এবার আমাদের গুজরাত যাওয়ার পালা। বিবাহিত জীবনের চব্বিশ বছরে পাঁচটা জায়গা ঘুরলাম আর মাত্র দশবার বাড়ি বদল করলাম! আজ কিন্তু মনের গভীরে কোথাও যেন একটা চোরা আনন্দের স্রোত বইছে যে ‘গুজরাত যাচ্ছি’। গুরগাঁওয়ের এর ছ’বছরের অভ্যস্ত জীবন, পুরনো বন্ধুদের ছেড়ে যেতে যথেষ্ট খারাপ লাগছে, তা সত্ত্বেও মনের মধ্যে গুনগুন করছে – ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ রাজ্যের বাসিন্দা হতে চলেছি। ইনভার্টার, স্টেবিলাইজ়ার – এসব বাড়তি জিনিসগুলো জলের দরে বেচে দিলাম। যাচ্ছি এখন সব পাওয়ার দেশে – এসবের ওখানে দরকার নেই। ওখানে সব উপচে পড়ছে!
সবাই জিজ্ঞাসা করছে – কোথায় যাচ্ছ? আমেদাবাদ না সুরাট? ও, এগুলো নয়? তাহলে কি বরোদা? নাঃ, এর কোনোটাই নয় –স্বামীর কর্মস্থান – ভারুচ। গাড়ীতে গেলে উত্তর দিকে বরোদা ঠিক এক ঘন্টা দুরত্বে আর দক্ষিণে সুরাট আবারও ঠিক সেই একঘন্টা দুরত্বে। নর্মদা নদীর গা ঘেঁযে ভারুচ, এক ছোট্ট শহর। শুনলাম পুরাতন শহর হিসাবে কাশীর পরেই ভারুচ। ভৃগুমুনির নামে এর নামকরণ হয়। গুরুগ্রাম বা দ্রোণাচার্যর গ্রাম ছেড়ে এসে উঠলাম আর এক অতি শক্তিধর মুনির রাজত্বে।
এখানের জীবনে গুছিয়ে নেওয়ার প্রথম মূহুর্তেই হোঁচট খেলাম। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মে মাসের গরমে লোডশেডিং! ( ইনভার্টারটা বেচে দিলাম যে…) দারুণ কায়দার বাড়ি, ধাপে ধাপে উঠে গেছে সাতটি তলা। প্রতিতলায় একটি করে বিশাল সুসজ্জিত ঘর। বসার ঘর লাগোয়া লন ঘিরে ছোট বড় ফুলগাছের সারি। গরমে অস্থির আমরা সূর্য ডুবলেই লনেই আশ্রয় নিতাম। কারণ বাড়িটা দেখলাম এমন কায়দায় তৈরি যে বারান্দা থেকে হাওয়া দেখা যায়। নদীর হাওয়া গায়ে লাগাতে গেলে বাড়ির বাইরে বেরতে হয়।
মানুষজন সুখী। বাড়ির গিসার থেকে এসি, কল, আলো সবই প্রায় খারাপ। ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, দিব্যি গান গাইতে গাইতে আসে আর যায়, আমার বাড়ির জিনিসপত্রগুলো অসুস্থই থাকে, তাদের রোগ সারাতে এরা অক্ষম!
