পাখির মতো মানুষের মনও উড়াল দিতে শুরু করলো । মানুষ আবার নেমে গেলো দূর দুরান্ত ভ্রমনে। আমাদের মনের পাখিটাও ডানা ঝাঁপটা দিয়ে জেগে উঠলো । মাথায় ঘুরা ঘুরি করতে লাগলো কোথায় যাই কোথায় যাই ? আমাদের এক বন্ধু রেজা ভাই ও নাসরিন ভাবীকে নিয়ে পরিকল্পনা করে ফেললাম আমরা ডোমিনিয়ান রিপাব্লিকানের রেসরট “ পুন্তা কানা “তে। যে ভাবনা সে কাজ। আহা কতো দিন ক্যানাডার বাইরে বেড়াতে যাই না। আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। ছেলে মেয়ের বাধা নিষেধ কিছুই আমাদের বেঁধে রাখতে পারলো না। আমরা উড়াল দিলাম “ পুন্তা কানা “ দিকে।
সারে তিন ঘণ্টার ফ্লাইট । খুব দ্রুত সময় কেটে গেলো । কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে তখন চিন্তাও করতে পারিনি। একের পর এক ফ্লাইট নামতে লাগলো বিভিন্ন জায়গা থেকে। এয়ার পোর্টের ভেতরে ঢুকার জায়গা নেই। গত তিন বছরের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে এয়ার পোর্টের কর্মীদের । প্লেন থেকে নামিয়ে আমাদের সব যাত্রীদের এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হোল বাসের ভেতরে। ভিতরের কিছু লোক হালকা হলে তারপর আমাদের ঢুকানো হবে। জীবনে এতো দেশ ঘুরেছি কিন্তু এই অবস্থা আমার কখনো দেখা হয় নি।
অবশেষে আমাদের গ্রীন সিগন্যাল এলো । বাস থেকে নেমে আমরা ভেতরে ঢুকার অনুমতি পেলাম। ভিতরে ঢুকে মনে হচ্ছিলো , অর্ধ পৃথিবীর মানুষ ‘ পুন্তা কানা’ বেড়াতে চলে এসেছে । বিশাল বড় লাইন। লাইনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেসান কাউন্টার কোন সুদূর প্রান্তে বুঝার কোনো উপায় নেই। পিপিলিকার মতো ধীরে ধীরে আমরা এগুতে লাগলাম । ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর কাউন্টারের চেহেরা দেখে আস্বস্থ হলাম। অবশেষে আমাদের সময় এলো । দুই মিনিটের মধ্যে নির্ভেজাল অবস্থায় আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলো । সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে আমরা এয়ার পোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসলাম। রেজওরটের বাসে করে আমরা রওয়ানা হলাম রেজওরটের দিকে। আধা ঘণ্টার একটু বেশী সময়ের মাঝে আমরা পোঁছে গেলাম আমাদের গন্তবে । বিশাল বড় একটি বিল্ডিং ।নীচ তালাতেই ভ্রমণকারীদের পরিচিতি , রুম এবং অন্যান্য সব কিছু বুঝিয়ে দেবার কাউন্টার । রুমে জিনিস পত্র নিয়ে যাবার জন্য কিছু লোক তৈরি । রুমে ঢুকে সব কিছু কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে আমরা বের হলাম চারপাশটা । অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো পুরো বিল্ডংটা এবং চার পাশটা । আমরা সবকিছু বুঝে জেনে নিলাম।
পর পর চারটা বড় বিল্ডিং । একেক বিল্ডিং এর একেক নাম। প্রতিটা বিল্ডংই নানা ভাবে সাজানো । আমাদের রেজওরট টার নাম ছিল “ বাহিনা অ্যাডয়াল্ট রেজওরট”। অ্যাডায়াল্ট মানে অন্য কিছু না শুধু এখানে বাচ্চা ছাড়া দম্পত্তিদের জন্য । যারা নিরিবিলি বাচ্চাদের হৈ চৈ ছাড়া জায়গাটা উপভোগ করতে চায় তাদের জন্য। বাচ্চা সহ বাবা মাদের জন্যও রেজওরটাও অনেক সুন্দর। বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্য নানা রকম দর্শনীয় জিনিস দিয়ে সাজানো চারপাশটা । সুইং পুলও বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা । মোটামুটি শিশুদের আকর্ষণ করার মতো একটি স্থান। আরো দুইটা বিল্ডিং ও নানা ভাবনা দিয়ে তৈরি করা। এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং এ যাবার জন্য সারা রাত ট্রেন চলে। ট্রেন মানে আসল ট্রেন না। সে ডিজাইনে বানানো গাড়ি । সে ট্রেন এর জন্য কোন ট্রেন লাইনের প্রয়োজন হয় না, সমতল রাস্তাতেই গাড়ি গুলোর চলাচল। প্রত্যেকটা বিল্ডিং এর সামনে প্রত্যেক পনেরো বিশ মিনিট পর পর ট্রেন এসে দাঁড়ায় । যারা উঠার তারা উঠে যারা নেমে যাবার তারা নেমে যায় । আমরাও সকালে নাস্তা করে বের হতাম ট্রেন এ চড়ে । যেখানে মন চাইতো নামতে সেখানেই নেমে পরতাম।
