বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন

কীভাবে জন্ম হয়েছিলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০২৩

মধ্যপ্রাচ্যে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জন্ম হয়েছিল এক নতুন দেশের – যার নাম সংযুক্ত আরব আমিরাত । দেশটির অর্থনীতির ভিত্তি ছিল তেল থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয়। কিভাবে এ দেশটি মরুভূমি থেকে আধুনিক মরুদ্যানে পরিণত হলো – ইতিহাসের সাক্ষীর এ পর্বে তারই গল্প বলেছেন সেদেশের এক প্রবীণ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল ফাহিম । সাথে কথা বলেছেন বিবিসির লরা জোনস।

“আমাদের কিছুই ছিল না । পানি ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা থাকতাম জেলেদের একটা গ্রামে। জীবন ছিল একেবারেই অনুন্নত। আমাদের কোন স্কুলও ছিল না।”

মোহামেদ আল ফাহিমের জন্ম ১৯৪৮ সালে। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন আজকের আবুধাবির আল-আইনের এক মরুভূমিতে, একটি বড় পরিবারে।

আবুধাবি সেসময় ছিল ব্রিটিশ অভিভাবকত্বে থাকা সাতটি ছোট ছোট রাজ্যের একটি । কয়েকটি আরব উপজাতির বাসভূমি এই রাজ্যগুলোর প্রধানরা উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সরকারের সাথে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ।

মোহামেদ অবশ্য তার শৈশবে এসব কিছুই জানতেন না। কিন্তু তার পরিবারকে চিরকাল মরুভূমিতে থাকার ভাগ্য বরণ করতে হয়নি।

“বালু – চারদিকে শুধু বালু। কোন কংক্রিটের ইমারত সেখানে ছিল না। বেশিরভাগ বাড়িতেই ছিল পাতার তৈরি চালা। অর্ধেক লোক থাকতো তাঁবুতে। আমাদের পরিবারও তাঁবুতে থাকতো।” বলছিলেন মোহামেদ।

“অবশেষে ১৯৬০এর দশকে আমার বাবা দুটি ঘর বানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোন আধুনিক সুযোগ সুবিধা ছিল না। কোন টয়লেট বা বাথরুম ছিল না। সেজন্য আমাদের মরুভূমিতে যেতে হতো।“

আল-আইন : হাইওয়ের পাশে মরুভূমি আর উটের সারি

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আল-আইন : হাইওয়ের পাশে মরুভূমি আর উটের সারি

“বালুর ওপর সারা দিন থেকে আমরা কিভাবে সুখী হতে পারি? সন্ধ্যা হলে আমরা বাড়ির ছাদে উঠতাম বা প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বাইরেই ঘুমোতাম।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তেল কোম্পানিগুলো আবুধাবিতে তেল অনুসন্ধান করছিল। ১৯৫৮ সাল নাগাদ তারা যা খুঁজছিল তা পাওয়া যায়।

বিবিসির সংবাদদাতা তখন এক রিপোর্টে এখানে তেল পাওয়ার খবর বর্ণনা করেছিলেন এইভাবে:

“বালুর ওপর দিয়ে তেল উপচে পড়ছে। সেই তেল – যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বালিয়াড়ির নিচে চাপা পড়ে ছিল। এখন এই তেল এখান থেকে বহু দূরে গড়ে ওঠা যান্ত্রিক সভ্যতার দেশগুলোর প্রয়োজন মেটাবে। আর এই মরুভূমির বাসিন্দা মানুষদের আদিম জীবনধারার প্রতি নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে, হয়তো হুমকি তৈরি করবে এখানকার শাসক শেখ শাখবাতের সরল ব্যক্তিগত ক্ষমতার প্রতি।”

এই আবিষ্কার আবুধাবি ও তার অধিবাসীদের ভাগ্য চিরকালের জন্য বদলে দেয়।

তবে শুরুর দিকে আবুধাবির শাসক শেখ শাখবাত প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন মরুভূমির চিরাচরিত জীবনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে।

কিন্তু একজন – যিনি মোহামেদ ও শেখ শাখবাত উভয়েরই ঘনিষ্ঠ ছিলেন – তিনি অপেক্ষা করছিলেন এমনি এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য।

তিনি হলেন রাজপরিবারের আরেকজন সদস্য – শেখ জায়েদ।

আবুধাবির উপকুল একসময় ছিল মৎস্যজীবীদের গ্রাম

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আবুধাবির উপকুল একসময় ছিল মৎস্যজীবীদের গ্রাম

জায়েদ ছিলেন শেখ শাখবাতের ভাই এবং তার একজন প্রতিনিধিও। শাখবাতের কাছ থেকে তিনি পেতেন বছরে তিন লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড।

