কানাডা বিশ্বের অন্যতম ধনী, উন্নত এবং নিরাপদ দেশ। এমন একটি দেশ প্রতি বছর কমপক্ষে তিন লক্ষ অভিবাসীকে স্বাগত জানাচ্ছে, যখন অন্যান্য উন্নত দেশে অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ বললেই চলে। কানাডার মতো উন্নত, জবাবদিহিতামূলক এবং কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র যতই অভিবাসী আনুক না কেন এটি তার সিটিজেন এবং পার্মানেন্ট রেসিডেন্টরা যেন জব না হারায় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রেখেই কাজ করছে। আর সেজন্যই প্রতিটি ফরেনার নেওয়ার সময় পসিটিভ LMIA বা লেবার মার্কেট ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট দরকার হয়।
যাইহোক, এখন আসুন কানাডাতে এক্সপ্রেস এন্ট্রিতে ঢুকে পড়ার কিছু টিপস দেই। আজকের টিপস ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং বিজনেস ইমিগ্র্যান্টদের জন্য। ২০১৭ সালে চালু হওয়া আটলান্টিক ইমিগ্রেশন পাইলট প্রোগ্রামের আওতায় আটলান্টিক তীরের চারটি প্রভিন্স নোভাস্কোশিয়া, নিউব্র্যান্সউইক, নিউফাউন্ডল্যান্ড এন্ড ল্যাব্রাডোর এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের যেকোনো পাবলিক ইউনিভার্সিটি বা কলেজে কমপক্ষে দুই বছরের ডিপ্লোমা করলে তিন বছর পর্যন্ত পোস্টগ্রাজুয়েট ওপেন ওয়ার্ক পার্মিট পাওয়া যায়। পড়ার সময় ২০ ঘন্টা কাজ করার সুযোগ তো আছেই। এই সময় ঐসব প্রভিন্সে যদি আপনার এক বছরের ফুলটাইম জব অফার থাকে তাহলেই আপনি পিআর-এর জন্য এপ্লাই করতে পারবেন। এটি আপনাদের জন্য খুব সহজেই কানাডায় পিআর হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ।
এবার আসুন দেখি বিজনেস ইমিগ্রেশন কীভাবে আপনাকে কানাডায় এক্সপ্রেস এন্ট্রি পেতে সাহায্য করতে পারে।
২০ জুলাই ২০১৭ তে কানাডা ওনার অপারেটেড ওয়ার্ক পার্মিট নামে একটি নতুন ধরণের ওয়ার্ক পার্মিট এর ব্যবস্থা করেছে যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব থেকে মিডলেভেলের বিজনেস ওনাররা সহজেই পরিবার নিয়ে চলে আসতে পারেন। সর্বনিম্ন এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার থেকে শুরু করে ৩ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার খরচ করে জেনুইন বিজনেস দাঁড় করানোর জন্য ফ্যামিলি সহ এক বছরের ওয়ার্ক পার্মিট নিয়ে আপনি কানাডা চলে আসতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, এটি গ্রোসারি স্টোর দেয়া বা লন্ড্রি, গ্যাসস্টেশন বা মম এন্ড পপ শপ এর মতো ব্যবসা হলে হবে না। আপনার ওনারশিপ কমপক্ষে ৩৩.৫% হতে হবে, বিজনেসটির রেভিনিউ বছরে কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার হতে হবে। আপনি এ ধরণের একটি বিজনেস কিনতেও পারেন অথবা নতুন শুরু করতেও পারেন। তবে এক্সিস্টিং বিজনেস কেনাই রিস্ক ফ্রি। বেবিবুমার ব্যাবসায়ীরা অবসর নিচ্ছেন এবং তাদের ফ্যামিলি মেম্বাররা নিজেদের পেশা নিয়ে ব্যস্ত, তারা তাদের ফ্যামিলি বিজনেসে সময় দিতে পারছেন না। তাই এক্সিস্টিং এবং ট্রাস্টেড বিসনেস কেনাও সম্ভব। কানাডিয়ান সরকার দেখতে চায় ব্যবসাটি করার মাধ্যমে আপনি কমপক্ষে একটি ফুল টাইম জব তৈরী করতে পেরেছেন এবং আপনার ইউনিক বিজনেস নলেজ এবং আইডিয়া কানাডিয়ানদের মধ্যে ট্রান্সফার হচ্ছে। এ ধরণের ওয়ার্ক পার্মিটের জন্যও আটলান্টিক প্রভিন্সগুলো অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। অন্টারিও, ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং কুইবেকে অনেক বেশি পরিমান টাকা ইনভেস্ট করতে হয় এবং প্রভিন্সিয়াল নোমিনেশন পাওয়া বেশ কঠিন এবং প্রতিযোগীতামূলক।