এটা সত্যি যে মন খারাপ লাগলে অন্তত আধতৈরি বইয়ের দোকানে ঘুরলে আমার মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু হায়! হায়! ভারুচে যে একটাও গল্পের বইয়ের দোকান নেই। এখানে বইয়ের দোকান বলতে সি – এ পড়ার বই বিক্রির দোকান । জীবনযাত্রায় যে জিনিস কাজে লাগে না- সেইসব বেকার জিনিসের গুরুত্ব এরা দেন না।
প্রথম দিন যখন ছেলে একাদশ ক্লাস শুরু করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল – যে এই স্কুলে সে আর যাবে না। তখন প্রমোদ গুনলাম। বরোদার স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে নিজেদের সামান্য কিছু ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে স্কুলের পাঁচ মিনিট দুরত্বে দুজনে উঠলাম ছোট্ট একটা দুকামরার ফ্ল্যাটে।
এ যেন স্বপ্নপূরণের শহর। ছোট্ট বাড়িটায় এসে হাঁফ ছাড়লাম। হাতের কাছে ‘সামার’ বা়জার। ছোট শহরটা যেন সবরকম মানুষকে কাছে টেনে নিতে সর্বদা প্রস্তুত। আমাদের দুজনের সংসার জমে উঠল। ছেলের স্কুলও পছন্দ হল। সপ্তাহান্তে ভারুচ যেতাম অন্য সংসারটির টানে। কোনওরকম এক/দেড়দিন কাটিয়ে বরোদায় ফিরে এসে আবার জোরে নিঃশ্বাস নিতাম।
একঘন্টার দুরত্বে দুই শহরে এত কী তফাৎ?! বরোদাতে নতুন আর পুরনো শহর বড় সুন্দরভাবে মিলেমিশে এক হয়েছে। ওদিকে লক্ষ্মীবিলাস প্যালেস আর মঙ্গলবাজার, তো এদিকে অলকাপুরীর ঝাঁ –চকচকে পরিবেশ। এরই মাঝে ঋষি অরবিন্দ নিলয় আমার আর-এক আকর্ষণীয় স্থান ছিল। মঙ্গলবাজারে সারি সারি আতরের দোকান কচপ্রদেশের হাতের কারুকার্য-করা পোশাক –আসাক, আসবাবপত্র আমার চির লোভনীয়। লক্ষ্মীবিলাস প্যালেসে রাজা – রঘুভার্মার ছবির প্রদর্শনী থেকে যেন পা সরে না। তারই সাথে আমাদের প্রিয় শিল্পী নন্দলাল বসুর হাতে গড়া মূর্তি আমাকে অবাক করেছে।
বরোদার মাঝে দিয়ে সরু সুতোর মতো এক নদী গিয়েছে। নাম – বিশ্বামিত্র। খুব দেখার চেষ্টা করতাম, জঙ্গলের ফাঁকে নদীটা ঠিক কোথায়?! বর্ষাকালে নদী বুঝালো সে আছে। শুধু আছে নয় বুকে করে বহু কুমীর ধারণ করে সে নিয়ে এসে ছেড়ে দিল শহরের মাঝে। আজ এর গরু যায় তো কাল তার মেয়ে কাপড় কাচতে গিয়ে উধাও। আমি সুন্দরবনের কথা বলছি না কিন্তু। এটা গুজরাতের বরোদা শহর।
গুজরাতের নবরাত্রি, তার গরবা নাচ এক ঝলমলে অতি সুন্দর দেবী বন্দনা। বরোদায় যখন তা প্রত্যক্ষ করলাম তখন দেখলাম যা ভেবেছিলাম তার অনেক বেশী কিছু। বিশেষ করে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান। নবরাত্রিতে ছেলে-মেয়ে নারী-পুরুষ- নির্বিশেষে এই একসাথে তাল মিলিয়ে নাচ আমার ভাষায় প্রকাশের অতীত। গরবা নাচের পোশাক, গহনা তো বটেই, যেখানেই গেছি মনে হয়েছে এরা সবাই যেন চিরকাল ধরে এই নয়দিনের জন্যই প্রস্তুত। এইসময় গুজরাতে সত্যান্বেষীরাও দম ফেলার সময় পান না। এক একজনের হাতে তিরিশ-পয়ত্রিশটা করে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানের দায়িত্ব পড়ে। এও সত্যি!
