বৈধ কাগজ নেই, তাই চাইলেই সরকার নির্ধারিত কাজ করতে পারেন না অভিবাসী শ্রমিকেরা৷ এই সুযোগ কাজে লাগান গ্রিসের কৃষি খামারের মালিকেরা৷ মধ্যসত্বভোগী মাস্তুরাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা দিন দিন আরো বেড়ে চলেছে৷
গ্রিস-বাংলাদেশ চুক্তি কি এর সমাধান করতে পারবে?
গ্রিসে উৎপাদিত স্ট্রবেরির ৯০ শতাংশই আসে এই অঞ্চল থেকে৷ প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে উৎপাদনে হয় রেকর্ড৷ এমনকি করোনা মহামারিতে যখন পর্যটন থেকে শুরু করে অন্য সকল খাত বিপর্যস্ত, তখনও স্ট্রবেরি খামার দেখেছে বিপুল লাভের মুখ৷
গ্রিক অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অব ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড জুসেস এর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালেও আগের বছরের তুলনায় স্ট্রবেরি উৎপদান বেড়েছে প্রায় আট দশমিক দুই শতাংশ৷ এ বছরের প্রথম ছয় মাসে স্ট্রবেরি উৎপাদন হয়েছে ৭০ হাজার ৩১৯ টন, যা আগের বছর ছিল ৬৪ হাজার ৯৬২ টন৷
কিন্তু এ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি যে অভিবাসী শ্রমিক, তাদের ভাগ্যে উন্নয়ন তো ঘটেইনি বরং হতাশা ও অনিশ্চয়তা আরো বেড়েই চলেছে৷
মাস্তুরা ও মালিক: সস্তা শ্রম, শ্রম শোষণ
১৫-১৬ বছর আগেও স্ট্রবেরি খামারের শ্রমিকরা আসতেন মূলত পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন আলবেনিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিশর থেকে৷ কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইরান-তুরস্ক হয়ে বাংলাদেশিরা বিপুল সংখ্যায় গ্রিসে আসতে শুরু করেন৷ পূর্ব ইউরোপের দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের তুলনায় এই অনিবন্ধিত, কাগজপত্রবিহীন শ্রমিকদের বেতন কম দিতে হয়৷ ফলে এখন এসব খামারে বাংলাদেশিদেরই আধিক্য৷
মহাদেশীয় ইউরোপের শ্রমিকদের যেখানে সাত-আট ঘণ্টার এক কর্মদিবসে ৩৫-৪০ ইউরো (চার হাজার টাকা) দিতে হতো, বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেটি ১২ ঘণ্টায় ২৫-৩০ ইউরোতে (তিন হাজার টাকা) নেমে এসেছে৷
তবে এই ৩০ ইউরোর পুরোটাও আসে না শ্রমিকদের পকেটে৷ গ্রিসের এই কৃষিখামারগুলোতে শ্রমিক সরবরাহের জন্য মালিকেরা নির্ভর করেন গ্রিক ভাষা জানা মধ্যসত্বভোগী মাস্তুরাদের ওপর৷ এই মাস্তুরারা নিজেরাও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী৷ তবে দীর্ঘদিন গ্রিসে থেকে কৃষিব্যবসা সম্পর্কে এরা ধারণা লাভ করেছেন, জানেন গ্রিক ভাষাও৷ ফলে শ্রমিকদের কাজ পাওয়া না পাওয়া অনেকটাই নির্ভর করে এই মাস্তুরাদের ওপর৷
পরিত্যক্ত গুদামের এক বাসিন্দা মোহাম্মদ সাগর ডয়চে ভেলেকে জানান, এই ‘বাসস্থানটি’ নয়ন নামের এক মাস্তুরা নিয়ন্ত্রণ করেন৷ সাগর বলেন, ‘‘দিনে ৩০ টাকা রোজগার হলে সেখান থেকে তিনি এক টাকা কেটে রাখবে, আপনাকে ২৯ টাকা দিবে৷ এটা তার সঙ্গে চুক্তি৷ মাসে কয়দিন কাজ করলেন, তার ওপর নির্ভর করে তাকে সে টাকা দিতে হবে৷ মাসে ১০ দিন ডিউটি হলে তাকে দিতে হবে ১০ টাকা৷’’
এটিই শেষ নয়৷ শ্রমিকেরা কোথায় থাকবেন, সেটি মালিক ঠিক করে দিলেও মাস্তুরা সেখানে বাস করা শ্রমিকদের কাছ থেকে ভাড়া নেন৷ এমনকি মাস শেষে যখন নিজের ভাগের কমিশন কেটে রেখে শ্রমিকদের বেতন দেয়া হয়, সেখান থেকেও ব্যাংক ফি এর নামে শতকরা তিন টাকা কেটে রাখেন মাস্তুরা৷
