একদিকে প্রাচ্যের ভেনিস, অন্যদিকে হিপ্পিদের পীঠস্থান। একদিকে সোনালি সমুদ্রসৈকত আর অন্য দিকে মাইলের পর মাইল চলতে থাকা ব্যাকওয়াটার। আর চারদিকে শুধুই সবুজ আর সবুজ।
কেরল ভ্রমণের পরিকল্পনা আমাদের দীর্ঘদিনের। অবশেষ চার বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে নিলাম আগে থেকেই। কোচি, মুন্নার, থেকাডি হয়ে অবশেষে পৌঁছলাম আলেপ্পি। রাস্তায় ইডলি ধোসা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সকাল এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম আলেপ্পিতে। হাউজ়বোট আগে থেকেই বুক করা ছিল। আমরা নিজেদের জন্য মাঝারি সাইজ়ের টু-বেডরুম একটা হাউসবোট বুক করেছিলাম। এখানে হাউজ়বোটকে কেত্তুভল্লম বলা হয়।
কেত্তু মানে দড়ি দিয়ে বাধা আর ভল্লম মানে মালায়ালামে নৌকো। আলেপ্পি পৌঁছে একটু অপেক্ষা করতে হল, কারণ আমাদের বোট তখনও এসে পৌঁছায়নি জেটিতে। একটু পরে বোট এলে আমরা তাতে উঠে পড়লাম। সে এক রাজকীয় অভিজ্ঞতা! শুরুতেই ফলের রস আর নানারকমের ফল দিয়ে আমাদের আন্তরিক জানালেন বোটের কর্মচারী এবং ম্যানেজার। নামে বোট হলেও সবরকমের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। নরম গদিঠাসা চেয়ার, ডাইনিং টেবল, ছোট্ট সোফা। বেডরুম দেখলে তাক লেগে যায়। পোস্টার বেড, বিল্ট ইন কাবার্ড, এমনকী এসি পর্যন্ত আছে। লাগোয়া বাথরুমও ঝকঝকে, তকতকে। গিজ়ারের সুবিধেও পাবেন।
চারপাশে অথৈ জলরাশির মাঝে ঠিক বেলা ১২টা নাগাদ আমাদের বোট রওনা হলো। আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। চারপাশে শুধু নীল। আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে ক্রমশ পৌঁছে যাবেন ভেম্বানাডু লেকের মাঝখানে। তার জুড়ে অসংখ্য তাল গাছা আর নারকেল গাছের সারি, হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। আশেপাশে ছোট নৌকা কিংবা দু’চারটে হাউজ়বোট দেখতে পাবেন। আর রয়েছে ক্যানো। দেখতে অনেকটা নৌকোরই মতো। এখানকার লোকাল ট্রান্সপোর্ট। টি টিং করে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে দ্রুত ছুটে যা। এক প্রান্ত থেকে আর কে প্রান্ত। দেখতে দেখতে খেয়ালই করিনি কখন দুপুর হয়ে গেছে। আড়াইটে নাগাদ বোট থামানো হলো। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। ভাত, সাম্বার ৫-৬ রকম সবজি মিষ্টি এবং ক্ষীর। সাথে স্পেশাল কেরলিয়ান ডিশ মীন কারী। আমি মাছ ভালোবাসি না। কিন্তু বন্ধুদের কথায় টেস্ট করার জন্য নিলাম।
এককথায় অপূর্ব। তৃপ্তি সহযোগে চলল ভুরিভোজের পালা। নারকেল তেলে আপত্তি থাকলে জানিয়ে দেবেন। অন্য তেলে রান্না করারও ব্যবস্থা আছে। দুপুরে লাঞ্চের পর আবার চলতে শুরু করলো বোট। ৫টা নাগাদ আবার দাঁড় করানো হল। স্ন্যাক্স টাইম। এবার এলো কফি, সাথে কলার পকোড়া। পাকা কলাকে বেসনে ডুবিয়ে ভাজা এই খাবার মুখে নাও রুচতে পারে। স্ন্যাক্স এর পর একটু সময় কাটানো যেতে পারে স্থানীয় বাজারে নেমে কেনাকাটি করে। অবাক হবেন না, ডাঙায় নয়, এই বাজার জলের ঝারে। নানরকমের মাছের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে মেছুঁয়ারা। বম্বে ডাক, চিংড়ি, ক্যাটল ফিশ আরও কত কী। যেটা চাইবেন কিনে নিতে পারবেন। তার পর আবার চলল বোট। আবার সেই জলরাশি।
