‘দেড় বছর চাকরি করে টাকা জমাই, সে টাকায় ২-৬ মাস ভ্রমণ করি। গত ১৫ বছর ধরে এই পন্থা অবলম্বল করেই ১৫০ দেশ ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণের নেশায় পরে কখনো দামি পোশাক গহনা কেনা হয়নি’, আলাপচারিতায় এমনটিই বলছিলেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে ১৫০টি দেশ ভ্রমণ করা খুলনার মেয়ে কাজী আসমা আজমেরী।
এই ভ্রমণকন্যা বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে ভ্রমণ করতে চান পুরো বিশ্ব। পৃথিবীর কোণায় প্রতিটি দেশে রেখে আসতে চান নিজের পদচারণা ও বাংলাদেশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বৃক্ষরোপণ। শুধু ভ্রমণই উদ্দেশ্যেই নয়, ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন মোটিভেশন স্পিকার ও একজন সমাজসেবিকা।
যে দেশেই তিনি যান না কেন, সেখানেই সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করেন। এর ফলশ্রুতিতে তিনি প্রায় ৭০০ এরও বেশি স্কুল-কলেজে ও সংগঠনের ৬৭ হাজার ছাত্রছাত্রীদেরকে তার ভ্রমণের গল্প শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। এ বছরের ৫ আগস্ট ১৫০তম দেশ হিসেবে আজমেরী ভ্রমণ করেছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানা।
ভ্রমণের শুরুটা কীভাবে? জানতে চাইলে আলাপচারিতায় আজমেরী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। মা ছোটবেলায় আমাকে নানা ধরনের গল্পের বই পড়ে শুনাতেন, তার অধিকাংশই ভ্রমণের কাহিনি। সেখান থেকেই ঘুরে বেড়নোর ইচ্ছে জন্মায় মনে। মূলত ছোটবেলার সেই ইচ্ছে আকাঙ্খা থেকেই বিশ্ব ঘুরে দেখার ইচ্ছেটা জাগে।’
‘প্রথমে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ডে, নীল সমুদ্র দেখার পর আমার মনে হয়েছিল ভ্রমণের জন্য যত টাকা খরচ হয়েছে এই সমুদ্র দেখার পর সব আফসোস কেটে গেছে। এক কথায় থাইল্যান্ডের সৌন্দের্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ২০০৯ সালে নেপালে যাই, হিমালয় দেখার পর পুরো বিশ্বের সৌন্দর্য আমাকে টানতে থাকে।’
এরপর বিশ্বের নারীদের সমঅধিকার দেখার উদ্দেশ্যে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন আজমেরী। তিনি বলেন, ‘আমি পৃথিবীর নানা দেশের ভিসা সংগ্রহ করা শুরু করি, যা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য পৃথিবীর অষ্টম দুর্বল পাসপোর্ট দিয়ে। তবে আমি নাছোড়বান্দা, এমনও হয়েছে আজারবাইজানে আটবার এম্বাসিতে যাওয়ার পরে তারপর ভিসা পেয়েছি। আমি যেই দেশে গিয়েছি, সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা আমাকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেছেন।’
আজমেরীর ১৫০ দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যেমন রোমাঞ্চকর ছিল, তেমনই ছিল চ্যালেঞ্জিং। ২০১০ সালে ভিয়েতনামে ভ্রমণ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন তিনি। ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখার পর ভিয়েতনামের ইমিগ্রেশনের জেলে ২৩ ঘণ্টা বন্দিও করে রাখা হয় তাকে।
সেই আক্ষেপেই বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিশ্ব ভ্রমণের জেদ বাড়ে আজমেরীর। এছাড়া ১৪৮তম দেশ ভ্রমণের সময় অর্থাৎ পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে আটকে গিয়েছিলাম। সেখানে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তেলের অভাবে। সেখানকার জংলি সন্ত্রাসীদের আতঙ্কে কাটিয়েছেন বেশ কয়েকদিন।
এতগুলো দেশ ঘুরেছেন, সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোন কোন দেশ? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী আসমা আজমেরী বলেন, ‘প্রতিটি দেশরই আছে ভিন্ন-ভিন্ন সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি। যার প্রতিটিই আমার ভালো লেগেছে। মরক্কো ভালো লেগেছে, ইবনে বতুতার বাড়ি দেখেছি। মিশরের পিরামিড, কিউবাও খুব ভালো লেগেছে। প্রতিটি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই ছিল অন্যরকম।’
