চুক্তি অনুযায়ী একজন ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্টের দায়িত্ব অন্যকে ন্যস্ত করা যায় না। চুক্তিপত্রে এলিজাবেথ নামের এক কানাডীয় কনসালটেন্টের নাম লেখা আছে। নিয়মানুযায়ী, তিনিই এ চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা। তার মানে, বিষয়টি পর্যালোচনা করলে যা বোঝা যায়, চুক্তিতে কানাডার কনসালটেন্টের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ক্লাইয়েন্টদের শুধু বিভ্রান্ত করার জন্য। সেই কনসালটেন্টের স্বাক্ষরহীন এ চুক্তির একটুও দাম নেই। এভাবে ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে সৌরভ সাহেবের কাছ থেকে ওই কোম্পানি তিন ধাপে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে। টাকা নেবার রশিদগুলোও তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশের একশ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করা এ চুক্তির বিভিন্ন শর্ত পড়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! কারণ, শর্তগুলো কানাডার ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্সির অনুমোদিত শর্তাবলীর সরাসরি পরিপন্থী। বাঙালি যেভাবে আকৃষ্ট হবেন, তেমন করে মনের মাধুরী মিশিয়ে শর্তগুলো লেখা হয়েছে। সবকয়টি শর্ত নিয়ে আলোচনা করলে, এ লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তাই, কেবল একটা চুক্তি নিয়েই কিছুটা আলোকপাত করি এ লেখায়।
সংযুক্ত চুক্তির অংশবিশেষ দয়া করে দেখুন।
চুক্তি অনুযায়ী চতুর্থ কিস্তির টাকা দিতে হবে আইটিএ বা, ইনভাইটেশন টু অ্যাপ্লাই চিঠি পাওয়ার পর। প্রশ্ন হলো, ক্লাইয়েন্ট যে আইটিএ পাবেন এ কথা কানাডার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কি চুক্তিকে স্বাক্ষরকারীকে কানে কানে বলে দিয়েছে? কনসালটেন্ট কী করে জানেন এ ক্লাইয়েন্ট আদৌ আইটিএ পাবেন কিনা? উকিল কি কোন মামলার রায় ঘোষণার আগেই ফল বলে দিতে পারেন? তাই, এ ধরনের শর্ত প্রতারণামূলক বিবেচনা করে কানাডিয়ান রেগুলেশনে তা অগ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে।
আবার দেখুন, দ্বিতীয় ইনস্টলমেন্টের টাকার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে পজিটিভ অ্যাসেসমেন্ট আসলে ৫৫০ ডলার দিতে হবে। পজিটিভ রেজাল্ট আসার শর্ত দিয়ে টাকা নেওয়াটাও কানাডার রেগুলেশনে পরিষ্কার মানা আছে। এভাবে এ চুক্তিপত্রের প্রতিটি শর্তই কানাডার আইনে অগ্রহণযোগ্য। একারণেই কানাডার কোন রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) এধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা নয়, এবং করেনও নাই। তাই, চুক্তির বডিতে এলিজাবেথ নামের এক কনসালটেন্টের নামোল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তাতে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশের এক উকিল। ভালোমতো খোঁজখবর নিলে এমনও দেখা যেতে পারে সেই বাংলাদেশি উকিলও হয়তো ভুয়া। কারণ, কোন বিজ্ঞ উকিল কানাডায় রেজিস্টার্ড না হয়ে এ ধরনের কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা নয়।
এ লেখার প্রয়োজনে আমি কানাডার সেই ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, যার নাম এ চুক্তিতে আছে, তার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছি চুক্তিতে যে ক্লাইন্টের কথা বলা আছে তার সাথে আদতেই তিনি সংশ্লিষ্ট আছে কিনা? তিনি সরাসরি ‘না’ করেছেন। তবে, পরবর্তীতে সৌরভ সাহেবের মাধ্যমে গুলশানের সেই কোম্পানি হতে একটি অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে যাতে এলিজাবেথ’ এর স্বাক্ষরও দেখা যায়। আমি জানিনা এটি এলিজাবেথের আসল স্বাক্ষর কিনা। ওই রিপোর্টে লেখা আছে, ‘এক্সপ্রেস এন্ট্রি’ প্রোফাইল খোলার জন্য যে পয়েন্ট দরকার তা এই ক্লাইয়েন্টের নেই। পয়েন্ট না থাকার পরও এই একই রিপোর্টের শেষ পৃষ্ঠায় আবার বলা হয়েছে- সৌরভ সাহেব এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোফাইল খোলার উপযুক্ত। তার মানে, স্ববিরোধী তথ্যের কারণে চার পৃষ্ঠার এ রিপোর্টটি ভালোমতো পড়লে যে কেউ বিভ্রান্ত হবারই কথা।
দৃশ্যত সৌরভ সাহেব ইমিগ্রেশন প্রোফাইল খোলার উপযোগী না হলেও গুলশানের সেই আলিশান কোম্পানি এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোফাইল খুলে দেওয়া হবে বলে ক্লাইয়েন্টের কাছ থেকে আবারো টাকা নিয়েছেন, যা সরাসরি প্রতারণা।
সৌরভ সাহেবের কাছে এই কোম্পানিকে বারবার অর্থ হস্তান্তরের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “স্যার, ওরা গুলশানে যেই রাজকীয় অফিস খুলে বসেছে তা দেখলে শুধু আমি কেন, যে কেউই তাদের বিশ্বাস করবে। শতশত মানুষ তাদের হাতে প্রতিদিন কানাডা ইমিগ্রেশনের নামে লাখে লাখে টাকা তুলে দিচ্ছে।“
তাহলে তিন দফায় মোট দুই হাজার কানাডিয়ান ডলার ওই কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে সৌরভ সাহেব কী পেলেন? তিনি পেয়েছেন কেবল একখানা ইনিশিয়াল অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট যা কিনা অসংলগ্ন বা বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা। অথচ, একটা ডিটেইল্ড ফ্যামিলি অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য আমাদের কোম্পানি চার্জ করে কেবল ৩০০ ডলার। কিন্তু, আমরা যেহেতু চুক্তিতে ক্লাইয়েন্ট আইটিএ পেয়ে যেতে পারেন, বা পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে জাতীয় ইঙ্গিত দেই না বা, দিতে পারিনা, তাই, বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন গুলশান বা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সুবিশাল অফিস খুলে বসা এসব তথাকথিত কনসাল্টিং কোম্পানি অধিক নির্ভরযোগ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ কোম্পানির হাতে সৌরভ সাহেব কেবল আর্থিকভাবে প্রতারিতই হননি, জীবনের মূল্যবান দুইটি বছরও হারিয়েছেন যা তার কানাডা ইমিগ্রেশনের সম্ভাবনা আরো কমিয়ে দিয়েছে।
সৌরভ সাহেবের ঘটনা শুনে তাকে বললাম, “আপনারা কানাডা ইমিগ্রেশনের নামে এভাবে দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনাগুলো দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন না?” আমার কথায় রসিকতাপূর্ণ হাসি হেসে তিনি বললেন, “কি যে বলেন স্যার, এরা কি কর্তৃপক্ষকে ভাগ না দিয়ে একা খায় ভেবেছেন? রিপোর্ট করে কোন লাভ হবে না এদেশে; তাই, সবাই নিরবে সয়ে যায়।“
যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।
উল্লেখ্য, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই লিগ্যাল অ্যাডভাইস বা, আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কারণ, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়। মনে রাখা দরকার, প্রত্যেকের ইমিগ্রেশন কেইসই কোন না কোনভাবে আলাদা।