মিসরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীদের খতনা করানোর প্রথা চালু আছে। ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (এফজিএম) নামে পরিচিত এই প্রথার কারণে নারীদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। সারা জীবন এই সমস্যা তাঁদের বয়ে বেড়াতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে যাঁদের ইতিমধ্যে খতনা হয়েছে, তাঁদের যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মিসরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। ইতিমধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে এই অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। অসংখ্য নারী এখন এই প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
তেমনই একজন নারী ইন্তিজার (ছদ্মনাম)। তাঁর বয়স তখন সবে ১০ বছর। অতটুকু বয়সে অবর্ণনীয় ওই প্রথার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। জোর করে তাঁর খতনা করানো হয়। শুধু ইন্তিজার নন, মিসরে লাখো নারীকে এই প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, হয়েছে। ইন্তিজারের খতনার পর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে।
পেশায় সাংবাদিক ইন্তিজার বলেন, খতনার (যোনিছেদ) কারণে গত ৩০ বছর তিনি শারীরিক আনন্দ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছেন। এ কারণেই তিনি যৌনাঙ্গ পুনরুদ্ধারে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ইন্তিজারের গল্পের মতোই মিসরের লাখো নারী ও মেয়েদের গল্পগুলো একই রকম। কারণ, এই দেশে অল্প বয়সে মেয়েদের খতনা করানো হয়। যদিও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রথা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর তিন বছর ধরে দেশটির একটি বেসরকারি হাসপাতাল এমন নারীদের শারীরিক বাস্তবতা বদলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
২০২০ সালে সার্জন রেহাম আওয়াদ ও আমর সিফেল্ডিন মিসরের কায়রোতে অবস্থিত তাঁদের হাসপাতালে প্রথমবারের মতো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারীর গোপনাঙ্গের ক্লিটোরিস বা ভগাঙ্কুর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। চিকিৎসক রেহাম আওয়াদ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আবার অস্ত্রোপচারই হচ্ছে শেষ কথা।’
তবে রেহাম আওয়াদ এ-ও বলেন, এই নতুন চিকিৎসাপদ্ধতির প্রথম ধাপ হলো প্লাজমা ইনজেকশন দিয়ে যৌনতা-সংক্রান্ত মানসিক (সাইকোসেক্সুয়াল) কাউন্সেলিং করানো।
এতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা ৫০ শতাংশ কমানো যেতে পারে। প্লাজমা ইনজেকশন নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে আবার নতুন করে তৈরিতে সহায়তা করে।
ইন্তিজারের মতো নুরহানেরও (ছদ্মনাম) ১১ বছর বয়সে খতনা করানো হয়। তাঁর বয়স এখন ৩০। খতনার কারণে গত দুই দশকে তিনি নিদারুণ ব্যথা সহ্য করেছেন। এই ব্যথার কারণেই তিনি যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আট মাস আগে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন।
নুরহান বলেন, অস্ত্রোপচারের পর তিনি সম্পূর্ণ আলাদা অনুভূতি পাচ্ছেন। এর শারীরিক প্রভাবের চেয়েও বেশি যেটা তিনি অনুভব করছেন, তা হলো, নিজের কাছে নিজের শরীরের দায়িত্ব থাকা।
৪০ বছর বয়সী ইন্তিজার তাঁর সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, দাদি তাঁকে খতনা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর বাবা, একজন চিকিৎসক ও স্কুলের অধ্যক্ষের সম্মতি ছিল। ব্যথায় কেঁদে উঠেছিলেন তিনি। এ সময় তাঁর দাদি বলেছিলেন, ‘চুপ করো। এটা তোমার ভালোর জন্যই করা হচ্ছে।’
পরে দাদির যত্ন-আত্তিতে স্কুলের গ্রীষ্মের পুরো ছুটিতে ওই ক্ষত তাঁর সেরে গিয়েছিল। তবে এখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা তাঁকে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে।
মিসরের মানবাধিকার সংস্থা ইজিপশিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর পারসোনাল রাইটসের জেন্ডার অফিসার লুবনা দারবিশ ‘ছুটির আগে স্কুলে স্কুলে প্রতিরোধ প্রচারাভিযান’ চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, এই ছুটির সময়েই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি খতনা করানো হয়। এতে ছুটির মধ্যে ওই ক্ষত শুকানোর সময় পায় তারা।
