মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিনই বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। জুলাই মাসের প্রথম ২৫ দিনেই অন্তত ৩০০ বাংলাদেশি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে কিছু নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
এই তালিকায় ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, ভিয়েতনামের নাগরিকও রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন বাংলাদেশিরা এবং সংখ্যা সর্বোচ্চ। কাজেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক-বাংলাদেশিদেরই বেশি টার্গেট কেন?
মালয়েশিয়ার বর্ডার কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রোটেকশন এজেন্সির (BCPA) তথ্যমতে, ২৫ জুলাই পর্যন্ত কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে মোট ৪২৮ জন বিদেশিকে। এর মধ্যে ৪০০ জনই বাংলাদেশি। শুধু ২৫ জুলাই সাত ঘণ্টার বিশেষ অভিযানে ৮০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। একই দিনে ফেরত যান আরও ১০ জন ভারতীয় ও ৯ জন পাকিস্তানি নাগরিক। এর আগে, ২৩ জুলাই ফেরত পাঠানো হয় ১৯৮ জন বিদেশিকে। এদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ১২৩ জন। ১১ জুলাই ফেরত পাঠানো হয় ৯৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রম বাজার। কিন্তু ২০২৪ সালে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে কাজের সুযোগ কমে যায়- এ বছর আরও কমে আসে। তবে টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশিদের যাওয়া স্বাভাবিক থাকে। বিশেষ করে গত বছর আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যান্য দেশে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় সহজ গন্তব্য হয়ে ওঠে মালয়েশিয়া। তবে চলতি জুলাই থেকে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশিদের ওপর কড়াকড়ি শুরু করলে ভ্রমণের সেই পথেও বড় ধাক্কা লাগে।
মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, সাম্প্রতিক এক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ইসলামিক স্টেট (আইএস) সংশ্লিষ্ট একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার পর থেকে এই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। অভিযানে ধৃত ৩৬ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বাকি ১৬ জন এখনো তদন্তাধীন।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল বলেছেন, “জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আমাদের ভূখণ্ডকে কোনো জঙ্গি সংগঠনের অপারেশনাল ঘাঁটি বা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।”
বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সির একাধিক কর্মকর্তা আকাশযাত্রার সঙ্গে আলাপকালে জানান, ভিসার অপব্যবহার, ভুয়া হোটেল বুকিং, জাল ডকুমেন্ট এবং ফেরত টিকিট না থাকা এসব সমস্যার মূল কারণ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাভেল এজেন্সি নির্বাহী বলেন, “সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের পর মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বাংলাদেশিদের ব্যাপারে অধিক সতর্ক। অনেক পর্যটক প্রকৃত কাগজপত্র না থাকার কারণে বিমানবন্দরেই আটকে পড়ছেন।”
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হাই রিস্ক’ দেশের তালিকা প্রকাশ না করলেও কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের বাস্তবতা বলছে, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসা ফ্লাইটগুলো বিশেষ নজরদারির মধ্যে রয়েছে। এসব ফ্লাইটের যাত্রীদের প্রতিদিনই দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ, ডকুমেন্ট যাচাই এবং প্রমাণাদির খুঁটিনাটি যাচাইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে অনিয়ম ধরা পড়ছে এবং অনেকে বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে চাকরিতে গিয়েছিলেন। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৯৩ হাজারে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান মাত্র ২,৪৮৬ জন বাংলাদেশি কর্মী—যা এই তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভ্রমণ ভিসায় যাওয়া এবং পরবর্তীতে অবৈধভাবে কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়াই মূলত এই সমস্যার পেছনে দায়ী। সঙ্গে সাম্প্রতিক জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতিতে মালয়েশিয়ায় ভ্রমণ বা কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশিদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যথায় বৈধ যাত্রীদেরও হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।