মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৯ অপরাহ্ন
Uncategorized

গোয়ার রঙিন সমুদ্রসৈকত

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২

গোয়ার সমুদ্রসৈকতের এক অনন্য বৈশিষ্ঠ্য আছে। এ যেন এক উচ্ছল জীবনের প্রতীক, উৎসবের আমেজ, বিলাসিতার প্রকাশ। আনন্দের জোয়ার গা ভাসালেন মৌমিতা ঘোষ।

সমুদ্র পাহাড়ের অদ্ভুত মেলবন্ধন গোয়ার মতো ভারতবর্ষে খুব কম জায়গাতেই রয়েছে। মহাভারতে গোয়াকে ‘গোপরাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যার অর্থ গরুদের রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গোয়াকে অপরান্থ বলা হত। আপনার মন যখন শহরের কংক্রিটের জঙ্গল অস্থির হয়ে উঠেছে, যখন মন চাইছে একটু ব্যাতিক্রমী একটা সকাল, একটা ঘোরালাগা দুপুর , নেশাময় রাত, হুল্লোড় গান, পার্টি তবে ব্যাগ প্যাক করে চলে আসুন গোয়া। এখানে সোনালি চুল মেলে রূপসী সৈকত শুয়ে আছে তার ময়াময় শরীর নিয়ে আপনার অপেক্ষায়। রাতে তার উম্মত্ত যৌবন রঙ লাগায়- পাবে, আগুন লাগায় ডান্স ফ্লোরে, মিউজিকে। আপনার জীবনকে রঙিন করে দেওয়ার প্রতিশ্রতি হাতছানি দেয় গোয়া সুন্দরী। মুম্বই থেকে শতাব্দী এক্সপ্রেস পৌঁছলাম মারগাঁও স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে গোয়া।

আমরা বেশ ক’টি বিচ রিসর্ট ঘুরে কালাঙ্গুটেকেতে একটায় উঠলাম। সেখানে বেশ বড় একটা সুইমিং পুল আছে। রাতে পাশের বার কাউন্টার থেকে বেশ জোরে মিউজিক শুনতে শুনতে সুইমিং পুলে বসে পছন্দের পানীয়তে চুমুক দেওয়া যায়। পৌঁছানোর পর একটু ঘুম দিয়ে আমরা গেলাম বিচে। কালাঙ্গুটে হল গোয়ার সবচেয়ে র্দীঘ সৈকত। গোয়ার সৈকতগুলো রানি হল কালাঙ্গুটে। এখানে ওয়াটার ষ্পোর্টদের ব্যবস্থা আছে। বিচের ধারেই মারমেড বলে একটি হোটেল। ওখানে অসাধারণ সব সি-ফুড পাওয়া যায়-আর র্দুদান্ত সব ককটেল। আমার ফেভারিট পানীয়তে প্রায় মজে ছিলাম তিন-চার দিন। আপনি এরকম শ্যাক বা হোটেল প্রচুর পাবেন গোয়ার সব বিচেই। এক রকম রিল্যাক্স করে সমুদ্র তীরে বসে কেটে গেল প্রথম দিন সন্ধেটা। পরের দিন বাইক নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। গোয়ার বৈশিষ্ঠ্য হল নানা রকমের সমুদ্র সৈকত। আজ নর্থ গোয়ার তিনটে সমুদ্র সৈকত দেখব আমরা। কেরিম বিচ হল গোয়ার সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত টিরাকোলঅ ফোর্টের ধারের একটি সৈকত। সমুদ্রের ধারের পুরনো, পরিত্যক্ত পর্তুগিজ দুর্গ ও সতেরোশো শতাব্দীর শান্ত একটি গির্জা নিয়ে এই সৈকত যেন ধ্যানমগ্ন মৌনী তাপস। আবার এই রূপই বদলে যায় যখন সন্ধে ছ’টার সময় সারি সারি মাছধরা নৌকা ভিড় করে এসে দাড়াঁয় সমুদ্রে যাওয়ার জন্য। তারা একে একে সমুদ্রের বুকে মিলিয়ে যায়, ফিরে আসে পরদিন বিকেলে।প্যারাগøাইডিং- এর সুযোগ আছে এই সৈকতে।

নর্থ গোয়ার অন্যতম ছবির মতো সুন্দর সৈকত হল আরামবোল সৈকত। এক দিকে জেলেদের গ্রাম, এক দিকে পাহাড় চূড়া, আর তার নীচে এই যুবতী সৈকত- মায়া ধরাবে আপনাকে। আমার যেন ঘোর লেগে। এই সৈকতেই সারে সারে ‘হিপি’ রা শুয়ে মাড-বাথ নিচ্ছে দেখলাম। এই বিচ রঙিন হয়ে ওঠে রাত্রের পার্টিতে। এই সৈকতই হল গোয়ার হিপি সংস্কৃতির পাঠস্থান। ফিরে এলাম হোটেল। সন্ধেবেলায় সবাই মিলে গেলাম ‘ডি বাগা ডেক’। বাগা বিচের ধারে জাহাজের আদলে রেস্তোরাঁয় বসে থাকা মানে প্রায় জাহাজের ডেকে বসে খাওয়ার স্বাদ পাওয়া। ভিতরে ডান্স ফ্লোর আছে। খান, তরলে চুমুক দিন, নাচুন- অথবা এক্কেবারে চুপ করে বসে থাকুন, সবটাই মজা। ডি বাগা ডেকের পাশেই আরও নাইট ক্লাব আছে। কাফে মাম্বোস, কেপ টাউন কাফে, ক্লাব এক্সও, কামাকি এদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাইট ক্লাব। রাত ন’টার থেকে শুরু করে সারারাত চলে হুল্লোড়, পার্টি।

