বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০০ পূর্বাহ্ন

কেন চীনা বিলিয়নিয়ারদের চুম্বকের মতো টানছে সিঙ্গাপুর

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩
গত এক দশকে সম্পদ ব্যবস্থাপনার জগতে বড় ধরনের উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। মনিটরি অথরিটি অব সিঙ্গাপুরের (এমএএস) সিঙ্গাপুর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, সিঙ্গাপুরের ব্যবস্থাপনায় ২০১৩ সালে সম্পদ ছিল ১.৮২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে কয়েকগুণ বেড়ে ৫.৪ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে।

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিঙ্গাপুরের। এর মধ্যেই দেশটিতে অতিধনীদের স্থাপিত পারিবারিক অফিসগুলো সিঙ্গাপুরের সম্পদ আরও বৃদ্ধিতে ব্যাপক আশা দেখাচ্ছে।

সরকারি হিসাব অনুসারে, সিঙ্গাপুরে ২০১৮ সালে অতিধনীদের পারিবারিক অফিস ছিল মাত্র ৫০টি। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০০টিতে। এরপর ২০২১ সালে দেশটিতে অতিধনীদের মোট পারিবারিক অফিসের সংখ্যা ৭০০টিতে দাঁড়ায়। তবে কিছু ইন্ডাস্ট্রির ধারণা এই সংখ্যা প্রায় ১,৫০০ এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

নগরভিত্তিক এই দেশটির কর্তৃপক্ষ এখন তাদের নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে, কর প্রণোদনার যোগ্যতার শর্ত কঠোর করা হলেও এসব বিনিয়োগকারীদের নিয়ে তাদের আর কোনও শঙ্কা নেই বলে তারা মনে করছে।

২০২২ সালের গোড়ার দিকে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়ন করে যে, পারিবারিক অফিসগুলোর ন্যূনতম তহবিলের আকার ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে হবে এবং এটিকে দুই বছরের মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের তহবিলের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বা ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে আদেশ জারি করে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ, যা স্থানীয় বাজার অনুযায়ী তুলনামূলক কম বিনিয়োগ।

চীনা পরিবারগুলোর অর্থের স্রোত

পারিবারিক অফিস হাব হিসেবে ক্রমেই সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চীনা ধনী পরিবারগুলোর প্রবাহের কারণে এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে। কেননা, আন্তর্জাতিক আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে সিঙ্গাপুরের সুশাসন, আইনের শাসন এবং স্থিতিশীলতার জন্য সুনাম রয়েছে এবং এটি চীনা পরিবারগুলোকে সেখানে অর্থ বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এশিয়ার দিকেও ধাবিত হচ্ছে। ঠিক এই সময়ে অঞ্চলটিতে বিশেষ করে চীনে সম্পদের বড় সঞ্চয় দেখা যাচ্ছে। হুরুন গ্লোবাল রিচ লিস্ট অনুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বের নতুন বিলিয়নিয়ারদের ৬০ শতাংশেরও বেশি ছিল চীনের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকেই হংকং থেকে অর্থ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা, ২০১৯ সালের গণবিক্ষোভ এবং শহরটির উপর চীনের কড়া পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা নাড়িয়ে দেয়। এতে দীর্ঘমেয়াদে বেইজিংয়ের এখতিয়ারের মধ্যে থেকে সেখানকার বিনিয়োগকৃত সম্পদ নিয়ে উদ্বেগ পড়েন তারা।

হুরুন ওয়েলথ রিপোর্টের প্রধান গবেষক রুপার্ট হুগেওয়ার্ফের মতে, শুধুমাত্র ২০২২ সালেই হংকং ৩,০০০ অতি সম্পদশালী ব্যক্তি হারিয়েছে। অন্যদিকে, এই সময়ে সিঙ্গাপুর ভিড়িয়েছে ২,৮০০ ধনী ব্যবসায়ী।

হংকং-এ বিনিয়োগকৃত সম্পদ চীনের আরোপিত বৈদেশিক মুদ্রার মূলধন নিয়ন্ত্রণের অধীন নয় এবং সহজেই সিঙ্গাপুরের মতো অন্যান্য অর্থনৈতিক কেন্দ্রে স্থানান্তরযোগ্য।বিশ্বের অন্যান্য অর্থনীতির সাথে হংকংয়ের ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং সুরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যা দ্বিমুখী বিনিয়োগ প্রবাহকে আরও সহজ করেছে।

সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য সংযোগ ও সম্পদ উপদেষ্টা দক্ষতা

পারিবারিক অফিস হল সিঙ্গাপুরের মতো দেশে অভিবাসনের একটি পন্থা, যেখানে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের স্থায়ী বসবাসের জন্য একটি গ্লোবাল ইনভেস্টর প্রোগ্রাম রয়েছে।

তাছাড়া সেখানে শক্তিশালী দ্বিভাষিক শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ। এই বিষয়টি ধনী চীনাদের তাদের পরিবারকে এখানে স্থানান্তরিত করতে এবং তাদের সন্তানদের জন্য একটি ভাল শিক্ষা এবং উন্নত জীবনযাপনের পরিবেশ হিসেবে আকৃষ্ট করছে।বর্তমানে যারা সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শিনের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস জু এবং হাইদিলাও প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ং এবং শু পিং।

একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে, সিঙ্গাপুর অতি-ধনীদের জন্য তাদের উত্তরাধিকার রক্ষায় প্রযুক্তিগত দক্ষতার শক্তিশালী সংমিশ্রণ প্রস্তাব করে। একই সঙ্গে সেখানে তাদের জন্য রয়েছে টেকসই অর্থ, অ্যাকাউন্টিং, আন্তর্জাতিক সালিসি এবং অন্যান্য পেশাদার পরিষেবার নিশ্চিয়তা। আরও রয়েছে শেয়ারভিত্তিক বেসরকারি কোম্পানির গড়ার সুযোগ। এসব ক্ষেত্রে দেশটির আইনকানুন খুবই বিনিয়োগ বান্ধব।

সিঙ্গাপুর ২০২০ সালে একটি নতুন পরিবর্তনশীল ক্যাপিটাল (মূলধন) কোম্পানি ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক চালু করেছে, যা পারিবারিক অফিসগুলোকে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে আরও আকর্ষণ করে এবং মনেটরি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমএএস) থেকে যোগ্য খরচের সহ-তহবিলের সুযোগ দেয়।

মেধা সংকটে ভুগতে পারে সিঙ্গাপুরের পারিবারিক অফিসগুলো

সিঙ্গাপুর দ্রুত বর্ধনশীল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সংযোগে বিনিয়োগের জন্য একটি গেটওয়েও প্রস্তাব করে, যা চীনের বাইরে তাদের পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য ধনী বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প। ফলে সময়ের সাথে সেখানে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা আরও বেগবান হচ্ছে।

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে আসিয়ান। ফলে এই অঞ্চলটি ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এবং তরুণ ও উদ্যমী কর্মীবাহিনীকে ব্যবসা ও স্টার্ট-আপ গড়ে তোলার জন্য প্রলুব্ধ করে।

একই সঙ্গে সবুজ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন বৃদ্ধির সুযোগও দেয় দেশটি। সিঙ্গাপুর পাঁচটি ডিজিটাল অর্থনীতি অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এগুলো হল- নিউজিল্যান্ড, চিলি, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক বন্ধন

চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের ধাক্কার মধ্যে, সিঙ্গাপুর এবং চীনের মধ্যে সমৃদ্ধ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চীনা বিনিয়োগকারীদের দৃঢ় আশ্বাস প্রদান করে যে নগরভিত্তিক দেশটিতে তাদের সম্পদ বিনিয়োগের জন্য একটি নিরাপদ স্থান।

সিঙ্গাপুর এবং চীন উভয়ই একে অপরের সাথে নিজেদের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং- বেইজিং সফর করেন। এ সময় তিনি চার প্রবীণ চীনা নেতা – প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং, ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ঝাও লেজি এবং চীনা পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংয়ের সাথে বৈঠক করেন, যা চীনে সফরকারী কোনও সরকার প্রধানের জন্য একটি বিরল ঘটনা।

এ সময় উভয় পক্ষই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি “সর্ব-রাউন্ড উচ্চ-মানের ভবিষ্যত-ভিত্তিক অংশীদারিত্ব”-এ উন্নীত করতে সম্মত হয়েছে, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও প্রসারিত করার এবং ডিজিটাল ও সবুজ অর্থনীতি, অর্থ ও বিমান চলাচলে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রগুলো অন্বেষণের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করা হয় এই সফরে।

এ সময় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীন ও সিঙ্গাপুরের সম্পর্ককে “দূরদর্শী, কৌশলগত এবং অনুকরণীয়” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, তারা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথে চীনের সম্পর্কের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে।

দুই দেশের কয়েক দশকের পারস্পরিক সহযোগিতা বিনিয়োগকারীদের আস্থার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের অভ্যন্তরে সিঙ্গাপুর এমন একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃত যেটি ১৯৭০-এর দশকের পরে চীনের সংস্কার এবং উন্মুক্তকরণে সবচেয়ে প্রথম এবং সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, এবং এটি চীনের আঞ্চলিক উন্নয়নে গভীর সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও সিঙ্গাপুর ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি বজায় ছিল। বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে চীনের সাথে সিঙ্গাপুরের পণ্য বাণিজ্য ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

সিঙ্গাপুর ২০১৩ সাল থেকে চীনের বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশটির বড় তিনটি ব্যাংক- ডিবিএস, ইউওবি এবং ওসিবিসে- চীনের বড় বড় শহরে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

পারিবারিক অফিসের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুর এশিয়ায় একটি প্রতিযোগিতামূলক পারিবারিক অফিস হাব হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে এবং চীনা বিলিয়নিয়াররা সেখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক আর্থিক কেন্দ্রের মর্যাদা, দক্ষ শাসন ও দীর্ঘকাল ধরে রাখা খ্যাতি, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো, সু-উন্নত অবকাঠামো এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে সরকারের ব্যবসা ও বিনিয়োগ-বান্ধব নীতির কারণে, সিঙ্গাপুর একটি জনপ্রিয় বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য জায়গা থেকে ধনী ব্যবসায়ী, ধনী পরিবার এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা সেখানে বিনিয়োগ করছেন। সূত্র: দ্য স্ট্রেইটস টাইমস

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com