গ্রিসে অবস্থানরত ১৫ হাজার বাংলাদেশিকে বৈধতা দিতে এবং দেশটির কৃষিখাতে প্রতিবছর চার হাজার মৌসুমি কর্মী আনার লক্ষ্যে গত বছর দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয়৷
আলোচিত এই নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়াটি চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। চলমান এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ তথ্য জানতে ইনফোমাইগ্রেন্টস কথা বলেছে গ্রিসের আশ্রয় ও অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রনালয় এবং বাংলাদেশ দূতাবাস এথেন্সের সঙ্গে৷
ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির আগে থেকে গ্রিসে বসবাস এবং বৈধতার পর চাকরি পাবেন সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার কাছ থেকে এমন একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দেয়ার শর্তে নিবন্ধিত হচ্ছেন গ্রিসের অনিয়মিত বাংলাদেশিরা।
নিবন্ধিত তিন হাজার
গ্রিসের আশ্রয় ও অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রেস অফিস ইনফোমাইগ্রেন্টসকে ২১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছে,
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দূতাবাস এথেন্সের সহায়তায় তিন হাজারেরও বেশি অনিয়মিত বাংলাদেশি গ্রিসের আশ্রয় ও অভিবাসন মন্ত্রানালয়ের ওয়েবসাইটে প্রাক নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
যদিও দূতাবাস জানিয়েছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ছয় হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি বৈধতার জন্য অনলাইনে প্রাক নিবন্ধন করেছেন।
নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের যাচাই বাছাই সম্পন্ন হয় সেটি ব্যখ্যা করে মন্ত্রনালয় জানায়, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ দূতাবাস গ্রিস বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে আমাদের তথ্য দিয়ে থাকে৷ পরবর্তীতে আমরা এসব তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেগুলো মন্ত্রনালয়ের ডিজিটাল পরিষেবায় স্থানান্তর করে থাকি। সম্পূর্ন প্রক্রিয়াটি অনলাইনে কোনো জটিলতা ছাড়াই সম্পন্ন হচ্ছে।”
নিয়মিতকরণের এই প্রক্রিয়াটি ১১ জানুয়ারি থেকে ১৮০ দিন অর্থ্যাৎ আগামী জুন মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রনালয়। তবে সমঝোতা চুক্তির আওতায় ১৫ হাজার ব্যক্তির আবেদনের শর্ত পূরণ না হলে আবেদন প্রক্রিয়া আরও ১৮০ দিন বাড়ানো হতে পারে৷
বাংলাদেশ দূতাবাস গ্রিসের মিনিস্টার মোহাম্মদ খালেদ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, প্রক্রিয়া শুরুর পর কারিগরি জটিলতার কারণে ওয়েবসাইটে সমস্যা হওয়ায় আবেদন প্রক্রিয়ার সময়সীমা বাড়তে পারে।
গ্রিক মন্ত্রনালয় জানায়, “অনলাইনে বৈধতা প্রক্রিয়া শেষ করার পর একজন অভিবাসীর রেসিডেন্স পারমিট পেতে গড়ে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাজের চাপ ও জনবলের ওপর নির্ভর করে এই সময়সীমা কম বা বেশি হতে পারে।
প্রত্যাখাত একজনের আবেদন
যারা আবেদন করছেন তারা সবাই কী বৈধতা পাবেন কিংবা কী কী কারণে একজন অভিবাসীর আবেদন বাতিল হতে পারে সেটি আশ্রয় ও অভিবাসন মন্ত্রনালয়ের কাছে জানতে চায় ইনফোমাইগ্রেন্টস।
মন্ত্রনালয় জানায়, জনস্বার্থ ও জননিরাপত্তার হুমকি হতে পারে এমন ব্যক্তিদের আবেদন বৈধতার জন্য বিবেচনায় নেয়া হবে না। এছাড়া বসবাসের অনুমতি পেতে মিথ্যা ও জাল নথি এবং অন্য কোনো উপায়ে প্রতারণার আশ্রয় নিলে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। ইতিমধ্যে একজন ব্যক্তির আবেদন জননিরাপত্তার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