বিশ্বকর্মা পুজায় নয়, জানুয়ারী মাসে মকর সংক্রান্তিতে এরা সারাদিন ঘুড়ি ওড়ায় আর সারারাত ফানুস। ঘুড়ির বাহার দেখলে ভ্রম হয় ভারতর্বষে আছি না জাপানে। রাতভোর ফানুসের আলোয় আকাশে যেন তিলধারণের জায়গা থাকে না। প্রতি বাড়িতে রান্না করা হয় ‘উনডিয়ু’। সব সবজি সংমিশ্রণে মিষ্টি-মিষ্টি খেতে অতি উপাদেয় এই খাদ্যটি তৈরি করা হয়।
বরোদায় আমার আরেক সঙ্গী ছিল – অনিতা। ও আমার বাড়িতে কাজ করতে আসত। রোগা –পাতলা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। যত তাড়াতাড়ি করে পরিষ্কার কাজ করতে পারে ততই যেন তাড়াতাড়ি কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়তে পারে। ছোট্ট স্টীলের কৌটায় সকালে রান্না করা বাড়ির একটা না একটা সবজি ও আমার জন্য নিয়ে আসত। ও আমার তৈরি তরকারি খেত তো আমি ওর তৈরি সবজি। বরোদায় অবশ্য মন ভাল থাকলেও মায়ে –পোয়ে বইয়ের দোকানে যেতাম ক্রসওয়ার্ডে!
ছেলের স্কুলের দু বছরের মেয়াদ শেষ হলে আমি আবারও আর একবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে এলাম ভারুচে। ফিরে এসে উঠলাম নর্মদার তীরে এক সাত তলা ফ্ল্যাট বাড়ির সাততলায়। শোবার ঘরের সাথে বিশাল খোলা ছাদ – পাশেই চওড়া নদী নর্মদা বয়ে চলেছে। ভারুচ অঙ্কলেশ্বরের মধ্যবর্তী ‘গোল্ডেন ব্রিজ’ ও যেন একেবারে পাশে । রাতে কালো নদীর বুকে ব্রিজ দেখা যায় না শুধু ঝিকিমিকি আলোর সারি। আর দূরে অঙ্কলেশ্বর শহরের আলো।
১৮৮১ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হয় নর্মদা নদীর ওপর ব্রি়জটি। যা আজকের নবনির্মিত নর্মদার ওপর অন্যান্য ব্রিজগুলির নির্মানপদ্ধতির মুখে চুনকালি মাখিয়ে এরাই বিরাজমান অটুটভাবে। অঙ্কলেশ্বর থেকে ভারুচ এবং উল্টোমুখেও একটিমাত্র গাড়ীর সারি মোটামুটি ধীরগতিতে লম্বা ব্রিজটি পারাপার করে সারা দিন ভর। ব্রিজ – এ, দুটি গাড়ী পাশাপাশি দাঁড়ালে আর একজন লোকেরও পাশে দাঁড়াবার জায়গা হয় না। এভাবেই চলছে বহু কালের পুরোনো ব্রিজের ওপর দিয়ে যাতায়াতের পর্ব।
ভারুচ বাজারের মাঝখানে আজও খুঁজলে পাওয়া যায়- ভৃগু-মন্দির। অজস্র ছোট ছোট শিবালিঙ আর এক শনিদেবের মূর্তি আছে এই মন্দিরে। লোকে আজকাল প্রধানতঃ এখানে আসে এই শনিদেবতার পূজা দিতে।
গুজরাতের লাগোয়া সোমনাথ মন্দিরের থেকে অল্প কিছু দুরত্বে দিউ এক স্বতন্ত্র রাজ্য। দিউ এর মাঝে একটি ছোট্ট এয়ারপোর্টও আছে। এককালের পর্তুগীজ এই রাজ্য আজ গুজরাতী প্রধান। এতো সুন্দর, পরিচ্ছন্ন শহর দেখার সৌভাগ্য ভারতবর্ষে খুব একটা মেলে না। সমুদ্রের পারে দাঁড়ালে যেখানে সমুদ্র আর পাহাড় শ্রেণি একে অপরের হাত ধরে চলেছে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন এমনি করেই সারাদিন ধরে প্রকৃতি আমাকে তার সৌন্দর্য পান করাক। পরিষ্কার সমুদ্র সৈকতে কোথাও প্লাস্টিক এর বোতল বা চিপস- এর প্যাকেট পড়ে নেই। দিউ তে ‘হোক্কা’ গাছের সারি দেখার সুযোগ মেলে। ভারতবর্ষের আর কোথাও তা আছে কিনা আমার জানা নেই। পর্তুগীজরা এই গাছ তাদের দেশ থেকে এনে লাগিয়েছিল এখানে কত শতাব্দী আগে কে বা জানে! প্রধান শহর থেকে খানিক দুরত্বে সমুদ্রের মাঝে পর্তুগীজ – প্রস্তুত এক দূর্গের মতো বিশাল সৌধ হল দিউ –এর জেলখানা। ষেখান থেকে সকালে বোটে করে অপরাধীদের নিয়ে আসা হয়, সারাদিন তাদের দিয়ে শহরে নানাপ্রকার কাজকর্ম করিয়ে সন্ধ্যায় আবার বোটে করে ফিরত নিয়ে যাওয়া হয়।
দু বছরে ভারুচকে খুব ভালবেসে ফেললাম। দ্যাখ না দ্যাখ ছুটে যেতাম নর্মদা নদীর মধ্যে এক ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত ‘কবীরভার’ এ। লঞ্চ- এ করে পারাপার করতে হত। ওপারে নর্মদার বালুকাময় তীর। এক বহু প্রাচীন বটগাছকে কেন্দ্র করে ভক্ত কবীরের এই আস্তানা খুব একটা যেন শান্তির জায়গা। ভারুচ ফোর্ট, নর্মদার হুহু করা হাওয়া, বারান্দা- ছাদে ভর্তি নানা পাখির ঝাঁক-টিয়া, পায়রা, বুলবুলি, চড়ুই, দাঁড়কাক – আরো কত কি, আমার মন ভাল করে দিত এক নিমেষে। মনটা লাগামছাড়া আনন্দে কোথায় যে ভেসে বেড়াত – তাকে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনতে আমায় যথেষ্ট কষ্ট করতে হত। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়া নেই মানা, মনে মনে’।
আজকের ভারুচ ইংরেজ আমলের ব্রোচ শহর। এক প্রধান বাণিজ্য নগরী। ভারুচের লোকসংখ্যার বেশীরভাগ মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। গীর্জা, মসজিদ, মন্দির ভারুচ শহরে সমপরিমাণে বিরাজ করছে। শান্তিপ্রিয় লোকজন আর সুন্দর তাদের ব্যবহার। রাস্তাঘাট অবশ্য বেশীরভাগ সময় খুব নোংরা থাকত।
বর্ষায় বাড়ির বাগানে একপাল ময়ূরী আর তাদের একজন পুরুষ-সঙ্গী ময়ূরকে নিয়ে এসে তাদের নাচ দেখিয়ে যেত। আমার গাড়ীর চালক জিগনেশ, আমার বাড়িওয়ালি রক্ষা, ও তার পরিবার, মঞ্জুর মতো প্রতিবেশী, রেখার মতো, অনিতার মতো পরিচারিকা – আমার গুজরাত বাসের প্রধান পাওনা। শহরের মানুষের মনুষ্যত্বের গুণে বা দোষে জায়গাটি সুন্দর বা কুৎসিৎ হয় বলে আমার বিশ্বাস। গুজরাত বাসের শেষে নর্মদা নদী আর এই মানুষগুলোকে ছেড়ে আসতে চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহজে আপন করে নেওয়া এই সুন্দর মানুষগুলোকে আমি আজও মনের গভীরের ভেজা-ভেজা, নরম, সুন্দর যে জায়গাটি সেখানে বসিয়ে রেখেছি – যাতে মনখারাপ হলে, লোকের আচরণে কষ্ট পেলে এদেরকে মনে মনে একবার ছুঁয়ে আসতে পারি।