বিবিসির সংবাদদাতা বলেছিলেন, জায়েদ কিন্তু তার ভাইয়ের মত ছিলেন না। তিনি এ অর্থ ব্যয় করতেন তার জনগণের জন্য কৃষি আর অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য।

শেখ শাখবাতের সাথে তার আরেকটি তফাৎ হলো শেখ জায়েদ ছিলেন উদারহস্ত এবং জনপ্রিয়।

নবলব্ধ এই ধনসম্পদকে কাজে লাগানোয় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।

বিবিসির সংবাদদাতাকে তিনি বলেছিলেন, ১০ বছর পরে আপনি যদি আবার এখানে আসেন – তাহলে এ জায়গাটা চিনতেই পারবেন না।

বিবিসির সংবাদদাতা বলছিলেন, “আমার তখন আবুধাবিতে থাকা তার দ্বিধাগ্রস্ত ভাইয়ের কথা ভাবলাম। জায়েদের এ মন্তব্যটি যেন দুধারী তলোয়ারের মতো বলে আমার মনে হলো।”

মোহামেদের বাবার সাথে শেখ জায়েদের বন্ধুত্ব ছিল ছোটবেলা থেকেই । তিনিই এখন হলেন শেখ জায়েদের একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা।

আবুধাবির শাসক শেখ শাখবাত - ১৯৬০এর দশকের ছবি

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আবুধাবির শাসক শেখ শাখবাত – ১৯৬০এর দশকের ছবি

মোহামেদ বলছিলেন, “সে দিনগুলো এমন ছিল যে আপনি যদি লেখাপড়া জানতেন তাহলে আপনার একটা ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। “

“কাজেই শেখ জায়েদ আমার বাবার সাথে দেখা করলেন। বললেন, তুমি আমার একজন সহকারী হয়ে যাও। ফলে বাবা তার সাথেই রয়ে গেলেন আরো ষাট বছর – একেবারে তার মৃত্যু পর্যন্ত।”

“শেখ জায়েদ আমাদেরকে তার নিজের সন্তানের মতই দেখতেন। আমরা যে কোন সময় তার সাথে দেখা করতে পারতাম। তিনিও নিয়মিত আমাদের বাড়িতে আসতেন। “

শেখ জায়েদ ১৯৬৬ সালে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান করে নিজেই আবুধাবির নিয়ন্ত্রণ নিলেন।

তিনি অপেক্ষা করছিলেন – দেশে বড় পরিবর্তন আনার সুযোগ পাবার এই মুহুর্তটির জন্য।

“১৬ বছর ধরে তিনি ছিলেন খুবই হতাশ। কারণ তিনি চাইতেন অর্থনীতিকে উন্নত করতে, এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে” – বলছিলেন মোহামেদ।

” ক্ষমতা গ্রহণ করার পর শেখ জায়েদ দেশটিকে উন্মুক্ত করে দিলেন। তিনি দেশের মানুষকে বেতন-ভাতা দিতে শুরু করলেন। হাসপাতাল, স্কুল, রাস্তাঘাট নির্মাণ করলেন। তেলের দাম যখন বেড়ে গেল, তখন সরকার আরো বেশি অর্থ খরচ করতে লাগলো, কারণ তখন দেশের আয় বেড়ে গিয়েছিল।”

শেখ জায়েদ

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
শেখ জায়েদ

ততদিনে মোহামেদ এবং কার পরিবারের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়েছে।

“আমার বাবা আমাদেরকে আল-আইন থেকে আবুধাবিতে নিয়ে এলেন। একটা দোকান খুললেন। আমাদের জীবন ক্রমশ সহনীয় হয়ে উঠতে লাগলো।”

শেখ জায়েদের ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই আবুধাবিতে পরিবর্তন আসতে লাগলো।

তবে সামনে ছিল আরো পরিবর্তনের হাতছানি। কারণ যুক্তরাজ্য ঘোষণা করেছিল যে তারা আর এই রাজ্যগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। এর প্রতিরক্ষার জন্য যেসব ব্যবস্থা ছিল সেগুলো ১৯৬৮ সালে তুলে নেয়া হলো।

বিবিসির সাংবাদিক মার্ক হেস্টিংস সেসময় তার এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, “সৈন্যরা ঘরে ফিরে যাবে, চুক্তিগুলো নতুন করে করা হবে। “

“ব্রিটিশদের উপস্থিতির ফলে এই রাজ্যগুলো এবং কাতার ও বাহরাইনের সাথে একটা শিথিল যোগাযোগ ছিল। এই নয়টি রাজ্যের সমস্যা হচ্ছে ব্রিটেন চলে গেলে তারা একা একা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে না, কারণ অতীতে তাদের মধ্যে যে সহিংস বৈরিতা ছিল তা ভুলে গিয়ে একসাথে থাকা তাদের পক্ষে কঠিন হবে।”

