আমরা জয়পুর যেতে চাই, এটা শুনেই কেন যেন নির্মা ভার্সিটির ছেলেপেলে খুব খুশী হয়ে উঠলো। আসলে গুজরাতের এই ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই রাজস্থানের, ওখানে ভালো প্রতিষ্ঠান থাকার পরও এখানে কেনো আসে জানি না।
সাড়ে তিনশো রুপীর নরমাল সিটিং টিকেট কেটে আমাদের বাসে উঠিয়ে দিলো রাহুল বিকেল পাচটায়। দূরত্ব সাড়ে ছয়শো কিঃমিঃ, সময় লাগবে ষোল ঘণ্টা। ভারতের ট্র্যান্সপোরট সিস্টেমে সবচেয়ে খারাপ জিনিস হলো এই বাস। ট্রেনের টিকেট না পাওয়ায় আমরাও শুরু করলাম এই কষ্টযজ্ঞ।
অদ্ভুত সব পাহাড়ী বাক আর উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে আহমেদাবাদ থেকে জয়পুর পৌছাতে আমাদের সময় লাগলো সতেরো ঘণ্টার কিছু বেশি। আকাশে চাঁদ ছিলো উজ্জ্বল – দুর্দান্ত সব পাহাড় দেখে কেমন যেন একটা রাজপুত রাজপুত ফিলিং চলে আসলো মনের মাঝে। চেনা জায়গা (শুধু নামটা জানি !!!) ক্রস করেছি বলতে উদয়পুর আর আজমীর। বেশ কিছু যাত্রী আজমীরে নামলেন। মুসলিম গুজরাত থেকে জয়পুরের যাত্রীর চেয়ে আজমীরের যাত্রী বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
সকাল দশটায় আমরা নামলাম জয়পুরে। শহরে ঢোকার মুখেই বিশাল ক্যান্টনমেন্ট। রাজপুত সামরিক শক্তির কথা স্মরণ হলো আবার। কৌশলগত কারণেও দিল্লীর নিরাপত্তার জন্য জয়পুর একটা বড় ঘাটি। বাসস্টপ থেকে এক মুসলমান অটোওয়ালা (সাব্বির চাচা) তুলে নিলো আমাদের, ড্রপ করলো এক মুসলমান হোটেলেই।
উইকিট্র্যাভেল আর ব্লগ ঘেটেঘুটে যা শিডিউল ছিলো আমার, তাতে একদিনেই মোটামুটি কভার করা যাবে বড় স্পটগুলো। আমাদের সময়ের টানাটানি, পকেটে পয়সারও টানাটানি। সাব্বির চাচা মারফত তার ভাতিজা সালিম হাজির হলো ইন্ডিকা ভি-২ নিয়ে। চোস্ত ইংরেজি বলে, দিব্যি স্মার্ট কিন্তু দেখে মনে হয় কলেজ পেরোয়নি। সারাদিন সব ঘোরাঘুরি ১০০০ রুপী নেবে, তাছাড়া পাহাড়ী পথে অটো বা অন্য কিছু চলবেও না। টুক করে আমরা উঠে পড়লাম।
আলবার্ট হল – জয়পুর ন্যাশনাল মিউজিয়াম
প্রথমে রাজা জয় সিংহ স্কোয়ার। জয়পুর শহরের স্থপতিকে একবার দেখে নিয়ে আমরা ছুটে চললাম জয়পুর ন্যাশনাল মিউজিয়ামে, যেটাকে আলবার্ট হল বলা হয়। মিউজিয়ামটার রেলিক্স সবই রাজপুত সম্পর্কিত, মুঘল-রাজপুত কানেকশনের কিছু বিষয়ও তুলে আনা হয়েছে। আর আছে একটা মমি। এই জিনিস আগে কখনো দেখিনাই, তাই লাল পাগড়ী পরা দারোয়ান ঘেউ ঘেউ করার আগেই ক্লোজ থেকে আমরা ছবি টবি তুলে পগারপার !!!