সাগর বলেন, ‘‘আমি যদি ১০০ টাকা বেতন পাই, তাহলে ৬০-৭০ টাকা আমার কাছে আসতে পারে৷ ৩০-৪০ টাকাই তার কাছে চলে যায়৷
তাহলে মাস্তুরাকে এত টাকা না দিয়ে সরাসরি খামার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ নিচ্ছেন না কেন শ্রমিকেরা? আজিজুর রহমান নামের আরেক অভিবাসী জানালেন, শ্রমিকেরা একসঙ্গে কোথাও বাস করেন না৷ ফলে তাদের পক্ষে ৫০ জন শ্রমিক চাইলেই একদিনে জোগাড় করা সম্ভব নয়৷ বিভিন্ন এলাকায় এমন মাস্তুরাদের অধীনে চাইলেই একসঙ্গে অনেক শ্রমিক পাওয়া যায়৷ ফলে মালিকেরা তাদের সঙ্গেই চুক্তি করেন, মাস্তুরা শ্রমিকদের কত টাকা দিচ্ছে, কত টাকা কেটে রাখছে, এ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে চান না৷
পুলিশ কি এ বিষয়ে জানে না? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? শ্রমিকেরা কি চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না? আজিজুর বলেন, ‘‘আমাদের তো কাগজ নেই৷ আমরা তো পুলিশের কাছে যেতে পারি না৷ আমাদের যদি কাগজ থাকতো, তখন আমরা এদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী দেখতে পেতাম কত ঘণ্টা কাজ করবো, কত টাকা বেতন পাবো৷ এখন তো কাগজ নাই৷ এখন পুলিশের কাছে গেলে উলটো আমাদেরই বলবে, তোমরা কিভাবে কাজ করো! তোমার কি অনুমতি আছে কাজ করার?’’
কেবল ভার্দা গ্রাম না, কৃষি খামারে মাস্তুরা ছাড়া কাজ করাই সম্ভব না বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন আরেক অভিবাসী৷ মাস্তুরাদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে বলে জানান তিনি৷ ফলে কোথাও এক মাস্তুরার সঙ্গে ঝামেলা করে সরাসরি মালিকের সঙ্গে দেখা করে কাজ চাইলে পরবর্তীতে অন্য কোথাও আর কাজ না পাওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ ফলে বাধ্য হয়ে মাস্তুরার সব শর্ত মেনে তার সরবরাহ করা বাসস্থানেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন অভিবাসী শ্রমিকেরা৷
শ্রমিকদের নেই মৌলিক অধিকার
নেয়া মানোলাদায় এক অভিবাসী ডয়চে ভেলের সঙ্গে দেখা করে তার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন৷ হবিগঞ্জের মো. আব্দুল হামিদ ভারত থেকে আফগানিস্তান-ইরান হয়ে, তুরস্ক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাঁচ বছর আগে পৌঁছান গ্রিসে৷ ইরানেই পাসপোর্ট এবং অন্য সকল পরিচয়পত্র ফেলে আসেন তিনি৷ কিন্তু এই পাঁচ বছরেও নতুন করে কোনো কাগজ পাননি৷ বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে নিজের পাসপোর্ট বা গ্রিস কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো কাজের বা বসবাসের অনুমতি না পেয়ে পাঁচ বছর ধরেই এক পরিচয়বিহীন জীবন কাটছে তার৷
আঙুর ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় ডান চোখে আঘাত পান আব্দুল হামিদ৷ কিন্তু মাস্তুরা বা মালিক, কেউই তাকে চিকিৎসা পেতে সাহায্য করেননি৷ হাসপাতালে গেলেও বৈধ কাগজ না থাকায় পাননি পর্যাপ্ত চিকিৎসা৷ এখন ডান চোখে প্রায় কিছুই দেখেন না তিনি৷ দৃষ্টিশক্তি না থাকায় এখন পাচ্ছেন না কোনো ভালো কাজও ৷ এত কিছুর পরও কি তিনি দেশে ফিরতে চান না? উত্তরে আব্দুল হামিদ বলেন, ‘‘১৫-১৬ বছর বিদেশ থেকে আমি জীবন গড়তে পারিনি, এখন কিভাবে দেশে যাই? এসেছিলাম ভালোর জন্য, এখন সব খুইয়ে এভাবে দেশে যেতে বলছেন?’’