পরের দিন সকালে ছুটলাম নর্থ গোয়ারই আরেক বিচ ম্যান্ড্রেম সৈকতে। ডলফিন দেখার সুযোগ পাবেন আপনি এখানে। পাখ-পাখারির ডাক শুনতে আর কচ্ছপদের সঙ্গে খেলতে চলে গেলাম মোর্জিম সৈকত। রাশিয়া থেকে আজও বহু মানুষের ঠিকানা এই মোর্জিম সৈকত। পরদিন সকালটা ভাবলাম বাগা বিচেই কাটিয়ে দিই। অপূর্ব প্রকৃতি,নৈশ পার্টি, বিচ শ্যাক, কারাওকে, দারুন সব খাবার, ওয়াটার স্পোর্টস, দারুন সব হোটেল, সব মিলিয়ে বাগা বিচ ট্যুরিস্টদের কাছে ফেভারিট ডেস্টিনেশন। আমরা যদিও সকালের অনেকটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম বাইকে- গন্তব্য ক্যান্ডেলিম বিচ।

ডিসেম্বরে বিদেশিরা এসে এখানেই রৌদ্র¯œান উৎসব উদ্যাপিত করেন। এখানেই পাবেন ১৬১২ খ্রিস্টাব্দ তৈরি আগুয়াড়া ফোর্ট ও লাইটহাউস। ইউরোপ থেকে আসা জাহাজ রাখার জন্য এই দুর্গের ভিতরে জায়গা ছিল। দু’টি আস্ত জাহাজ ঢুকে যেতে পারত এখানে। চারতলা একটি লাইটহাউসও তৈরি করা হয়েছিল এটি এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো লাইটহাউস। ফোর্ট আগুয়াড়া তেকে ফেরার পথেই সিঙ্কুয়েরিম বিচ ও সিঙ্কুয়েরিম ফোর্ট। এই ফোর্ট সমুদ্র উপকুলকে মাঝখান খেকে ভাগ করে দিয়েছে। এবারে চরলাম রকি বিচ ভ্যাগেটার ও আনজুনা। পাথরের চাঁই টপকে টককে সমুদ্র পৌঁছতে হবে। সমুদ্রের আলিঙ্গন ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। কাছাকাছি ক্যাফেগুলো দারুন।

মায়ানগরী গোয়ার আরেকটি চমক মিরামার বিচ। শহরের মাঝখানে হঠাৎ করে একটুখানি ঢুকে পড়েছে সমুদ্র। মিষ্টি একটা ছোট্ট সৈকত মিরামার বিচ। এখানে বিকেলবেলা খেলার মেলা। আমরা সবাই মিলে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত সূর্যের লালের মধ্যে প্যারাগøাইডিং দেখলাম। ফেরার পথে মান্ডবি নদীর ধারে রিভার ত্রæজ। ক্রুজে আমরা খাওয়া-দাওয়া করলাম। পাশেই ক্যাসিনো রয়্যাল। উচ্চবিত্তের জন্য বিলাসবহুল এই ক্যাসিনো আপনাকে প্রশ্রয় দেবে একটু বেসামাল হওয়ার, রঙিন করে তুলবে রাত। ডেনা-পাওলা বিচও ছুঁেয় দেখলাম আমরা। দক্ষিণ গোয়ার একটি বিচেই আমরা যেতে পেরেছিলাম। কোলভা বিচ। এটি হানিমুনের সেরা স্থান। শান্ত নির্জন সমুদ্র ও প্রকৃতি। আপনার প্রান জুড়িয়ে দেবে। খাবার-দাবার-লা-জাবাব। সি-ফুড স্যালাড, অক্টোপাসের নানা আইটেম থেকে শুরু করে রাস্তায় বিক্রি হওয়া চিকেন শাওয়ারমা কিছুই ছাড়লাম না আমরা। সমুদ্র সৈকত ছাড়া আমরা শুধু পুরনো গোয়ার ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস ও শ্রী মঙ্গেঁশ মন্দির যেকে পেরেছিলাম। আর গিয়েছিলাম মাঁপসা বাজার। মাঁপুসা বাজার যাওয়ার পথ পাহাড়ের উপরে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লাব কাবানা আমরা অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। ক্লাব কাবানাকে বলা হয় ‘নাইট ক্লাব ইন দ্য স্কাই’।

পুরনো গোয়ার ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস অন্যতম পর্যটক আর্কষণ। এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্সের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও সমাধি আছে। ব্যারক স্থাপত্যের নির্দশন এই গির্জাটি গোয়া তথ। ভারতের অন্যতম পুরনো গির্জা। শ্রী মাঙ্গেঁশি মন্দির হল হর-গৌরীর মন্দির। ১৫৬০ সালে মাঙ্গেঁশি গ্রামে এই মন্দির তৈরি হয়। পানিজ থেকে এই মন্দির ২১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভগবান মঙ্গেঁশ বা শিব ও পার্বতীয় পুজো হয় এখানে। ৪৫০ বছরের পুরনো এই মন্দিরের অনেকগুলি চূড়া। নন্দীর নামে একটি বৃষস্তম্ভ ও সাততলা একটি দ্বীপস্তম্ভ আছে এই মন্দিরে। এই মন্দিরে একটি চমৎকার পুকুর বা লেক আছে। কথিত আছে দেবী পার্বতী ভয় পেয়ে পর্বতের দেবতার কাছে আকুতি জানান, তা শুনে মহাদেব নিজরূপে ফিরে আসেন। অবশেষে এল ফেরার পালা। মন সত্যিই চাইছিল না । কিন্তু ফিরতে তো হবেই। তবে রঙিন স্মৃতি নিয়েই ফিরলাম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com