সম্ভাব্য নিয়োগকর্তার কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র জমা দেয়ার শর্ত পূরণ করা না হলেও আবেদন বাতিলের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে৷
আবেদনের খরচ
বৈধতা পেতে অভিবাসীদের বড় কোনো খরচের কথা উল্লেখ না থাকলেও ৭৫ ইউরো বা সাড়ে সাত হাজার টাকা এককালীন ফি ধার্য্য করা হয়েছে। যেটি অনলাইন প্লাটফর্মে আবেদনের জন্য প্রযোজ্য।
ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাওয়া অভিবাসীদের রেসিডেন্স কার্ড পেতে গ্রিক কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত ১৬ ইউরো ফি দিতে হবে৷
শর্ত প্রত্যাহারের সুযোগ নেই
নিয়মিতকরণের আওতায় বৈধ হওয়া অভিবাসীদের তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার শর্ত রয়েছে। এই শর্ত প্রত্যাহারের সুযোগ আছে কী-না মন্ত্রনালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
মন্ত্রনালয় ব্যাখ্যা সহকারে জানিয়েছে, সমঝোতা স্মারক চুক্তিটি (এমওইউ) গ্রিক শ্রমবাজারের চাহিদা এবং উপযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তা ও চিকিৎসা মানদণ্ড অনুযায়ী অভিবাসীদের কৃষি ও অন্যান্য খাতে কাজের সুযোগ তৈরি করবে। এটি মানুষকে গ্রিসে আসতে, জীবিকা নির্বাহ করতে এবং বৈধভাবে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবে।
প্রদত্ত রেসিডেন্স পারমিট দিয়ে একজন অভিবাসী গ্রিসে স্থায়ী অভিবাসী হতে পারবেন না। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর গ্রিসে বৈধভাবে কাজ করতে পারবেন।
এটি একটি অস্থায়ী ওয়ার্ক-রেসিডেন্স পারমিট। সুবিধাভোগীরা প্রতি বছর তিন মাসের জন্য তাদের মূল দেশে ফিরে যেতে বাধ্য থাকবে, জানায় মন্ত্রনালয়।
এথেন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সমঝোতা স্মারক চুক্তি বাংলাদেশ ও গ্রিসের মধ্যে নির্দিষ্ট শর্তাবলিসহ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশ এবং গ্রিসের দাবি ও প্রত্যাশার রূপরেখা দিয়ে একে অপরকে সহযোগিতার জন্য উভয় পক্ষের সদিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়। সমঝোতা স্মারকে বর্ণিত কোনো শর্ত প্রত্যাহার করার কোনো সুযোগ নেই।
বৈধ অভিবাসনের সুযোগ
গ্রিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই সমঝোতা স্মারকের লক্ষ্য অবৈধ অভিবাসন রোধ করা। যার সাহায্যে ইউরোপের বাইরে থেকে আসা তৃতীয় দেশের নাগরিকেরা একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং নিরাপদ উপায়ে ভ্রমণ করার সুযোগ পাবে। তাদের আর মানবপাচারকারীদের অর্থ দিতে হবে না এবং নতুন করে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না।
“অভিবাসীরা বৈধ হলে তাদের দেশ বা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হারানোর মতো অচলাবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না। তাদের এখানে কাজ করার, পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অর্থ উপার্জন করার এবং তারপর নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এই সমঝোতা স্মারকটিতে শুধু বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর চার হাজার নাগরিকেরা আসার পাশাপাশি ১৫ হাজার অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধভাবে কাজের অনুমতি দেবে”, ব্যাখ্যা করে মন্ত্রনালয়।