এই ধরণের বিজনেস পারচেজ বা ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে ১২ থেকে ২০ মাসের মধ্যে আপনি ফ্যামিলি সহ কানাডায় পিআর হতে পারবেন। ২০১৫ সালে চালু হওয়া ফেডারেল গভর্নমেন্টের ইমিগ্র্যান্ট ইনভেস্টর ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা আইআইভিসি চালু হওয়ার পর এপর্যন্ত মাত্র ১২ জনের কম এই প্রকল্পের আওতায় কানাডা আসতে পেরেছে।
২০১৪ সালে চালু হওয়া স্টার্ট আপ ভিসা ফেইল করার পর কানাডার প্রাক্তন ইমিগ্রেশন মিনিস্টার এবং বর্তমানে চায়নায় কানাডার অ্যাম্বাসেডর John McCallum এটিকে “নন-এক্সিস্টেন্ট এবং নট ভেরি প্রাকটিক্যাল” আখ্যা দিয়েছিলেন। কানাডার একমাত্র প্যাসিভ ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম যেটি একমাত্র কুইবেকে চালু আছে এবং যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও এটিতে আছে মাত্র ১৯০০ কোটা যার মধ্যে ১৩৩০ চায়নার জন্য বরাদ্দ এবং বাকি মাত্র ৫৭০ সারা বিশ্বের জন্য বরাদ্দ। এই প্রোগ্রামে ১.৬ মিলিয়ন নেট সম্পদ থাকতে হয়, ৮ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করতে হয়। ফিনান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়ারির মাধ্যমে ৮ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করার সুযোগ থাকলেও এতো বেশি পেপার ওয়ার্ক এবং কুইবেক গভর্নমেন্টের সিএসকু সার্টিফিকেট নিতে অনেক ইনভেস্টররাই বছরের পর বছর এতো বড় অংকের টাকা ইনভেস্ট করেও অপেক্ষায় আছেন, এখনো কানাডায় আসতে পারছেন না। তাই আশা করছি অটোয়ার এই নতুন বিজনেস ইমিগ্রেশন স্ট্রাটেজি সফল হবে।
প্রিয় পাঠক, কানাডার সাম্প্রতিক ইমিগ্রেশন পলিসি বিশেষ করে যেগুলো নিয়ে আপনাদের মাঝে অনেক বেশি কনফিউশন থাকে সেগুলি নিয়ে মাঝে মাঝে অনিয়মিতভাবে একটু আধটু লেখার চেষ্টা করি- তার মানে এই নয় যে আমি আপনাদের সবাইকে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে কানাডায় চলে আসতে বলছি। আমার একজন প্রিয় বন্ধু এবং প্রাক্তন সহকর্মী যখন আমাকে বলে “আমি তো ভেবেছিলাম তুই বাংলা লেখাই ভুলে গেছিস, দুই দুইটা বিসিএস ক্যাডারের চাকরি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে, বাংলাদেশ থেকে স্কলারশিপ এবং স্ববেতনে চাকরি নিয়ে, লিয়েন নিয়ে অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে, যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিয়ে এখন কানাডিয়ান হয়েছিস। নিজে তো গেছিস-ই আবার সবাইকে এদেশ থেকে নিয়ে যেতে চাইছিস”- তখন আমি সহজেই অনুমান করতে পারি হয়তো আমার সম্পর্কে অনেকেই এমনটাই ভাবছেন।
আপনাদেরকে সবিনয়ে জানাতে চাই- পৃথিবীর এক মেরু থেকে আর এক মেরুতে মায়ের এবং দেশের উষ্ণ কোল এবং প্রতিষ্ঠিত আইডেন্টিটি ছেড়ে বরফের দেশে সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে নতুন আইডেন্টিটি তৈরী করা যতটা সহজ মনে হয় আসলে তা ততো সহজ নয়, সবাই তা পারে না, পারার দরকারও নেই এবং এটি নির্ভর করে প্রত্যেক মানুষের ইউনিক অবস্থার ওপরে। একেকজনের পারিপার্শ্বিকতা একেকরকম, একজনেরটা আর একজনের সঙ্গে কোনোভাবেই মিলবে না, একজনেরটা আর একজন ঠিক আপনার মতো করে সম্পূর্ণ বুঝতেও পারবে না। আর অভিবাসী হলেই যে দেশপ্রেম চলে যায় সেটাও কি ঠিক?
অভিবাসীরা কি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়? তারা দেশে যায় না? তারা দেশের জন্য ভাবে না? কাঁদে না? দেশকে মিস করে না? করে বলেই তো বিদেশেও বাংলাদেশের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করে, বাচ্চাদের বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি শেখায়, তাদেরকে বাংলাদেশে বেড়াতে নিয়ে যায়। আর কানাডিয়ান হলেই যে দেশে কখনো ফিরে যাওয়া যাবে না তাও তো ঠিক না। আমার খুব প্রিয় কবিতার একটা লাইন দিয়ে শেষ করি আজ- “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে”।