সমুদ্র কার না ভালো লাগে! বড়ো ছোটো মাঝারি ঢেউয়ের মাতামাতি৷ বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে পা ভেজানো বা শুধুই জলে রঙের খেলা দেখা, সবই মনপসন্দ৷ সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝাও যায় না৷ হাতে ক’দিনের ছুটি থাকলে সটান চলে যান কোভালাম৷ লিখছেন অদিতি ভট্টাচার্য
কোভালাম আরব সাগরের তিরে কেরলের একটি ছোট সৈকত শহর৷ তিরুবনন্তপুরম থেকে যার দূরত্ব ষোলো কিলোমিটারের মতো৷ কোভালাম কথাটার মানে নারকেল গাছের বন৷ এই সমুদ্র সৈকত সত্যিই নারকোল গাছে ছাওয়া৷ কোভালাম এক সময় ছিল সমুদ্রের ধারে নির্জন একটি গ্রাম যেখানে প্রধানত মত্স্যজীবীরাই বসবাস করতেন৷ ১৯৩২ সালে ত্রিবাঙ্কোরের মহারানি সেথু লক্ষ্মীবাঈ এখানে তাঁদের নিজস্ব একটি রিসর্ট তৈরি করার পর এটি সবার নজরে আসে৷ তারপর সত্তরের দশক থেকে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে কোভালামের সমুদ্র সৈকতে৷ ক্রমশ এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ে অঠে৷
কোভালামের প্রধান আকর্ষণ আরব সাগর আর তার বেলাভূমি৷ এখানে সমুদ্রে মাঝে মাঝেই শিলাখণ্ড আছে৷ সমুদ্রের জল প্রতিনিয়ত ধাক্কা খাচ্ছে এইসব প্রস্তরে৷ সমুদ্র তাই এখানে বেশ অশান্ত৷ এর সঙ্গে বৃষ্টিভেজা মাতাল হাওয়া দোসর হলে তো আর কথাই নেই৷ কোভালামের সমুদ্র সৈকত সতেরো কিলোমিটার দীর্ঘ, আকারে এক ফালি চাঁদের মতো৷ মাঝে মাঝে এবড়ো খেবড়ো পাহাড় একে তিন টুকরো করেছে বা তিনটে আলাদা আলাদা বিচে ভাগ করেছে৷ কোভালাম বলতে তাই এই তিনটে বিচই বোঝায়৷
লাইটহাউস বিচ হল এর দক্ষিণতম অংশ৷ অপর দুটি বিচ হল ইভস বিচ এবং সমুদ্র বিচ৷ লাইটহাউস বিচ এবং ইভস বিচে সব সময়েই পর্যটকের যাতায়াত লেগে থাকে৷ বেশির ভাগ হোটেল, রিসর্টও এখানেই৷ সমুদ্র বিচ অন্য দুটির তুলনায় নির্জন৷
কী দেখবেন
সমুদ্র, তার বিস্তীর্ণ জলরাশি, ঢেউ-এর খেলা – এই দেখতে, উপভোগ করতেই কোভালামে আসা৷ বিচ বেশ সুন্দর, বিচের ধারের রাস্তাও সুন্দর বাঁধান৷ সেই রাস্তা ধরে উথালপাথাল জলকে সঙ্গী করে হাঁটতে বেশ লাগে৷ ধারে ধারে অনেক হোটেল, খাবারের দোকান আছে৷ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে খানিক জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে৷ গরম চা, কফির কাপে চুমুক দিতে-দিতে দেখুন পাথুরে সমুদ্রের তীরে নারকোল গাছে ছাওয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি সৈকতের শোভা৷ যদি তখন সূর্যের সেদিনের মতো বিদায় নেবার সময় হয় তাহলে তো কথাই নেই, আকাশের রঙের প্রতিফলন দেখতে পাবেন জলেও৷ দু চোখ ভরে দেখারই জিনিস বটে৷ সমুদ্রের এই এক মজা৷ কোথাও দৃষ্টি আটকায় না৷ জল, জল আর জল৷ এক সময় মনে হয় আকাশেই বুঝি মিশে গেছে৷ সৈকতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই দেখতে পেয়েছিলাম জেলেদের ব্যস্ততা, জাল নিয়ে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া আসা৷