গ্রিস-বাংলাদেশ চুক্তি ‘আশার আলো’ নাকি ‘ছলনা’
বাংলাদেশ থেকে বছরে চার হাজার কর্মী নেয়ার ব্যাপারে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ও এথেন্সের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়৷ ইউরোপীয় কোনো দেশের সঙ্গে এমন সমঝোতা এই প্রথম৷ এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী গ্রিসে প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি বাস করেন৷ এদের অর্ধেকেরই বৈধ কাগজপত্র নেই৷ এই সমঝোতার আওতায় গ্রিসে বাস করা প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশিও বৈধতা পেতে পারেন৷
গ্রিসের মানবাধিকার কর্মী এবং এরই মধ্যে গ্রিসে বাস করা কাগজবিহীন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ভুগছেন দ্বিধায়৷
ডয়চে ভেলের কাছে অনেক অভিবাসীই জানিয়েছেন তাদের উদ্বেগের কথা৷ এথেন্সের কেন্দ্রে কয়েকটি সড়ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসস্থান৷ অনেকেই এটিকে ‘বাংলা গলি’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকেন৷ সেখানে বাংলা গলি নামেই একটি মুদির দোকান পরিচালনা করেন জামালউদ্দীন সরদার৷ ২২ বছর ধরে গ্রিসে বাস করা এই অভিবাসীর এখনও চিরস্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলেনি৷ ডয়চে ভেলের কাছে তিনি তার উদ্বেগ তুলে এভাবে, ‘‘সবাই এটা (চুক্তি) গ্রহণ করছে না এজন্য যে আমাদের এটায় আখেরে কোনো ফল নাই, ভবিষ্যত নাই৷ এরা কোনো রেসিডেন্স পারমিট দিচ্ছে না আপনাকে৷ আমাদেরকে প্রথমে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাগজ দিয়েছে৷ ওই কাগজ কেটে দিয়েছে ১০ বছর৷ সেটা কেটে দিয়েছে তিন বছরের কাগজ৷ এইভাবে চললে তো মানুষ ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হবেই৷’’
সরকার পরিবর্তন হলেই গ্রিসের অভিবাসন নীতিও বদলে যায়, এমন বক্তব্য উঠে এসেছে অনেকেই বক্তব্যেই৷ অভিবাসীদের বক্তব্য, যেখানে গ্রিসেই হাজার হাজার বাংলাদেশি এখনও বৈধ কাগজ পাননি, সেখানে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়ে আসার চুক্তি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য৷ বরং তারা মনে করছেন, অবৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ একবার এই চুক্তির আওতায় পাঁচ বছর পর কোনো শ্রমিক আবার গ্রিসে কাজ করার অনুমতি পাবেন না৷ তারা গ্রিসে স্থায়ী বসবাসের আবেদনও করতে পারবেন না৷ ফলে বছরের পর বছর গ্রিসে বাস করে এখন চুক্তির আওতায় পাঁচ বছর পর দেশে ফেরার এই শর্ত বেশিরভাগ অভিবাসীই মেনে নিতে পারছেন না৷
গ্রিসে বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী মানবাধিকার সংস্থা কেরফার সমন্বয়ক পেত্রোস কনস্তানতিনো মনে করেন, এমন চুক্তির ফলে শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা আরো বেশি খর্ব হবে এবং এ খাতের দুর্নীতি আরো বেশি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের চুক্তিকে আমরা দাসত্বের চুক্তি বলছি৷ বাস্তবে এটা কোনোভাবেই অভিবাসীদের বৈধতা দেয়া না৷ যদি বৈধতা দিতে হয়, তাহলে তাদের বসবাসের অনুমতি দেয়া হোক৷ কেবল কৃষি এলাকায় না, পুরো গ্রিসে অবাধে বসবাস ও চলাচলের অনুমতি দেয়া হোক৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এটা দাসত্বের চেয়েও বড় কিছু৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম তিন ভিত্তির একটি চলাচলের স্বাধীনতা৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর অনেকটাই খর্ব করেছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মানোলাদায় শ্রমিক নিয়ে আসবেন, কারণ কোনো এক মালিক আপনাকে নয় মাস কাজ করাতে চায়, তারপর আপনাকে ফেরত চলে যেতে হবে৷ এটা কোনোভাবেই শ্রমিকদের স্বাভাবিক স্বাধীনতা হতে পারে না৷ কোনো ট্রেড ইউনিয়নই এটা মানতে রাজি না৷’’
এই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে কেরফাসহ একাধিক মানবাধিকার এবং শ্রমিক সংগঠন৷ শিগগিরই এ নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি এবং ধর্মঘটেরও পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে সংগঠনগুলো৷
ডয়চে ভেলে