শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

কানাডায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কতটা নিরাপদ?

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২

শিক্ষার ক্ষেত্রে কানাডার অবস্থান শীর্ষে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কানাডায় বাংলাদেশি ইন্টারন্যাশনাল ও ইমিগ্রান্ট শিক্ষার্থীরা কতটা নিরাপদ? কারণ, কানাডায় পড়তে আসা বেশ ক’জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী- কেউ খুন হয়েছেন, কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, আবার কেউবা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে, এবং তাদের মৃত্যু বা নিখোঁজ হবার পরের ঘটনাও দুঃখজনক। আবার কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছে অপরাধ চক্রের সাথেও।

বিগত কয়েক বছরে এরকম অপমৃত্যুর সংখ্যা প্রায় অর্ধ ডজন ছাড়িয়ে গেছে। কানাডিয়ান বিভিন্ন মিডিয়া থেকে জানা গেছে, তারা হচ্ছে- নিউফাউন্ডল্যান্ডে অপু আকবর, কানাডার সাস্কাচোয়ানে আব্দুল্লাহ আল-মাসুম, অটোয়ায় তৌসিফ চৌধুরী, টরন্টোতে ইকরামুল মিলন, ম্যানিটোবার মোহাম্মদ ইমরান খান প্রমুখ। এছাড়াও বেশ ক’জন অভিবাসী শিক্ষার্থীরা অভিমানে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে বা হারিয়ে গেছে। যেমন- ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অম্বর রায়, টরন্টোতে ফাহমি রহমান, সাবিত খন্দকার, সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী অপু আকবর ২০১৮ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিখোঁজ হবার পর এ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। অপু নিউফাউন্ডল্যান্ড প্রভিন্সে মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের (পিএইচডি) ডিগ্রির শিক্ষার্থী ছিলেন!

সাস্কাচোয়ানে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য আসা আরেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল-মাসুম রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিয়ারিং এন্ড ট্যাকনোলজির সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। মাসুম পড়াশোনা করতেন। তাকে ২ জানুয়ারি ২০১৯ বাসা থেকে বের হতে দেখা যায়। এরপর পুলিশ তার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। পরে ব্লু মাউন্টেনে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

তৌসিফ চৌধুরী, গত ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর কানাডার রাজধানী অটোয়ায় বিমানবন্দর পার্কওয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ফুটপাথের ওপর জলাধারের পাশে খুন হয়। সে কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী ছিলো। এই হত্যা মামলার রায় দেয়া হয় গত ৬ এপ্রিল ২০১৬ সালে। আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করার পর দুই খুনি স্টিভেন কজিওলো এবং রোচকে যথাক্রমে মাত্র পাঁচ বছর এবং সাড়ে তিন বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ টরন্টোস্থ ফার্মেসি এবং ড্যানফোর্থ এলাকায় এক বাড়ির বেজমেন্টে আফগানি রুমমেট কর্তৃক নৃশংসভাবে নিহত হয় সেন্টেনিয়াল কলেজের ছাত্র ইকরামুল মিলন। তার লাশ প্রায় দেড় মাস হাসপাতালের মর্গে অযত্নে এবং অবহেলায় পরে থাকার পর স্থানীয় বাঙালিরা চাঁদা তুলে লাশ বাংলাদেশে পাঠায়। কিন্তু তৎকালীন হাই কমিশনার কামরুল আহসান কোনো খোঁজ-খবর নেয়া তো দূরের কথা, কোনো ভূমিকাই নেননি। তিনি এই প্রতিবেদককে তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কোনো তালিকা বা রেকর্ড আমাদের দূতাবাসে নেই। তাই যারাই এদেশে পড়তে আসে, তাদের উচিৎ দূতাবাসে রিপোর্ট করা! যদিও এব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা সরকারের কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা নেই!
ইন্টান্যাশনাল শিক্ষার্থীদের অপমৃত্যু থেমে নেই। ম্যানিটোবায় মৃত্যুবরণ করে মোহাম্মদ ইমরান খান। তার সম্পর্কে সেখানকার বাসিন্দা সাকিবুর রহমান খান গত ২৬ মার্চ ২০১৯ তারিখে ফেইসবুকে লিখেছেনঃ ‘আজ জোহরের নামাজের শেষে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিটোবার বাংলাদেশী (মোহাম্মদ ইমরান খান) এক ছেলের জানাজা পড়লাম। ছেলেটি আন্ডার গ্রেড এর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিটোবাতে ভর্তি হয়। …যতদূর জেনেছি ছেলেটি কিছুদিন নিখোঁজ থাকার পর তার বন্ধু-বান্ধব পুলিশকে জানায়। পুলিশ কয়েক দিন পর তার লাশ উদ্ধার করে। জানা গেছে, ছেলেটির মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, এটি একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ছিল’। পুলিশের সন্দেহ, সে অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো।

তিনি আরো উল্লেখ করেন- ‘যদি ছেলেটির বাবা মা কানাডার ভিসা পায় তাহলে হয়তো জীবনে দুই – এক বার এসে ছেলেটির কবর জিয়ারত করে যাবে’। যা অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে!