আমরা যে জায়গাতে ছিলাম সেখানে খাবার ব্যবস্থা ছিলো খুব ভালো । বিশাল হল রুমে সুসজ্জিত টেবিল খাওয়ার জন্য সাথেই অন্য দিকে বহু রকমের খাবার সাজানো । যার যেমন ইচ্ছা নিচ্ছে খাচ্ছে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার একেক দিন একেক রকম খাবার, আবার দুই তিনটা রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে খাবার জন্য বুকিং দিতে হয় আগে। আমরাও একদিন বা দুদিন গিয়েছিলাম বুকিং করা রেষ্টুরেন্টে সেখানে মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দেয়া আছে। সুন্দর ক্লাসি
রেষ্টুরেন্ট । বিশাল উঁচু সিলিং। সিলিং এর উপরটা সন দিয়ে করা। পুন্তা কুনা তে হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম বিভিন্ন জায়গাতে ভীষণ শৈলপিক ভাবে তৈরি করা সনের ঘর। এটাই মনে হয় তাদের ঐতিয্য । কোন কোনো সনের শেডে পাতা চেয়ার , কোনটাতে আবার কিছু আরাম দায়ক বালিশ পাতা।বিকেলে যেতাম সমুদ্র সৈকতে মুক্ত বাতাসে বসে উপভোগ করার জন্য।
অনেক সুমিং পুল চারপাশে। তখন প্রচণ্ড গরম ছিলো তাই ছেলে মেয়ে সবাই অনেকটা সময় সুইমিং পুলে কাটাতো । সুমিং পুলের পাশেই ড্রিংস এর দোকান ।যার যার ইচ্ছা মতো কেউ ঠাণ্ডা কিছু খাচ্ছে কেউ বা চা কফি । আমরাও ঘুরে বেড়াই । শপিং করতে যাই । যা না করলে আমার ভ্রমণই বৃথা । মুগ্ধ হয়েছি লাল কৃষ্ণ চূড়ার সারিবদ্ধ গাছ দেখে। মনটা এক ছুটে চলে গেলো আমার প্রিয় বাংলাদেশে।
আহা কামিনী ফুলের গন্ধ কতো দিন পাইনি। আমাদের বাসায় আমরা জুই চামিলি কামিনী ও কতো রকমের ফুলের গন্ধে বড় হয়েছি। আজ এতো বছর পরে কামিনী ফুলের গন্ধ আর কৃষ্ণ চূড়া লাল রঙ আমাকে উদাস করে তুললো । আমরা ট্রেন এ করে নানা স্টপে নেমে শপিং করি। বাচ্চাদের রেজোরটে গিয়ে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকমের অনুষ্টান ওদের সুমিং পুলে ছুটা ছুটি দেখি। আমরা যে বিল্ডিঙে ছিলাম তার নিচ তালাতে ছিলো বিরাট স্টেজ , রাতের খাবার শেষ হবার পর থরে থরে চেয়ার সাজিয়ে দেয়া হতো বিশাল বড় ফ্লোরটিতে । ধীরে ধীরে লোকজন এসে বসতে থাকে চেয়ারে। মঞ্চে শুরু হয় নাচ ও গান। স্পেনিশ ভাষাতে চলে সব কিছু । দর্শকের মাঝ থেকে অনেকেই ষ্টেজের নিচে, দর্শকদের সামনের বিরাট ফ্লোরে বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করতে থাকে, যার যখন ইচ্ছে সে ভাবেই। সে সময়টা ছিলো প্রচণ্ড গরম সেখানে। তাই দিনের বেলায় আমরা ট্রেন এ চড়ে একেক দিন একেক জায়গাতেও নামলেও বিকেলের সুন্দর আরামদায়ক আবহাওয়ায় আমরা হেঁটে হেঁটে এদিক সেদিক যেতাম ।হাঁটতে হাঁটতে পেতাম নানা রকমের ফুলের গন্ধ। মাঝে মাঝে বেঞ্চ পাতা ভ্রমন কারীদের বিশ্রামের জন্য। ফলের গাছ দেখেছি আপেল গাছে আপেল থোকা থোকা ঝুলে আছে। মাঝে মাঝে গাছ কেটে নানা রকমের ক্র্যাফট করা। সে গুলো দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
একদিন গেলাম আমরা সমুদ্র ভ্রমনে রেজওট থেকে ব্যবস্থা করা বিশাল ইঞ্জিনে চলা বোটে করে। মাঝ সমুদ্রে বোট নোঙর করা হলো । সেখানে আরো অনেক আমাদের মতো বড় দুই তালা তিন তালা বোট এসে নোঙর করেছে দেখলাম। বোট গুলোতে চলছিলো নাচ গান হুলুস্তুর । অল্প বয়সের ছেলে মেয়েরা ঝাপিয়ে পড়ছে পানিতে। পানিতে নেমে হৈ চৈ করে আবার বোটে উঠে আসছে। ওদের আনন্দের শেষ নেই। আমরা বুঝে গেলাম এই ট্রিপটা আসলে আমাদের উপযোগী ছিলো না। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিলো না। আমার অভ্যাস অনুযায়ী আমি সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারি, আমি সেখানেও কিছুটা মানিয়ে নিয়েছিলাম। বোট ট্রিপ শেষ হলে যেনো বাঁচলাম ।
রাতে অনেক রাত অবধি ট্রেন এ চড়ে ঘুরে বেরালাম । এখানকার রাতের দৃশ্য দেখার জন্য। সেদিন ছিলো ভরা জ্যোৎস্না ।চাঁদের আলো বিদ্যুতের আলো মিলেমিশে একাকার। সাথে ছড়িয়ে পরেছে ফুলের সুগন্ধ।