পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের ১৮ কিলোমিটার এলাকা লোকারণ্য। সৈকতের যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। কেউ সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, কেউবা সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, শামুক-ঝিনুকের দোকান, রাখাইন মহিলা মার্কেটসহ সব জায়গায় পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। শারদীয় দুর্গোৎসবের ছুটির শেষ দিন রবিবার (১৩ অক্টোবর) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পর্যটকে এমন সরব ছিল সাগরকন্যা হিসেবে পরিচিতি কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত।
গত চার দিনের ছুটিতে দেশের অন্যতম এই পর্যটনকেন্দ্রে লাখো পর্যটকের আগমন ঘটেছে। রবিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমে মীরা বাড়ি পর্যন্ত এবং পূর্ব দিকে জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন এলাকার বিরাট অংশজুড়ে পর্যটকদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে সৈকত ও এর আশপাশের এলাকার পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় দেখা গেছে। আবার এদিন বিকাল থেকে অনেকে গন্তব্যে ফিরেছেন।
পর্যটকদের ব্যাপক উপস্থিতিতে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট, সীমা বৌদ্ধবিহার, মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহার, ইলিশ পার্ক, লেম্বুর চর, শুঁটকিপল্লি, গঙ্গামতী সৈকত, জাতীয় উদ্যানসহ আকর্ষণীয় সব স্পট মুখর। অনেকে সাগরের জলরাশিতে স্পিডবোট ও ওয়াটারবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ সাগরের নোনা জলে নেমে গোসল করছেন। অনেকে আবার সৈকতের কিটকটে (ছাতাযুক্ত চেয়ার) বসে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ গঙ্গামতী সৈকত, ফাতরার বন ও আশার চরের দিকে যাচ্ছেন। অনেকে রাখাইন মহিলা মার্কেট, ঝিনুক-আচার মার্কেট, শুঁটকিপল্লিতে কেনাকাটা করেছেন।
পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গাপূজার ছুটিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা চার দিনে লক্ষাধিক পর্যটক এসেছেন কুয়াকাটায়। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শত কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর এত পর্যটক আসায় এবং আশানুরূপ বেচাকেনা হওয়ায় খুশি ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ঈদের পর থেকে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে কয়েক মাস পর্যটকশূন্য ছিল কুয়াকাটা। এরপর বর্ষা মৌসুমেও ফাঁকা ছিল। এবার পূজার ছুটি ঘিরে লাখো পর্যটকের ঢল নেমেছে। এতে পর্যটনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। পর্যটনে সুদিন ফেরার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ সামনে আসছে শীত মৌসুম। এই সময়ে কুয়াকাটায় পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
হোটেল-মোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কুয়াকাটায় ছোট-বড় মিলিয়ে সমিতিভুক্ত ১৭৪টি আবাসিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। এগুলোতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যটক থাকতে পারেন। পাশাপাশি আরও কিছু হোটেল-মোটেল আছে। সেগুলোতেও থাকার ব্যবস্থা আছে। অতিরিক্ত চাপ হলে হোটেলগুলোতে আরও কয়েক হাজার পর্যটক গাদাগাদি করে রাতযাপন করতে পারেন। সবমিলে গত চার দিনে সবগুলো হোটেল-মোটেলের সব কক্ষ পর্যটকে পরিপূর্ণ ছিল। গত ঈদের পর এবার পূজায় লাখো পর্যটক এসেছেন।
আবাসিক হোটেল-মোটেলের কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পূজার ছুটির আজ শেষ দিন। কুয়াকাটায় আজও অর্ধলক্ষাধিক পর্যটক আছেন। কেউ কেউ ছুটি কাটিয়ে বিকাল থেকে বাড়িঘরে ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আজও আসছেন। যারা এখনও আছেন তারা শেষ বিকালে সাগরের জলরাশি দেখা ছাড়াও একই স্থান থেকে উপভোগ করবেন সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য। ছুটি শেষে ফিরবেন তারাও।
ট্যুরিস্ট পুলিশ জানিয়েছে, পর্যটকদের প্রচুর আগমনের কারণে ট্যুরিস্ট পুলিশের কয়েকটি দল মাঠে কাজ করছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় বরাবরের মতো তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লক্ষাধিক পর্যটকের ভিড়ে কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সবগুলো স্পটে নজর ছিল ট্যুরিস্ট পুলিশের।
কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা ছুটি কাটিয়ে আজ রাতে ফিরে যাবেন নিজ নিজ গন্তব্যে। ঢাকা থেকে আসা বিথি আক্তার সাথি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগেও কুয়াকাটা এসে সৈকতে নানা অব্যবস্থাপনা দেখেছি। এবার অনেক পরিবর্তন দেখলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেশ তৎপর দেখেছি। আসলে সমুদ্রের বিশালতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করে। এজন্য পরিবার নিয়ে ছুটে আসি। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত একই স্থানে দাঁড়িয়ে দেখেছি। আমার কাছে কুয়াকাটা একটি নিরাপদ পর্যটন-নগরী মনে হয়। এরই মধ্যে চার দিনের ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আজ রাতে আমরা ঢাকায় ফিরবো।’
পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে আসা হাসান মাহবুব বলেন, ‘কুয়াকাটা আসলেই অসাধারণ পর্যটনকেন্দ্র। আমরা অনেকগুলো স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি। অসাধারণ আনন্দে চার দিন পার করলাম। আজই রাতেই ফিরবো।’
আরেক পর্যটক আলী হোসেন বলেন, ‘কুয়াকাটা দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। শিল্প এবং দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। অথচ কুয়াকাটা আসতে কলাপাড়া থেকে মহাসড়কের অবস্থা বেহাল। এই সড়কটি সংস্কার করা হলে পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণে আসতে পারবেন। পর্যটকও আরও বাড়বে।’
পর্যটকদের ঘিরে সৈকত ও এর আশপাশের বিভিন্ন খাবারের রেস্তোরাঁগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে। রেস্তোরাঁগুলোতে ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে আছে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ। ফিশ ফ্রাই ব্যবসায়ী তৈয়বুর রহমান বলেন, ‘পর্যটক বাড়ায় বিক্রিও বেড়েছে। টুনা ফিশ, কোরাল, চিংড়ি, লবস্টার, রুপচাঁদা বেশি বিক্রি হচ্ছে। মাছভাজা দোকানিদের অনেকে দিনে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিক্রি করেছেন। এবার আশা করেছিলাম, তার থেকেও অনেক বেশি পর্যটক এসেছেন। বেচাকেনাও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়েছে।’
শুঁটকিপল্লির ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চার দিনের ছুটিতে দুই লাখ টাকার মতো বেচাকেনা হয়েছে। শুঁটকিপল্লির সব দোকানে কমবেশি বেচাকেনা হয়েছে। সামনে পর্যটন মৌসুম। আশা করছি, আগের বছরগুলোর তুলনায় পর্যটক আরও বেশি আসবে। সেইসঙ্গে বেচাকেনাও বাড়বে।’
চার দিনের ছুটিতে কত টাকার বেচাকেনা হয়েছে জানতে চাইলে কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চার দিনে আমাদের জানামতে, লক্ষাধিক পর্যটক এসেছেন। সবমিলিয়ে ৫০-৬০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়েছে। তার চেয়ে আবার বেশিও হতে পারে। তবে এবার পূজাতে আশানুরূপ পর্যটকের ভিড় ছিল। আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।’
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও হোটেল খাঁন প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টানা ছুটিতে সবগুলো হোটেল-মোটেলের কক্ষ শতভাগ বুকিং ছিল। এমনকি অনেক পর্যটক হোটেলে কক্ষ না পেয়ে ফিরে গেছেন। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অনেক পর্যটক স্থানীয়দের বাসাবাড়িতে ছিলেন। এজন্য আমরা চাচ্ছি আরও হোটেল-মোটেল বাড়াতে। যাতে পর্যটকদের এখানে এসে ভোগান্তিতে পড়তে না হয়। তবে এবারের পূজার ছুটিতে ব্যতিক্রমী প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ছিল। এখন পর্যন্ত কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সবগুলো স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল ছিল।’
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. আনসার উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যটকদের নিরাপত্তায় আমরা সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছি। সাদাপোশাকে আমাদের সদস্যরা টহলে আছেন। পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনও প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশসহ গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত ছিল এবং আছে। আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তায় দিনরাত নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সেবার মান সামনে আরও বাড়বে।’
বাংলা ট্রিবিউন