এদিকে বেশ ক’জন অভিবাসী শিক্ষার্থীরা অভিমানে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে বা হারিয়ে গেছে। যেমন- ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অম্বর রায়। সে গত ১৪ মার্চ ২০১৯ তারিখে নুনাভাট প্রদেশ থেকে হারিয়ে যায়, আর সে ফিরে আসেনি।

২০১৭ সালের প্রথমদিকে টরন্টোতে দুই বাংলাদেশি তরুণ যথাক্রমে ফাহমি রহমান এবং সাবিত খন্দকার আত্মহননের পথ বেছে নেয় বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে। ৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে টরন্টোতে আর এইচ কিং একাডেমীর একাদশ গ্রেটের মেধাবী শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
লক্ষ্য করে দেখা গেছে, কানাডায় পড়তে আসা কোন কোন শিক্ষার্থীরা অর্থনৈতিক কারণে বা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়াশোনা শেষ না করেই ফিরে যাচ্ছে। কেউ কেউ নেশার জগতে অথবা অপরাধচক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তারা কেউ কেউ ধনী সম্প্রদায়ের আলালের ঘরের দুলাল, কেউ কেউ রাজনীতিবিদদের সন্তান, খ্যাতিমানদের ছেলে-মেয়ে।

বাংলাদেশের পিতা-মাতারা অনেক রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে, সব কিছুর বিনিময়ে সন্তানদের বিদেশে পাঠান উচ্চশিক্ষার জন্য। পরে তাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে ধুলিৎসাতে পরিণত হয়। কাজেই, এব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়!

নাম উল্লেখ না করে একটি ঘটনা অবগত করি, একজন সাংবাদিক তাঁর ছেলে গ্রাফিক ডিজাইনে পড়ানোর জন্য লন্ডনে পাঠান। কিন্তু সেখানে বিদেশি ছাত্রদের বের করে দেয়ার পর্বে এক পর্যায়ে চার বছর পর ছেলেটি লন্ডন থেকে টরন্টোতে একটি কলেজে ভর্তি হয়ে চলে আসে। সে অনেক কষ্ট করে দুই বছর পড়ার পর অর্থাভাবে পার্ট টাইম চাকরিতে ঢুকে। খাওয়া-দাওয়া, ভাসা ভাড়া, টিউশন ফি জোগাড় করতে করতে, হিমশিম খেতে খেতে সব কিছু গুলিয়ে গেলে হাবুডুবু খেয়ে থাকে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। প্রথমে দালাল, পরে আইনজীবী ধরে ভিসা বর্ধিত করতে গেলে তাকে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে পাঁচ হাজার ডলার দিতে হয়। এক পর্যায়ে সে হাল ছেড়ে দেয়। আবারো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কলেজ থেকেও আর সহযোগিতা পায়না। তখন কানাডায় থাকা তার জন্য ‘অবৈধ’ হয়ে পড়ে। পরে কমিউনিটির নানা ধরণের সংগঠন এবং ব্যক্তির চিঠিপত্র ইমিগ্রেশনে দাখিল করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও আরো নানা ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে পাঁচ বছর পরে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়। অথচ ছেলেটি সাধারণ একটি সাবজেক্টে পড়ার জন্য বিদেশের মাটিতে জীবন যুদ্ধ করে শূন্য হাতে ঘরে ফিরে। এভাবেই তার জীবন থেকে চলে যায় নয়টি বছর। যা আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। এসব কারণেও এই ধরণের ঘটনা ঘটে।

শুধু কানাডাতেই নয়; গুগলে সার্চ দিলে দেখা যাবে- আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, বৃটেনেও অনুরুপভাবে অনেক শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু হয়। অনেকেই অপরাধ চক্রেও জড়িয়ে পড়ে। এজন্য কারো কারো শান্তি হচ্ছে, জেল হচ্ছে।

কাজেই এই দুঃখজনক ঘটনা থেকে রেহাই পাবার জন্য,

প্রথমত: প্রবাসে পড়াশোনা করার জন্য সেই শিক্ষার্থীর মানসিক বিষয়টি ভাবা উচিত, সে এক নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা, সেই মনোবল জানা দরকার অর্থাৎ সে প্রস্তুত কিনা।

দ্বিতীয়ত: স্থানীয় কোনো অভিভাবক থাকা প্রয়োজন। যিনি সদা বিপদে আপদে খোঁজ-খবর নিবেন।

তৃতীয়ত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে বিদেশে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। যাতে বিদেশে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের একটা তালিকা বা তথ্য থাকবে।

চতুর্থত: প্রবাসে বাঙালি কমিউনিটিতে একটি সেবামূলক সংগঠন থাকা উচিৎ। যারা বিপদে আপদে এগিয়ে আসবে।

পঞ্চমত: অভিভাবকদের বাইরে পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য আছে কিনা, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ!

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com