সালিম বুদ্ধি দিলো ইন্ডিয়ান টিকেট কিনতে, তাতে পাচগুণ খরচ কমে যায় কারণ বিদেশী নাগরিকদের টিকেটের দাম সেইরকম। হিন্দি ভাষার জ্ঞানের যে অবস্থা, ভয়ে ভয়ে কাউন্টারে গেলাম। ওদের একটা প্যাকেজ আছে, একই টিকেটে ছয়-সাতটা স্পটের প্যাকেজ। ইন্ডিয়ান টিকেট তো নিলামই, আবার তার মধেয়ো সস্তাতর স্টুডেন্ট প্যাকেজটা নিলাম। আমাদের আর পায় কে !!!
শহরের সিটি স্কোয়ারের দিকে যতই এগোচ্ছি, ভুরু ততই উপরে উঠছে। সব গোলাপী, সব গোলাপী। আসলে পিঙ্ক সিটি নামটা বজায় রাখার জন্য এরা মনে হয় বাধ্যতামূলকভাবে বাসা-বাড়ী আর মার্কেটে গোলাপী রঙ লাগায়। ঢুকলাম সিটি প্যালেসে। রাজস্থানের বর্তমান রাজামশাই এখানেই বসবাস করেন।
এই গেট দিয়ে ঢুকলাম, ভিতরের কান্ড-কাহিনী দেখে চোখ টেরিয়ে গেলো !!!
সিটি প্যালেসের দিওয়ান-ই-খাসঃ যাকে বলা যায় খাস মহল
দিওয়ান-ই-খাসঃ গঙ্গাজল রাখবার এই রুপোর জালাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিলভার পট
রাজামশাইয়ের প্রাইভেট গ্যারাজের সন্ধান পেলাম !!! ঘোড়ায় টানা গাড়ীও যে এতো ব্রান্ডের আছে তা কে জানতো ?
এই পাগড়ীওয়ালা রাজপ্রহরীদের সাথে সবাই দেখি ছবি তোলে। সারোয়ার ভাই একটা চান্স নিলেন !
রাজপ্রাসাদের ঝলকানি থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম রাজা মানসিংহের অমর কীর্তি………. যন্তর -মন্তরে। এইসব বিশাল বিশাল স্ট্রাকচার দিয়ে কিভাবে মহাকাশ গবেষণা আর তারার গতিপথ মাপা যায়, রাজপুত বিজ্ঞানীরা ভালো জানেন। সমগ্র ভারতে এরকম তিনটা যন্তর-মন্তর আছে, এখানে একটা, দিল্লীতে একটা আর আরেকটা সম্ভবত আগ্রায়। সবকটাই রাজা মান সিংহ তৈরী করে যান।
এটার হাইট সম্ভবত একশো ফুট। সূর্যঘড়ি টাইপের কিছু হবে।
তারার গতিপথ মাপতে ব্যবহার হয় এটি।
এটার কাজ যাই হোক, ফটো শ্যুট করতে ভালোই লাগে
এখানে থেকে বেরিয়ে আমরা আসলাম হাওয়া মহলে। আমার জানামতে মুসলমানদের বাইরে এই রাজপুতরাই মহিলাদের জন্য কঠোর পর্দাপ্রথা চালু করেছিলো, সাথে সাথে জওহরব্রত টাইপের জিনিস তো ছিলোই।
এই হাওয়া মহল ছিলো এক্সক্লুসিভলি রাজ পরিবারের মহিলাদের জন্য। সাত-আট তলা উচ্চতার পুরো জিনিসটায় জানালা আছে প্রায় ন’শো !!! অসাধারণ বায়ুপ্রবাহ, আর সাথে এখানে বসে রাজ্যের লোক-জন, কাজকর্ম দেখবার সুযোগ।
আমাদের পরের স্টপ আম্বর দুর্গ। প্রথমবারের মত কোন রাজপুত দুর্গে যাচ্ছি, ভেবেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। বিশাল পাহাড়ের উপর দুর্দান্ত কেল্লা, চারিদিকে গভীর পরিখা কাটা আর পানি থৈ থৈ করছে। টুং টাং ঘন্টা বাজিয়ে বিশাল বিশাল হাতি ঘুরছে রাস্তায়। ৯০০-১০০০ রুপীতে হাতির পিঠে চড়িয়ে দুর্গে নিয়ে যাবে মাহুত। টাকা কি গাছে ধরে নাকি……………… !!!
