সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২১ অপরাহ্ন

গ্রামের নাম বাংগুরী

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

কবি ফিরে আসতে চান বারবার এমন এক গ্রামে, যেখানে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে শিমুলের ডালে, সন্ধ্যার বাতাসে ওড়ে সুদর্শন, সবুজ করুণ ডাঙা জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা থাকে। পায়ে লাল ঘুঙুর পরা কিশোরী হয়ে কলমীর গন্ধভরা জলে ভাসতে ভাসতে হাঁস হতে চান কবি।

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের মতো এমন করে যেই গ্রাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও মন ভুলিয়ে দিত আজ আমরা তেমন এক সুনসান নীরব গ্রামের কথাই বলব। যেখানে প্রকৃতি তার সকল সুন্দর নিয়ে বসে আছে পরিব্রাজকের মন জোগাতে।

ছুটিতে পারিবারিক বন্ধু ও স্বজনদের নিয়ে নতুন করে গ্রাম ঘুরে দেখার সাধ হতে পারে আপনার। তাহলে আপনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাংগুরী গ্রামে যেতে পারেন। ঢাকার ধামরাই উপজেলা ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা সহোদরা গ্রাম। যেই গ্রাম প্রতিটি মৌসুমে প্রকৃতির রূপ বদলের সাক্ষী হতে নিজের রং-রূপও বদলে নেয় দারুণভাবে। বৈশাখে আম্রমুকুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা গ্রাম সাজে কৃষ্ণচূড়ার লালে। মাঠ সবুজ হয়ে ওঠে বোরো ধানের সবুজে। শীতে সেই মাঠ পরে সরষের হলুদ শাড়ি। সেই হলুদ বসন থেকে বাতাসে ভেসে আসে সুগন্ধ। সেই সময় কোনো এক অচিন পরিব্রাজকেরও ইচ্ছে করে ওই হলদে জমিনে লুটিয়ে পড়ে ভোরের শিশিরভেজা সরষে ফুলের রেণু মাখতে।

এখনকার রূপ ভিন্নতর। সময়টা ভাদ্রের শরৎ হলেও বর্ষা এখনো প্রকৃতিকে ছেড়ে যায়নি। চারদিকে জল থই থই। রাস্তাঘাট জলের নিচে। মাঝির বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে চলল নৌকো চিরচেনা গ্রামের দিকে। অর্ধডুবন্ত বাড়িঘরের সম্মুখে খড়ের গাদা, তার পাশেই জল ছুঁই ছুঁই গরুর গোয়াল, পাশেই যোগাযোগের বাহন কোষা নৌকা। নয়নজুড়ানো এমন দৃশ্য দৃষ্টির আয়নায় আসতেই মগজজুড়ে ছেলেবেলা ভিড় করে। বর্ষার ভরা জলে কবি বন্দে আলীর মিয়ার ‘আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান/ আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ/ মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি/ চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি!’-ছড়া কাটতে কাটতে দিনমান ডুবসাঁতারে চোখ লাল করে ফেলার পর সন্ধ্যায় মায়ের বকুনিতে আনন্দের করুণ সমাপয়েন।

আমরা দুপুরের রোদ্দুর মাথায় করে যাচ্ছি। গরম কাটিয়ে দিচ্ছে জল ছুঁয়ে আসা শীতল হাওয়া আর রৌদ্রতাপ ঢেকে রাখছে মাঝির দেওয়া কাঠের ডাটওয়ালা পুরোনো আমলের বড় ছাতা। এদিক-সেদিক চলছে শৌখিন জেলেদের বাহারি জালে মৎস্য আহরণ। ত্রিকোণ আকৃতির বেহাল জাল অথবা চৌকোণের চড়ক জাল হাত বা পায়ের চাপে জল থেকে তুলতেই রুপালি মাছেদের দাপাদাপি-লাফালাফি। যার জালে যত বেশি মাছ, তার হাসি তত চওড়া। বর্ষার জলে ঘুরবেন আর দেশজ মিষ্টি পানির এমন মৎস্য আহরণ দেখবেন না তা তো হয় না। চাইলে এই গ্রামে ঢোকার পথেই মাথাভাঙ্গা বিলের পাশের কোনো এক বাড়িতে অর্ডার দিয়ে কাচালঙ্কা সহযোগে ফুটি, মলা, খলসে, কই, টেংরা, মেনি, কাকিলা বা বড় রুই-কাতলার মুচমুচে ভাজাও খেয়ে নিতে পারবেন।

এখানে প্রকৃতিও দারুণভাবে ধারণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ রং। বর্ষার জলসুধায় সেজে ওঠে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। জেলের নৌকার ছইয়ে থাকে উদীয়মান সূর্যের লাল রং। আর এভাবেই জনপদে আঁকা হয়ে যায় আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।

এই গ্রামে প্রকৃতি তার রূপ দেখানোয় বড় উদার ও প্রেমময়। বর্ষার সবুজ আর শরৎ মেঘের মেলবন্ধন দেখতে চাইলে ছুটতে হয় এমন গ্রামের স্বর্গেই। আর কণ্ঠে তখন নিশ্চয় অনুরণন তুলবে নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’-

দীর্ঘ পাঁচ বছর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি

সেই একই ভাঙাপথ, একই কালো মাটির আল ধ’রে গ্রামে ফেরা

আমি কতদিন পরে গ্রামে ফিরছি।

এমন মনোমুগ্ধকর গ্রাম যেখানে কান পাতলেই মেলে বাতাসে আন্দোলিত গাছের শব্দ, ভাটিতে জল বয়ে চলার শব্দ, মেঘের গর্জন, পাখপাখালির ডাক। এসবের মিলিত শব্দ সংগীত হয়ে বাজে পরিব্রাজকের কর্ণকুহরে। আর দৃষ্টি জুড়ায় অসীম আকাশ। স্বচ্ছ সফেদ জলরাশি ও শস্য সবুজে গ্রামীণ মানুষের যাপিতজীবন দেখতে হলে  এই গ্রাম একবার হলেও দেখা চাই।

আমরা তো বহু ব্যয় করে বহু ক্রোশ দূরে পর্বতমালা ,পাহাড়, ঝরনা, সমুদ্র, হাওর, নদী বা প্রত্নতাত্তিক স্থাপনা দেখতে দেখতে যাই। এবার না হয় শহরের চার দেয়ালে বন্দি হাপিয়ে ওঠা জীবন থেকে মুক্তি পেতে একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশুর বিন্দু দেখতেই বাংগুরীর মতো গ্রামে ফিরে যাই। এমন গ্রাম রবিঠাকুরের মতো করে পায়ে ধরে আপনাকে ঘরের বাহির না করে পারে? তাহলে কবি জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ থাকল ভ্রমণপিপাসু আপনাকেও

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com