‘সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে আফ্রিকার মরক্কো। দেশটিতে মরুভূমির পথে উটের পিঠে চড়েছি, দিনে কমপক্ষে চার ঘণ্টা। ইবনে বতুতার বাড়িটি খুবই ভালো লেগেছে। এছাড়া দেখার মতো আছে সাহারা মরুভূমি, নীল সমুদ্র। ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরা দেশটি। সেখানে আছে পৃথিবী খ্যাত বাজার। যেখানে মানুষের দাঁত বিক্রি হয়। শহরটিতে সব প্রকার জীবজন্তু পাওয়া যায়। এদিকে সাউথ আমেরিকার বলিভিয়া খুবই সুন্দর একটি দেশ। সেখানে আমার মনটা আজও পড়ে আছে।’
ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের জীবনে কী ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে জানতে চাইলে আজমেরী বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন, নিয়ম-নীতি নৈতিকতা জানা ও শেখা যায়। ভ্রমণ করলে নিজের মধ্যে থেকে হিংসা-বিদ্বেষ চলে যাবে। যারা ভ্রমণ করেন তারা উদার মনের হন। নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, যা দক্ষতা তৈরিতে সাহায্য করে।’
কাজী আসমা আজমেরী ১৫ বছরের মধ্যেই ১৫০ দেশ ও ১৫০০ উপরে শহর ও উপ-শহরে বিশ্বভ্রমণ করছেন। ভ্রমণের সময় ‘ট্রাভেল ইজ ফান ওয়ে টু ল্যার্ন’ এ সম্পর্কে সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এরই মধ্যে অনেক বিদেশি বন্ধুদেরকে বাংলাদেশের আতিথেয়তা সম্পর্কে জানিয়েছেন ও তাদেরকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। অনেকে বাংলাদেশে এসেও ঘুরে গিয়েছেন। এরই মধ্যে আজমেরী খুলনায় তার চারতলা বাড়িতে ১৫০ দেশ ভ্রমণের সংগৃহীত সামগ্রী দিয়ে লাইব্রেরি, জাদুঘর ও সংস্কৃতি ক্লাব চালু করেছেন।
সামাজিক উন্নয়নে কীভাবে অবদান রাখছেন? জানতে চাইলে এই ভ্রমণকন্যা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমি ৬৭ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ভ্রমণ সংক্রান্ত কাজ করা হয়েছে। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্ব ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করি। শিক্ষার্থীরা ভ্রমণের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করতে পারে, স্বপ্নবাজ হতে পারে, তা বোঝানোর চেষ্টা করি।’
আজমেরি আরও বলেন, বিশেষ করে চেষ্টা করি দেশের নারীদের অনুপ্রাণিত করতে। তাদের বোঝায় বিশ্বে নারীদের নিরাপত্তার কোরো ঘাটতি নেই। নারীদের বিশ্বভ্রমণ কঠিন নয়, অনেক সহজ। এছাড়া বিভিন্ন দেশে গিয়ে আমি গাছ লাগিয়েছি, চেষ্টা করেছি নিজের স্মৃতিচিহ্ণ রাখার। অন্যান্য দেশের শিশু, তরুণ ও নারীদের, বিশেষত আফ্রিকার দেশে কর্মজীবন বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেই।
বাংলাদেশের আজমেরিকে নিয়ে খবর প্রকাশ হয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যমেও। ভয়েস অব আমেরিকায় ৬৩দেশ ভ্রমণ সাক্ষাৎকার ২০১৫ সালে। বিবিসি, হিন্দুস্তান টাইমস ও টাইমস অব ইন্ডিয়া, তুর্কমেনিস্থানের টিভি ও পত্রিকা, রাশিয়ার বিভিন্ন পত্রিকা, কাতার রেডিও, জার্মানির পত্রিকা, চীনা রেডিও লেবানন টিভিতে অগণিত নিউজ মিডিয়া ও টিভিতে প্রচারিত হয় সাক্ষৎকার। ১৫০তম ভ্রমণপূর্ণ করায় ঘানাতে বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন চেঞ্জ মেকার হিসেবে। ইন্ডিয়ার ক্রেজিটেল বেস্ট ফিমেল ট্রাভেলার হিসেবে ২০২১ সালে। বিশ্বের পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, যার চূড়ান্ত ফলাফল এখনো প্রকাশ হয়নি।
ভ্রমণ নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? জানতে চাইলে আজমেরী বলেন, ‘আমি ফুটবল খুব পছন্দ করি। ইচ্ছে আছে ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ১৯৩টি দেশ ভ্রমণ শেষ করে বিশ্ব ভ্রমণের পরিসমাপ্তি করবো। এখন শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো বাকি আছে ও সাউথ আমেরিকা কিছু দেশ, আর ভিসা জটিলতায় আটকে আছে কিছু দেশ। আগামী কয়েক বছর চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই দেশগুলোয় ভ্রমণ করতে চাই।
ভ্রমণকন্যা কাজী আসমা আজমেরি বর্তমানে কর্মরত আছেন অস্ট্রেলিয়ান এক খনিজ কোম্পানিতে এই বছরের জুন পর্যন্ত। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় স্টকচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্টও করেছেন তিনি।