মোহামেদ বলছেন. ব্রিটিশদের উপস্থিতি এখানে কোন সংঘাত ঠেকানোর জন্য সহায়ক হয়েছে।

“তারা এখানকার শাসকদের মধ্যে শান্তি রক্ষা করেছে। এখানে উদ্বেগ ছিল যে ব্রিটিশ সেনা প্রত্যাহার হলে হয়তো আমাদের প্রতিবেশীরা বা অন্য যুদ্ধবাজরা সমস্যা সৃষ্টি করবে। কিন্তু এতদূর আসার মত ক্ষমতা বা উপায় তাদের ছিল না। “

আবুধাবির একটি তেলক্ষেত্র

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আবুধাবির একটি তেলক্ষেত্র

শেখ জায়েদের মাথায় একটা পরিকল্পনা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন সাতটি রাজ্যকে একত্রিত করে একটি স্থিতিশীল দেশ গড়ে তুলতে। যাতে তারা বৈরি প্রতিবেশীদের হাত থেকে সুরক্ষা পায় এবং তেল সম্পদকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারে।

কিন্তু অন্য নেতাদেরকে এতে রাজী করাতে কিছু সময় লেগেছিল।

“এ জন্য তার চার বছর লেগেছিল। তিনি অন্য নেতাদের দেশে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করতেন। তাদের রাজি করানোর চেষ্টা করতেন। ওই শাসকরা স্বাভাবিকভাবেই চাইতেন তাদের জনগণের জন্য যত বেশি সম্ভব সুবিধা পেতে ” – বলছিলেন মোহামেদ।

শেষ পর্যন্ত শেখ জায়েদ যা চেয়েছিলেন – তা সম্ভব হলো। কারণ অন্য রাজ্যগুলো দেখেছিল যে তিনি তার নিজ দেশে কীভাবে বিনিয়োগ করেছেন।

“তারা দেখেছিল – আবুধাবি আমিরাতে তিনি কী করেছেন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই আবুধাবি ও তার জনগণকে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ষোড়শ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। তাই অন্য আমিরাতগুলোও সেই উন্নয়নের অংশ হতে চেয়েছিল।”

আধুনিক দুবাই

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আধুনিক দুবাই

ফলে ১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর ব্রিটিশ প্রটেক্টরেটের অবসান হলো। আর তার অধীন রাজ্যগুলো পরিণত হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

প্রথমে এর সদস্য ছিল ৬টি। শারজাহ, ফুজাইরা, আজমান, উম আল-কুয়াইন, দুবাই আর আবুধাবি। পরের বছর যোগ দেয় রাস আল-খাইমা।

মোহামেদের পরিবারের সাথে শেখ জায়েদের সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ ছিল যে সেই নতুন রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলনের দিনও উপস্থিত ছিলেন মোহামেদ, দুবাইয়ের শাসকের পাশেই।

“আমি শেখ খালিফার পেছনেই ছিলাম। ইউএইর পতাকা ওড়ানো হলো, নামানো হলো আবুধাবির পতাকা। আমরা বুঝিনি যে এটা কত বড় ব্যাপার হতে যাচ্ছে। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে কেউ একজন সেটার একটা ছবি তুলেছিল।”

সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন অকল্পনীয়ভাবে বদলে গেছে।

তারা এখন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী। এটি বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার একটি কেন্দ্র এবং একটি পর্যটন কেন্দ্রও বটে।

আবু ধাবির একটি আধুনিক ভবন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আবু ধাবির একটি আধুনিক ভবন

মোহামেদ বলেন, “এই পরিবর্তনের জন্য আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দেই কারণ এই পরিবর্তন না হলে আমরা হয়তো অষ্টাদশ শতাব্দীতেই পড়ে থাকতাম। “

“শেখ জায়েদ আমাদের একটি দেশ দিয়েছেন, আর আমাদের জন্য সারা বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছেন।”

“আমরা বহুকাল বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম। আমরা আজ স্কুলে যেতে পেরেছি , বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট হতে পেরেছি। আমরাই প্রথম আরব দেশ যারা বিদেশীদের জন্য তাদের দরজা খুলে দিয়েছে। তারা এসেছে, এখানে কাজ করেছে, বিনিয়োগ করেছে, আমাদের দেশের উন্নয়নে অংশ নিয়েছে।”

মোহামেদ এখন আল-ফাহিম গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রধান । তিনি আমিরাতকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন – যার শিরোনাম ‘ফ্রম র‍্যাগস টু রিচেস।’

বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com