আমার বোনকে আমি আমার মায়ের সঙ্গে ফোনে যত ঝগড়া করতে শুনেছি, তার থেকে বেশি শুনেছি চুলায় রান্না দিয়ে আটকে যাওয়ার পর কী করতে হবে, তার সমাধানের জন্য শরণে। এসব শুরুর দিকের কথা, যখন ইউএস রোবোটিকসের ডায়াল আপ মোডেম দিয়ে ইন্টারনেটে যেতে হতো। ঘটমান বর্তমান একেবারেই আলাদা। বিরিয়ানির দম যে ওভেনেও দেওয়া যায়, সে আমার বোন নিজেই শিখে নিয়েছেন।
ওভেন শুধু কেক-রুটি-পিৎজা পাকাবার জন্যই যে নয়, তাঁরা রপ্ত করে নিয়েছেন নিজে থেকেই। রাইস কুকারে পোলাও? আলবত তবদা খাওয়ার মতো খিচুড়ি! এগুলোর সবই পরিচিত বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে। সে ঘর জাপানে হলেও কী, সাসকাচুয়ানের বিস্তীর্ণ সমভূমিতে হলেই-বা কী! খাবারের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এমন বিভুঁইয়ের ঘরে বাংলা খাবার না খাওয়ার রীতি এখনো তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। এ যদিও আমার ধারণামাত্র।
তাই কিশোয়ার নামের বাঙালি কন্যা-জায়া-জননীকে টিভির পর্দায় দেখে তাঁর মতন অনেকে সেঁটে গেছেন স্ক্রিনে! বিচারকেরা যখন জানতে চেয়েছেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলে তুমি?’ তার উত্তরে কিশোয়ার বলেছেন, ‘জাস্ট অ্যাট হোম।’ ভিজে গেছে স্ক্রিনের দুই পার।
কথায় আছে, যাঁদের রান্নাঘর যত বেশি নোংরা, তাঁদের খাবার নাকি তত বেশি মজাদার। এ একেবারে দেশি অনুযোগ। খাবার নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতায় একটি পালকমাত্র। পরিবেশ পরিস্থিতিতে যেকোনো চেনা জিনিসে পরিবর্তন আসে। কিশোয়ার যা করেছেন, তা আদতেই বাস্তবসম্মত ও স্বাভাবিক। আমাদের চেনা পরিচিত খাবারগুলোকে যে এভাবেও নিয়ে আসা যায়, তা-ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, সর্বজনীনের জন্য তা-ই প্রকাশ করেছেন কিশোয়ার। বিশাল সম্মানের ব্যাপার। কেননা খাবার প্রকৃতই স্বকীয়তার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, যা কিনা একটা জাতি, দেশ, ভূখণ্ডকে পরিচিতি দেয়। আইডেনটিটি, যা খাবারের মাধ্যমে তার খাদকদের দেয় একটা গ্লোবাল স্ট্যাটাস। কিশোয়ার আমাদের সেই সুবিধা দিলেন, সুযোগ দিলেন, যা আমাদের জন্য জরুরি ছিল।
যিনি রাঁধেন, তিনি শুধু আমরা খাব বলেই যে রাঁধেন, তা নয়। তাঁকে নিজের সব থেকে ভালোটা বের করে নিয়ে আসতে হয়। এ সবকিছুর মধ্যে যাতে উপকরণের বৈচিত্র্যও বেশি থাকে না। একই মাছ রোজ আমরা খাব না। কিন্তু ওই একই মাছ কতভাবে যে রান্না করা যায়, তা অঞ্চলভেদে, ব্যক্তিভেদে পালটে যায়। যদি একেবারে গ্রামবাংলার কথা ধরা হয়—পুরো প্রক্রিয়ায় মৌলিক একটা ব্যাপার থাকে। রান্নার এই শৈল্পিক নির্মাণে আমরা ভিন্ন দেশের খাবার নিয়ে যে আস্ফালন দেখাই, নিজেদের বেলায় তার খানিকটা ব্যত্যয় ঘটে বৈকি!