এছাড়া সমুদ্র স্নানের মজা তো আছেই৷ জলে নেমে মিতালী পাতান ঢেউ-এর সঙ্গে৷ ইচ্ছে হলে সার্ফিংও করা যায়৷ কোভালাম বিখ্যাত আয়ুর্বেদ থেরাপির জন্যেও৷
কোভালামে থাকাকালীনই ঘুরে এসেছিলাম তিরুবনন্তপুরম থেকে৷ তিরুবনন্তপুরমের প্রধান দ্রষ্টব্য সুপ্রাচীন পদ্মনাভস্বামী মন্দির৷ এই সেই মন্দির যা বছর কয়েক আগে সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল ধনরত্নে ভরা গুপ্ত কক্ষ আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে৷ মন্দিরের ভেতরে ঢুকলে মনে হয় কয়েকশো বছর পিছিয়ে গিয়েছি৷ পাথরের দেওয়াল, পাথরের স্থাপত্য, প্রদীপের মৃদু আলো-সব মিলিয়ে মনে হয় এ কোথায় এলাম! গর্ভগৃহে রয়েছে অনন্ত শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুর বড় মূর্তি৷ মন্দিরে প্রবেশ করার নির্দিষ্ট পোশাক আছে৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুতি এবং উত্তরীয়৷ মহিলারা শাড়ি পরলে অসুবিধে নেই, কিন্ত্ত অন্য যে কোনও পোশাক পরিহিত থাকলে তার ওপরেই ধুতি পরে মন্দিরে যেতে হবে৷ ধুতি দেখলাম ভাড়া পাওয়াও যাচ্ছে৷ মন্দিরে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করা যায় না৷ এছাড়া আছে শঙ্খমুঘম বিচ৷ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ছিলাম এই বেলাভূমিতেও, বেশ সুন্দর এই বিচটাও৷
সব মিলিয়ে বলা যায়, সমুদ্রের ধারে ক’টা দিন কাটাতে চাইলে কোভালাম এক আদর্শ স্থান৷ এখানে এসে কখনোই মনে হবে না ভুল করেছেন৷ আর ফিরে যাওয়ার সময় আবার এখানে আসার ইচ্ছে মনে রয়ে যাবে৷
কখন যাবেন
কোভালামে বছরের যে কোনও সময়েই যাওয়া যায়৷ তবে সবচেয়ে ভালো সময় সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস৷ সঙ্গে ছাতা, রোদ চশমা রাখবেন৷ সান ট্যানড হতে না চাইলে ভালো সান স্ক্রিন লোশন সঙ্গে রাখাও জরুরি৷ শীতকালে এলে হালকা শীত বস্ত্র নিয়ে আসবেন৷
কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে বিকেল বেলা চেন্নাই সেন্ট্রালে পৌঁছে ওখান থেকে ত্রিভানদ্রাম মেইলে তিরুবনন্তপুরম পৌঁছে যেতে পারেন পরের দিন সকালে৷ এছাড়া আছে শালিমার ত্রিভানদ্রামে এক্সপ্রেস, এটি শালিমার স্টেশন থেকে প্রতি মঙ্গল এবং রবিবার ছাড়ে৷ বিমানে গেলে যেতে হবে তিরুবনন্তপুরম বিমান বন্দরে৷ কোভালাম এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে৷
কোথায় থাকবেন
কোভালামের সমুদ্র সৈকতে অনেক হোটেল, রিসর্ট আছে৷ নানা ধরণের৷ নিজের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে কোনও একটি বেছে নিতে অসুবিধে হবে না৷
গ্রিন টিপস
সমুদ্র সৈকত পরিচ্ছন্ন রাখুন৷ ডাবের জল খেয়ে খোলাটা ওখানেই যেখানে সেখানে ফেলে দেবেন না৷ সমুদ্র সমুদ্রই, তাকে বিশাল এক ডাস্টবিন ভেবে আবর্জনা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবেন না৷
লিখছেন অদিতি ভট্টাচার্য