যা হোক, প্রথমবারের মত কোন রাজপুত দুর্গে যাচ্ছি, ভেবেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। বিশাল পাহাড়ের উপর দুর্দান্ত কেল্লা, চারিদিকে গভীর পরিখা কাটা আর পানি থৈ থৈ করছে। টুং টাং ঘন্টা বাজিয়ে বিশাল বিশাল হাতি ঘুরছে রাস্তায়। ৯০০-১০০০ রুপীতে হাতির পিঠে চড়িয়ে দুর্গে নিয়ে যাবে মাহুত। আমাদের সালিম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে একেবারে কেল্লার টপে হাজির করালো। এখানে একটা কার পারকিংও আছে। আমরা চললাম আম্বর কেল্লা দেখতে।
নাম শুনে মনে হয় মুসলমান কেল্লা, কিন্তু আম্বর নামটি রাখা হছে আম্বা নামের এক দেবীর নামানুসারে।
পানির পরিখা – মুসলিম, হিন্দু আর রাজপুত স্থাপত্যের অপূর্ব মিশ্রণ এই আম্বর কেল্লা।
আম্বর কেল্লা। ষোড়শ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন রাজা মানসিংহ।
কেল্লার মূল ফটক
দুর্গের মূল মন্দিরে যাবার সিড়ি
গম্বুজগুলো মুঘল স্থাপত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।
শীষ মহল – কাচ আর আয়নার টুকরোয় ঘেরা এই প্রমোদভবন যোধা-আকবর মুভির কারণে সবাই চেনে !!!
কেল্লার তলদেশে ঢুকে একটা সুড়ঙ্গের সন্ধান পেয়ে আমরা হেটে চললাম………… কিছুদূর গিয়েই সেটা আটকে দেয়া !!!
মনে হচ্ছিলো আমরা হেলিকপ্টারে :p :p দুর্গের ছাদের পাচিল থেকে তোলা ছবি
পাহাড়ের উপর অজেয় জয়গড় দুর্গ। ঐ দুর্গটা নাকি কখনো কারো দ্বারা বিজিত হয়নি। তবে সময়ের অভাবে ওই দুর্গটা আমাদের দেখা হয়নি ।
এরপ সালিম আমাদের নিয়ে আসলো স্যুভেনির শপে। এরকম গাড়ী রিজার্ভ করে ট্যুরিস্ট হিসেবে ঘুরলে এই এক ভ্যাজাল। দোকানের যা কিছু আছে সব কিছুর অসাধারণত্ব আর গুণগান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। সারোয়ার ভাই একটা ষোলশ রুপীতে নাগরা কিনে নিলেন, খাটি উটের চামড়ায় তৈরি নাকি!!! দাম শুরু ১০০০ রুপী থেকে, উপরে যত যাওয়া যায়। আর যে ড্রাইভার এরকম দোকানে ট্যুরিস্ট নিয়ে আসবে, সেই লোক কিছু কিনলে ড্রাইভার কমিশন পাবে তার ৫%। এই দোকানে আনার কারণে এখন সালিম পাবে আশি রুপী !! জিনিসগুলো আমরা আস্তে আস্তে বুঝেছিলাম।
আম্বর কেল্লার ছাদ থেকে পাহাড় ঘেরা জয়পুরের ল্যান্ডস্কেপ
চীনের প্রাচীর নয়, এ হলো রাজপুত প্রাচীর !!!
এরকম হাতি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় রাস্তায়। দরদাম করে চড়ে বসলেই হলো !!!