কিশোয়ার যখন তার গ্র্যান্ড ফিনালেতে পান্তা রাঁধলেন, কিছুটা কষ্ট পাওয়ার মতন ব্যাপার। এত এত জিনিস করে শেষ খেলায় কেন এই পান্তা, কেন বাবা! পান্তার অনেক বাহবা এখন এলেও এ যে বাহবা পাওয়ার মতন কোনো খাবার নয়, তা হয়তো ভুলে যাওয়াই হয়েছে। পান্তা কেন করা হয় বা পান্তা কেনই-বা এল, এই প্রশ্নের উত্তর উইকিপিডিয়াতে মিলছে না। খানিকটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল নানি-দাদি গোছের মানুষের সঙ্গে কথা বলে।
পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পান্তা খুব কমন একটা খাবার। ধান কাটা ও মাড়ার সময় কৃষকের লাঞ্চ মেন্যুতে পান্তা আনকমন এখনো নয়। পান্তা খুব ইজি। পান্তা খুব সিম্পল। পান্তা কষ্ট ইফেক্টিভ। পান্তা কোনো দিনও ‘পশ’ নয়। এর ওপর আমরা ঘি ছিটিয়ে দিলেও সে পান্তাই। এর মাঝে রাজকীয়তা নেই। ভণিতা নেই। পান্তা প্রয়োজনীয়তা আর ক্ষুধা নিবারণের নিয়ামকমাত্র। এর থেকে বেসিক কিছু হয় না। এর সঙ্গে কেবল শাড়ি বা ধুতিরই তুলনা করা চলে। একটা কাপড়কে আপনি কতভাবে পরতে পারেন, তা যাঁরা পরেন, তাঁরাই ভালো জানেন। দেখতে যদিও অবিকল এক লাগে। কিন্তু খানিক এদিক-ওদিক হলে আপনি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করতে চান, ঠিক তা-ই ফুটিয়ে তুলতে পারেন। উপকরণ একটিমাত্র থান কাপড়, যাকে আমরা শাড়ি বলি। এর থেকে সিম্পল কোনো পরিধিও আছে কি না, জানি না। পান্তাও ঠিক এমন। এর চেয়ে সাধারণ কিছু হয় কি না, জানি না!
খেলার শেষ সর্গে সবাই তাঁদের সেরাগুলো দিলেন। আমাদের কিশোয়ার দিলেন ফ্যান্টম পাঞ্চ। উনি মহাবীর মোহাম্মদ আলির মতো সনি লিস্টনকে পরাজিত করতে পারেননি। তৃতীয় হয়েও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে এমন এক খাবারের ফুট প্রিন্ট রেখে দিলেন, যা নিয়ে আগে কেউ কথা বলেনি। পান্তা-ইলিশের তকমা হালের ‘ওয়ান ডে স্ট্যান্ড’ হলেও বিশ্বদরবারে এর সিগনিফিকেন্স নেই একেবারে।
সেখানেই কিশোয়ারের বিজয়। এই সাহস মিশেলিন স্টাররা করবেন না। এই সাহস মুকুট হারাবার ভয়ে কেউ দেখাবেন না। অপরিচিত, অরাজকীয়, অপ্রশংসিত একটা খাবারকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য যে স্বকীয়তার তাড়না কাজ করে, তা প্রকাশ করার সাহস সবার থাকে না। এটাই কিশোয়ারের ফ্যান্টম পাঞ্চ। কিশোয়ারের সর্বত্র বিজয়। উনি গ্র্যান্ড ফিনালের মতো ভালো সুযোগ আর হাতছাড়া করেননি।
থ্যাংক ইউ কিশোয়ার। হয়তো-বা কোনো দিন পিকিং ডাকের সঙ্গে বং পান্তাও শোভা পাবে আলিশান রেস্তোরাঁর লেটার প্রেসে প্রিন্ট করা মেন্যুগুলোতে।
আপনার জয় হোক।