেনাকাটার প্রাণকেন্দ্র। বহু বাংলাদেশি দোকানদার দেখলাম। কেনা কাটা যা কিছু করার সেরে নিলাম।

তৃতীয় দিনের গন্তব্য কুয়ালা লামপুর থেকে ১৪ কিমি দূরে “বাট্টু কেভ”। স্থানীয় বাতু নদীর নামানুসারে নামকরণ হয়েছে। “বাট্টু কেভ” হল “মুরুগান” বা কার্তিকের প্রতি উৎসর্গকৃত হিন্দু মঠ। বিদেশে তামিলদের অন্যতম পবিত্র ধর্মস্থল। সবুজ গাছে ঘেরা চুনা পাথরের পাহাড়। সামনে বিশাল চত্বর। তার উপর সার দিয়ে কিছু বাংলাদেশি সুভেনির শপ আর দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের দোকান। পাহাড়ের সামনে পাহাড়-প্রমাণ (১৪০ ফুট লম্বা) সোনালি রঙের “মুরুগান” বা কার্তিকের দণ্ডায়মান মূর্তি। পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। দেখলাম ৪/৫ রিঙ্গিতে রেনকোট বিক্রি হচ্ছে।

বৃষ্টি থামার পর পাহাড়ের গা বেয়ে ২৭২ ধাপ রামধনু রঙের সিঁড়ি পেরিয়ে ঢুকলাম গুহাতে। টুইন টাওয়ার, কে এল টাওয়ার আর আজ বাট্টু কেভ। কুয়ালা লামপুর আসার পর থেকে একের পর এক শুধু উঁচুতেই উঠছি। গুহার মুখটা তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও ছাদ অনেক উঁচুতে। গুহার ভিতরটা বিশাল একটা জালার পেটের মতো যার দুদিকে দুটো সরু মুখ। গুহার ভিতরে “মুরুগান”-এর মন্দির। চতুর্থ দিন আমাদের গন্তব্য ইতিহাসের শহর মালাক্কা। ইউনেস্কো ২০০৮ সালে মালাক্কাকে ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সিটি হিসাবে ঘোষণা করে। কুয়ালা লামপুর থেকে ১৪৫ কিমি, দু /আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। হোটেল থেকে পেটভৰ্তি ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম। মসৃণ রাজপথ। ক্রমশ আধুনিক শহর ছেড়ে পথের দু’পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে দশটা বাজার আগেই পৌঁছে গেলাম মালাক্কা। মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান শহর ও প্রাচীন সমুদ্রবন্দর।

ছবির মতো সাজানো। অনেকে এটাকে প্রাচ্যের ভেনিসও বলেন। প্রাচীন বন্দর হওয়ার কারণেই বহুদিন ধরেই আরব, চিন, ভারতীয় নাবিকদের যাতায়াত ছিল এখানে। ১৫১১ সালে আসে পর্তুগিজরা। এক সময় সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে আসেন। মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য তাঁকে এখানে সমাহিত করে রাখা হয়। পর্তুগিজদের পরে ওলন্দাজরা মালাক্কা দখল করে। মাঝে অল্প কিছুদিনের জন্য ব্রিটিশরাও এটাকে দখল করে। বারবার শাসক পরিবর্তন হাওয়ায় মালাক্কায় একটা মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

প্রথমেই আমরা নামলাম এক বিশালাকায় কাঠের নৌকার সামনে। জনশ্রুতি এই নৌকাটাই নাকি প্রথম মালাক্কা বন্দরে এসেছিল। নৌকায় উঠলাম।নাবিকের কেবিনটাও এখনও খুব সুন্দর করে সাজানো আছে। মালাক্কায় বেশ কয়েকটা ছোট ছোট মিউজিয়াম আছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্রাচীন বন্দর, (যার ভগ্নাবশেষ এখনও অবস্থিত),পর্তুগিজদের তৈরি প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ (এখনও কিছু কামান দেখলাম), দুর্গের পাশেই টিলার ওপর প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন, সেন্ট পলস চার্চ, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের মূর্তি সমুদ্র মিউজিয়াম, প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। ইতিহাস যেন একটা সময়ে এসে থমকে গিয়েছে। আর দেখলাম পর্যটকদের জন্য পদে পদে দোকানিদের পসরা। স্থানীয় কাঠের তৈরি জিনিস, জামাকাপড়, সুভেনির থেকে শুরু করে খাবারদাবার পর্যন্ত কী নেই! মালাক্কায় রিকশগুলো দেখলাম খুব রংবেরঙের আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। ঘুরলাম মালাক্কা সিটিসেন্টার।

বিকালবেলায় ফেরার পালা। রাতের বিমানের টিকিট। কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। চারটে দিন স্বপ্নের মতো কেটে গেল। চড়ে বসলাম কলকাতাগামী বিমানে। মনের মধ্যে থেকে গেল অনেক ভাল লাগার মুহূর্ত। বিদায় মালয়েশিয়া।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com