জল মহল – মান সরোবরের (মানস সরোবর নয়!!) কোলে রাজপুত প্রমোদ ভবন। তবে শীতকালে নাকি লেকটি শুকিয়ে যায়।
ট্র্যাভেল হেল্প –
কোলকাতা থেকে প্রায় প্রতিদিনই জয়পুরের ট্রেন আছে। হাওড়া-যোধপুর এক্সপ্রেস কিংবা শিয়ালদা-আজমীর এক্সপ্রেস ভালো ট্রেন। সময় লাগবে ২৪-২৫ ঘন্টা, ভাড়া এসি টু -টিয়ারে ১৮৪০ রুপী, থ্রি টিয়ারে ১১৭৫ রুপী আর নন এসি স্লীপারে ৪৩৮ রুপী। আর দিল্লী থেকেও অনেক ট্রেন আছে, সময় লাগবে চার ঘন্টা। শতাব্দী এক্সপ্রেসটা জনপ্রিয়, ভাড়া পড়বে এসি চেয়ারে ৪৬৫ রুপী, এক্সিকিউটিভ ১০০০ রুপী। আর দিল্লী থেকে বাসেও আসা যায়, ৬-৭ ঘন্টা সময় লাগবে। ভাড়া এসি ভলভোতে ৬০০ রুপী, নন-এসি লোকাল টাইপের বাসে ২৫০ রুপী (আমরা এটাতে করেই দিল্লী গিয়েছিলাম)। জয়পুরের বাসস্টান্ডের নাম সিন্ধি ক্যাম্প, এখান থেকে দিল্লী, আগ্রা’র বাসও পাবেন আবার যোধপুর, জয়সলমীর বা আজমীরের বাসও পাবেন। তবে ভারতে চলাচলের জন্য অবশ্যই ট্রেন প্রেফারেবল, ফরেইন ট্যুরিস্ট কোটায় টিকেট কাটার সুযোগ রয়েছে।
জয়পুরের সাধারণ রাস্তার মাঝেও এরকম স্থাপত্য শৈলী অহরহ চোখে পড়ে
জয়পুর স্টেশনের আশেপাশেই হোটেল পাবেন। এছাড়াও বাণী পার্ক কিংবা মতিলাল আট্টাল রোডে প্রচুর হোটেল আছে। আমরা তিনজন মাঝারী মানের হোটেলে একরাত ছিলাম সাতশো রুপী দিয়ে। খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে রাজপুতরা ভেজিটেরিয়ান, সেটা ধাতে সইলে তো ভালোই আর তা নইলে শহরের পুরনো অংশে (জায়গাটার নাম মনে হয় মুহাম্মদবাগ) পাবেন হাজারো বিরিয়ানীর দোকান, অনেকটা পুরনো ঢাকার মত। ভারতে খাবার-দাবারের দাম অস্বাভাবিক কম।
হাতুড়ি শাবল গাইতি চালায়ে কাটিল যারা পাহাড়……………
ঘোরাঘুরির জন্য একদিন বা দুইদিনই যথেষ্ট যদি সারাদিনের জন্য গাড়ী নিয়ে নেন, হাজারখানেক রুপী পড়বে ডেইলি। টাটা সাফারি বা ইন্ডিকা ভি-২ নিয়ে ঘুরতে পারবেন। টিকেটের ক্ষেত্রে একটা কম্পোজিট টিকেট আছে, আম্বর ফোরট – যন্তর মন্তর – হাওয়া মহল – আলবার্ট হল – নাহারগড় কেল্লা, এই পাচটা স্পটের টিকেট ইন্ডিয়ানদের জন্য ৫০ রুপী, বিদেশীদের জন্য ৩০০ রুপী। ছাত্রদের জন্য হাফ, আর এই টিকেটের মেয়াদ দু’দিন অর্থাৎ দু’দিনের মধ্যে স্পটগুলো ঘুরতে হবে। ঐ পাচটা স্পটের যে কোনটার টিকেট কাউন্টারেই কম্পোজিট টিকেট পাওয়া যায়। আলাদা আলাদা করে ঘুরলে কোনটার ২০ রুপী, কোনটার ৩০।
থর মরুভূমির দেশ রাজস্থানে উট চলবে না তাই কি হয় !!!
এছাড়া সিটি প্যালেস আর জয়গড় দুর্গ, এ দুইটির জন্য ৩০০ রুপীর টিকেট, যার মেয়াদ এক সপ্তাহ। এখানে ক্যামেরা পারমিট নেয়া লাগতে পারে, আরও ৫০ রুপী খসবে।
সময় করে ঘুরে আসুন মান সিং, জয় সিং আর যোধা-আকবরের এই জয়পুর।