সন্ধ্যে নামলে চালানো হল জেনারেটার। ফুরফুরে হাওয়ায় ডেকে বসে দেখতে পেলাম আস্তে আস্তে সূর্যের রং কেমন হলুদ, থেকে কমলা থেকে লাল হচ্ছে। আর তারপরেই টুপ করে ডুব ডিল নারকেল গাছের আড়ালে। আর বোটের কর্মচারীরা আমাদের হাতে তুলে দিলেন ছিপ। চারের জন্য কিছু আটাও মেখে দিলেন। প্রচন্ড উৎসাহের সাথে শুরু হলো মৎসাভিযান। কিন্তু সফল হইনি কিউই। কিন্তু বোটের কর্মচারীদের উৎসাহে কোনো ভাঁটা পড়েনি। তারপর ঘরে গেলাম। টিভি চালানো হলো। কিন্তু বেশীরভাগই দক্ষিনী চ্যানেল। হিন্দি চ্যানেল ২-১টা ছিল, কিন্তু আমরা সন্ধ্যেটা কাটালাম দক্ষিনী নাচ দেখে। তারপর আবার ঘর থেকে বাইরে এলাম। রাতের অন্ধকারে জলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভুতি অদ্ভুত। যেন সারা পৃথিবীটা ফিসফিস করে কথা বলছে হাওয়ার সাথে। রাতেরবেলায় বোট চালানো হয় না।
কোনও একটা গাছের সঙ্গে শক্তপোক্ত করে বেঁধে রাখা হয়। এরমধ্যেই ডিনারের ডাক এলো। সকালের মতই মেনু শুধু মাছের বদলে মুরগি। খাওয়া শেষ করে যখন ঘরে এলাম এ.সি. চলছে। একটু গল্প করে ঘুমিয়ে পরলাম আরামে। প্রসঙ্গতঃ জানিয়ে রাখি, আমাদের হাউসবোটের চালক ছিলেন রাশভারী মানুষ। অন্যান্য বোটের সবাই কিছুক্ষনের জন্য বোটের স্টিয়ারিং হাতে নিচ্ছেন, ছবি তুলছেন, আমাদেরও শখ হলো। কিন্তু তিনি স্টিয়ারিং কিছুতেই ছাড়বেন না। পরদিন সকালে সে সাধও পূরণ হল। কিছুক্ষনের জন্য স্টিয়ারিং হাতে পেলাম। তাতেই চলল ফোটোসেশান। পরদিন সকালে ৯টা নাগাদ বোট থেকে নামলাম। পাংচুয়ালিটি সত্যি তারিফ করবারঅই মত। ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল আলেপ্পিতে। এবার যাত্রা শুরু হল কোভালামের পথে।
আলেপ্পি থেকে কোভালাম যাবার পথের রাস্তা অসাধারণ। চারপাশ সবুজে ঢাকা। আর সে সবুজের আবার নানা ডাইমেনশন। দু’পাশের জঙ্গল ভেদ করে একফালি রাস্তা সোজা গেছে কোভালামের দিকে। যাওয়ার পথে একফাঁকে কাওদিয়ার রাজবাড়িটাও দেখে নিলাম। তারপরে রাস্তার ধারেই লাঞ্চ সারলাম কেরলিয়ান থালি দিয়ে। তাতে ছিল ভাত, সাম্বার, সবজি আর মিষ্টি ক্ষীর। গোটা একটা জগ ভর্তি সাম্বার আমার কাছে একটা চমক ছিল। কোলকাতায় জগে করে ডাল দিতে কোথাও দেখিনি। তারপর রাস্তায় এক জায়গায় নারকেল দেখতে পেয়ে দাঁড়ালাম। বিরাট সাইজের নারকেল। দুটো নারকেলের জল খেতে চারজনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এই প্রথম জানলাম কেরলে জলের নাম ‘তন্নি’।
