সাধারণ মানুষের টাকায় ‘জনগণের এয়ারলাইন’ গড়ার ঘোষণা দিয়ে ‘পিপলস এয়ার’ নামের একটি নতুন এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন এক উদ্যোক্তা। তিনি দাবি করছেন, এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম ‘ক্রাউড ফান্ডেড’ এয়ারলাইনস। এরই মধ্যে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের নিবন্ধনও শুরু হয়েছে। তবে নতুন এয়ারলাইনস গঠনের উদ্যোগটিতে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা কিংবা ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা কীভাবে নিশ্চিত হবে, সেটি স্পষ্ট নয়। এমনকি আলোচনা করা হয়নি সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গেও। এ অবস্থায় নতুন এয়ারলাইনসে বিনিয়োগে আশার চেয়ে শঙ্কাই বাড়ছে বেশি।
জানা গেছে, পিপলস এয়ারের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন বৈমানিক আব্দুল্লাহ ফারুক। তিনি সর্বশেষ কর্মস্থল ফ্লাই ঢাকা এয়ারলাইনসের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ছিলেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ ফারুক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে বলে আসছেন, ‘এই এয়ারলাইনস হবে জনগণের মালিকানাধীন।’ তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১ হাজার ব্যক্তি প্রত্যেকে ২০ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করবেন। এতে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গড়ে উঠবে। বিনিয়োগকারীরা হবেন ‘ফাউন্ডার মেম্বার’। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, এসব ফাউন্ডার মেম্বার আজীবন ডিসকাউন্টে ভাড়া, বার্ষিক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ এবং লাভের অংশীদার হবেন।
‘ক্রাউড ফান্ডেড’ এয়ারলাইনসের উদাহরণ হিসেবে এয়ার এশিয়া ও ইন্ডিগোর কথা বলে আসছেন প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি দাবি করেন, এসব এয়ারলাইনসের শুরু ‘জনগণের ছোট ছোট বিনিয়োগে’ হয়েছিল। পিপলস এয়ার চালু করতে এটিআর ৭২-৬০০ উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
শুরুর দিকে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহীদের ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে বলা হলেও সম্প্রতি নিবন্ধন শুরু হয়েছে। নিবন্ধনের জন্য একটি ফরমও ছাড়া হয়েছে। নিবন্ধন ফি ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। চলতি জুলাই মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত নিবন্ধনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তার দাবি অনুযায়ী, এরই মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি উত্তর আমেরিকায় থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনিয়োগ আহ্বান করা হচ্ছে ব্যক্তিগত বার্তায়। উদ্যোগটির কোনো অফিশিয়াল ওয়েবসাইট নেই। বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহীদের ব্যক্তিগত ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে বলা হচ্ছে, যা অনিয়ন্ত্রিত ও সন্দেহজনক। ২০ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ আহ্বান করা হলেও নেই কোনো ট্রাস্ট অ্যাকাউন্ট, নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী বা স্বচ্ছ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, যা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর।
এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এভিয়েশন খাত পুঁজি-নির্ভর, দীর্ঘমেয়াদি ও উচ্চ নিয়ন্ত্রিত। তা ছাড়া নতুন এয়ারলাইনস চালু করতে হলে বেবিচকসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন হয়। যে কেউ চাইলেই এয়ারলাইনস গঠনের অনুমতি পাবেন, বিষয়টি তেমন নয়। এ কারণে কেবল আবেগ বা সামাজিক আহ্বানে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সর্বোপরি ক্রাউড ফান্ডে এয়ারলাইনস খাতের জন্য সঠিক পদ্ধতি নয়। তিনি বলেন, অতীতেও এ ধরনের উদ্যোগ দেখা গেছে, যা পরবর্তী সময়ে সুখকর হয়নি।
জানা গেছে, ক্রাউড ফান্ডিং একটি বৈধ পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশে এর জন্য স্পষ্ট কোনো আইন বা নিয়ন্ত্রক কাঠামো নেই। সাধারণত উদ্ভাবনী আইডিয়া, স্টার্টআপ বা এনজিও খাতে এটি ব্যবহৃত হয়। এমন একটি উচ্চ মূল্যের, উচ্চ ঝুঁকির খাত—এভিয়েশনে এ পদ্ধতি বিশ্বে কোথাও সাফল্যের নজির নেই। এয়ার এশিয়া, ইন্ডিগোসহ বড় বড় এয়ারলাইনস প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ও আইপিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছে, ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে নয়।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, ‘পিপলস এয়ার’ নামে কোনো কোম্পানি এখন পর্যন্ত তাদের কাছে কোনো ধরনের আবেদন বা লাইসেন্সের জন্য যোগাযোগ করেনি। বেবিচকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, নতুন কোনো এয়ারলাইন চালুর জন্য অন্তত ১৫টি ধরনের সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন। প্রয়োজন নিরাপত্তা মানদণ্ড, দক্ষ টিম, অপারেটিং সিস্টেম এবং আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন রেগুলেশন মেনে চলা। এগুলো ছাড়াই বিনিয়োগ আহ্বান বিভ্রান্তিকর।
বাংলাদেশে আগে ডেসটিনি, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ বহু প্রতিষ্ঠান আবেগমূলক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের টাকা সংগ্রহ করে প্রতারণা করেছে। শুরুতে তাদেরও ছিল উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন দেখানো ও বিনিয়োগের মোহ। যদিও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের থেকে অর্থ তুলতে হলে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কোনো কোম্পানি তা না মেনে বিনিয়োগ আহ্বান করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু তা-ই নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও দণ্ডবিধি অনুযায়ী, প্রতারণামূলকভাবে বিনিয়োগ আহ্বান করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য জেল, জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানাতে চাইলে পিপলস এয়ারের প্রধান উদ্যোক্তা ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে নতুন এয়ারলাইনস গঠনের উদ্যোগটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আমরা কারও কাছ থেকে এখনো অর্থ সংগ্রহ করিনি। বিনিয়োগ সংগ্রহের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া এবং আইনি দিকগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘বেবিচক থেকে এয়ারলাইনস শুরুর অনুমতি অর্থাৎ এওসি পেতে আমরা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও আলোচনা করছি। কয়েকজন “ইনিশিয়াল বিনিয়োগকারী”ও পাওয়া গেছে।’