এথেন্সের মতে, এটা স্পষ্ট যে যারা পরবর্তীতে গ্রিসে অনিয়মিত উপায়ে আসবেন এবং অনথিভুক্ত হিসেবে বসবাস করবেন তারা একই স্তরের সুরক্ষা উপভোগ করবেন না। যারা এই চুক্তির অধীনে থাকবে শুধুমাত্র তারাই সুরক্ষা পাবেন।
বাংলাদেশে দূতাবাস গ্রিসের মিনিস্টার মোহাম্মদ খালেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশিরা গ্রিসে অনিয়মিত অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন। এই প্রক্রিয়া বৈধ অভিবাসনের নতুন দ্বার উন্মোচন করে অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করবে।
গ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব
মোহাম্মদ খালেদ আরও বলেন, অভিবাসীরা বৈধ হলে তারা আগের চেয়ে আরও উন্নত ও পর্যাপ্ত উপায়ে গ্রিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এটি দুই দেশের জন্য কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে। অনিয়মিত অভিবাসন কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের চলমান পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় সার্বিকভাবে আমরা এই সমঝোতা চুক্তিটি বাস্তাবয়ন করতে সফল হয়েছি।
তার মতে, গ্রিসে অনিয়মিত অভিবাসীদের সংখ্যা অনেক। এখানে পাকিস্তান, মিশর, আফগানিস্তান ও আফ্রিকান দেশগুলো থেকে আসা বিপুল অভিবাসীরা অনিয়মিত অবস্থায় আছে। সে হিসেবে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি না হলেও আমরা একটি চুক্তির মাধ্যমে বৈধতার সুযোগ দিতে পেরে আনন্দিত।”
গ্রিক মন্ত্রনালয়ের মতে, গ্রিক অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোর মধ্যে কৃষি, পর্যটন এবং নির্মাণ খাত অন্যতম। কৃষি খাত প্রতি বছর মৌসুমী শ্রমিক সংকটের সম্মুখীন হয়। এই ঘাটতিগুলি একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে।
এথেন্স জানায়, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রিস তৃতীয় দেশের নাগরিকদের আরও আকৃষ্ট করতে চায়। কৃষি খাত থেকে শুরু করে মৌসুমী কর্মসংস্থানে অস্থায়ীভাবে কাজ করার জন্য বৈধভাবে আমাদের দেশে আসার সুযোগ রয়েছে৷ আমরা জনসংখ্যাকে শহর থেকে সরিয়ে নিতে চাই৷ কারণ কৃষি কাজগুলো প্রধানত গ্রামীণ এলাকায় হয়ে থাকে। এটি স্থানীয়দের সহায়তা করবে।
ডিটেনশন সেন্টারে অবস্থানরতদের পরিস্থিতি
গ্রিসের মেনিদি ক্যাম্পসহ অনেক ডিটেনশন সেন্টারে অবস্থানরত অভিবাসীরা ইনফোমাইগ্রেন্টসের কাছে জানতে চেয়েছেন তারা এই প্রক্রিয়ায় বৈধতার জন্য আবেদন করতে পারবেন কি-না।
এ ব্যাপারে গ্রিক কর্তৃপক্ষ জানায়, মন্ত্রনালয়ের এখতিয়ারের অধীনে রয়েছে এমন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা এমওইউ-এর বিধানের অধীনে বৈধতা সুযোগ নিতে পারবেন। কিন্তু তারা যদি হেলেনিক পুলিশের প্রাক-অপসারণ কেন্দ্র বা ডিটেনশন সেন্টারে ডিপোর্টের অপেক্ষায় থাকেন, সেক্ষেত্রে গ্রিসের অভিবাসন এবং আশ্রয় মন্ত্রণালয় তাদের আবেদন যাচাই করতে পারবে না। কারণ অভিবাসীদের আটকের এবং আইনি কাঠামোর বিষয়টি অন্য দপ্তরের অধীনে ন্যস্ত রয়েছে।
এছাড়া যেসব বাংলাদেশিরা কোনো প্রকার পাসপোর্ট ছাড়া অতীতে গ্রিসে প্রবেশ করেছেন তারাও বৈধতাঁর সুযোগ নিতে পারছেন না বলে নিশ্চিত করেছেন দূতাবাসের মিনিস্টার মোহাম্মদ খালেদ।
তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাদের অতীতে কখনও বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল না তারা দেশে ফেরত গেলে তারপর পাসপোর্ট দেয়া হবে। এক্ষেত্রে অনেক অভিবাসীরাই বৈধতার সুযোগ নিতে না পারে হয়তো আফসোস করতে পারেন। এটি দুঃখজনক। কিন্তু সীমাবদ্ধতার কারণে দূতাবাসও সমাধান দিতে পারছে না।