২০২১ সালের সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিসরের সমাজব্যবস্থা এখনো রক্ষণশীল। এখানে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৮৬ শতাংশ বিবাহিত নারীকে খতনা করানো হয়েছে।
খতনা সাধারণত নারীদের ক্লিটোরিস বা ভগাঙ্কুর ও ল্যাবিয়া মাইনরা (যৌনাঙ্গের ভেতরের চামড়া) আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এতে ব্যথা, রক্তপাত, সংক্রমণ, যৌনতার সময় ব্যথা ও প্রসবের সময় জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
নারীদের খতনার পেছনে মূলত ভুল ধারণা কাজ করে। আর ধারণাটি হলো, নারীদের খতনা যৌন ইচ্ছা কমিয়ে দেয়। মনে করা হয়, খতনার পর মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। মিসরে এটিকে অনেক সময় বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবেও দেখা হয়। মুসলিম ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতারা এই প্রথার নিয়মিত নিন্দা জানিয়ে আসছে।
২০০৮ সালে মিসরে নারীদের খতনা অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও এখনো এই প্রথা দেশটিতে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। শুধু মিসর নয়, আফ্রিকার নানা দেশেও এই প্রথা চালু আছে।
নারীদের খতনা বন্ধে মিসর ১৪ জুন দেশটির জাতীয় দিবস ঘোষণা করেছে। প্রতিবছর এই দিনে টেলিভিশনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রথার বিপজ্জনক দিকগুলো উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করা হয়।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ ধাত্রীরা যে বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় নারীদের খতনা করেন, তাতে অভিভাবকেরা আতঙ্কিত। এ কারণে অভিভাবকেরা ধাত্রীর নিরাপদ বিকল্প খুঁজে নিয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে, মিসরে এখন খতনার তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসকদের মাধ্যমে করানো হয়।
নুরহান বলেন, খতনার করানোর পর তিনি ও তাঁর আট বছর বয়সী বোন যখন সেরে উঠেছিলেন, তখন পরিবারের সদস্যরা এর ধর্মীয় ও নৈতিক গুণাবলির প্রশংসা করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, এটি স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন বলেও মন্তব্য করেছিলেন তাঁরা।
ইন্তিজার বলেন, বাস্তবে খতনা করানোর লক্ষ্যই হলো, ‘নারীকে তাঁর নিজ শরীর ও শারীরিক আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।’
খতনা করানোর কারণে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক ও অভিভাবকের ওপর কঠোর শাস্তি আরোপ করে থাকে। তবে জেন্ডার অফিসার লুবনা দারবিশ ও চিকিৎসক রেহাম আওয়াদ দুজনই এর পেছনে অজ্ঞতাকে দায়ী করেছেন।
লুবনা দারবিশ বলেন, ‘স্কুলেই আমাদের সঠিক যৌনশিক্ষা দরকার। ২০১৭ সালে যে হটলাইন চালু করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে।’
রেহাম আওয়াদ বলেছেন, ‘কোনো সময় চিকিৎসকেরা নারীর যৌনাঙ্গ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার অস্ত্রোপচার বিষয়ে শেখার চেষ্টা করেন না।’ তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া নারীদের খুব কম সময়ই নিজের শরীর সম্পর্কে জানার সুযোগ দেওয়া হয়।
খতনা করায় বিস্মিত ও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ইন্তিজার। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, তাঁরা হয়তো চামড়ার ছোট্ট একটা অংশ কেটে ফেলেছেন। কিন্তু পরে দেখতে পেলাম, তাঁরা আমার পুরো ল্যাবিয়া ও ক্লিটোরিস বা ভগাঙ্কুরের একটা অংশ কেটে ফেলে দিয়েছেন।’ এ কারণেই তিনি যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় ও অর্থের প্রয়োজন।
নুরহান যৌনাঙ্গে অস্ত্রোপচারের জন্য এক বছর ধরে অর্থ জমিয়েছিলেন। এতে তাঁর খরচ হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার (৪০ হাজার মিসরীয় পাউন্ড), যা দেশটির গড় মাসিক বেতনের ১০ গুণ বেশি। তিনি দাবি করেন, সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারটি করার সুযোগ দিতে হবে।
নিজের যৌনাঙ্গে সফল অস্ত্রোপচার করার পাশাপাশি নুরহান আরও একটি বড় কাজ করেছেন। তিনি মায়ের সঙ্গে এক জোট হয়ে তাঁর দুই ভাগনিকে খতনার হাত থেকে রক্ষা করেছেন।