প্রায় ২টো- আড়াইটে নাগাদ আমরা পৌঁছলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম সমদ্রে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও আমি এর আগে কখনো সমুদ্রে যাইনি। কোভালাম বিচে দেকে আমি অভিভূত। এত সুন্দরও কোনও জায়গা হতে পারে, কল্পনাও করতে পারিনি। পেঁপে, কলা, নারকেল গাছে ছাওয়া কোভালাম বিচ দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো। নীল আকাশের নীচে ফিরোজ়া সমুদ্র, প্রসস্ত বেলাভূমি আর লাইন দিয়ে জুড়ে ছোট বড় রেস্তরাঁ। কোনওভাবেই মনে হয় না ভারতের কোথাও আছেন। ৩০ বছর আগে কোভালাম ছিল হিপ্পিদের পীঠস্থান। এর পরেও আমি কয়েকবার সমুদ্রে গেছি, কিন্তু এই ধরনের এত সুন্দর বিচ আর কোথাও পাইনি। যাই হোক, বিস্ময় দৃষ্টিতে আমি কোভালাম বিচের রূপ দেখছিলাম। জলে নামার কোনও প্ল্যান ছিল না, কিন্তু বন্ধুদের চাপাচাপিতে নামতে বাধ্য হলাম। ঘন্টা খানেক জলে দাপাদাপি করে যখন উঠলাম খেয়াল হল সাথে শুকনো কাপড় নেই কোনও।
ড্রাইভার বেচারা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল ভেজা কাপড়ে গাড়িতে ওঠা যাবে না। অতয়েব গাড়িতে রাখা তোয়ালে জড়িয়ে ফিরলাম হোটেলে। ডিনার সারলাম স্থানীয় দোকানের বরোটা (ছোটো সাইজের পরটা) আর চিকেন কষা দিয়ে। পরদিন সকালে উঠে আবার গেলাম সমুদ্রতটে। কোভালাম বিচকে চার টুকরোতে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বদক্ষিণ লাইটহাউজ় বিচ। আয়তনে বেশি বড় নয়, তবে দোকানপাটের সংখ্যা প্রচুর। বাঁধানো সমুদ্রতট ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট ‘শ্যাক। সামনে লাইন দিয়ে সাজানো কাঁচা সামুদ্রিক মাছ। পমফ্রেট, ম্যাকারেল, চিংড়ি, হেরিং সব পাবেন এখানে। বেছে দিতেই টেবল হাজির গরম গরম ফ্রায়েড কিংবা গ্রিলড ফিশ। সঙ্গে চিলড বিয়ার। বাঙালিদের চেয়ে বিদেশীদের ভিড়ই বেশি এই সব শ্যাক। লাইটহাউজ় বিচে বিদেশীদের সংখ্যা এতই বেশি যে দেখলে কোনও ফ্রেঞ্চ কলোনি বলেও ভুল হতে পারে। খাওয়াদাওয়া সেরে চলে হয়ে চলে গেলাম কন্যাকুমারী। কন্যাকুমারীতে সারাদিন কাটিয়ে যখন ফিরলাম, তখন প্রায় সাড়ে আটটা-ন’টা বাজে। সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে।
ফুটের ধারে একটা দোকানে কোনওক্রমে বরোটা আর চিকেন ফ্রাই কিনে হোটেলে ফিরলাম। কিন্তু বিধি বাম। সারা ট্যুর জুড়ে যে জিনিসটা এড়িয়ে চলছিলাম, সেটারই গিয়ে শেষমেশ মুখোমুখি হতে হলো। বরোটা আর চিকেনটা দুটোই ছিল নারকেল তেলে ভাজা। আর তা আমাদের মুখে রুচলো না। ব্যাগ হাতরে চিপস, চানাচুর, বিস্কিট খেয়ে রাতটা কাটালাম। পরদিন সকালে উঠে বেরোলাম নতুন কোনো ব্রেকফাস্টের লোভে। পেলামও, নাম কুট্টু। ময়দার উপর নারকেলের কোটিং দিয়ে সেটা বাঁশের মধ্যে ঢুকিয়ে স্টিমে বয়েল করা হয়। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা আবার বেরিয়ে পরলাম তিরুবনন্তপুরমের পথে। আর সঙ্গে থেকে গেল কিছু অনন্যসুন্দর মুহূর্তের ছবি।
সাকুব আজ়ম