পাকাপাকি ভাবে রাজ্যাভিষেকের আগেই সাম্রাজ্য বিস্তারের হুমকি! বিশ্ব মানচিত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম উপকূলের উপর আধিপত্য কায়েম। ২১ শতকে আটলান্টিকের পারে লেখা হতে চলেছে নয়া ইতিহাস? সব হিসাব মিলে গেলে অবশ্যই ‘মহান শাসক’দের তালিকায় জ্বলজ্বল করবে সেখানকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নাম।
তিনি, ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাঁর ‘গোপন ইচ্ছা’ প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার কথা শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। ফলে ‘আগ্রাসী’ আমেরিকার আতঙ্ককে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কের ‘ফক্স নেশন পুরস্কার বিতরণী’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন ট্রাম্প। তিনি মঞ্চে উঠতেই ‘৫১-৫১’ চিৎকার শুরু করে জনতা। উল্লেখ্য, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যের সংখ্যা ৫০। আমেরিকার ৫১তম রাজ্য কানাডা হবে কি না, তা অবশ্য ওই অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করেননি নবনির্বাচিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট।
ফক্স নেশন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নাম করে বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন ট্রাম্প। তাঁর কথায়, ‘‘২৫ শতাংশ শুল্কের কথা শুনেই তড়িঘড়ি আমার কাছে আসে জাস্টিন। এটা তো সবে শুরু।’’ এর পরই দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে থেকে উঠতে থাকে ‘৫১-৫১’ আওয়াজ।
অনুষ্ঠানে খোশমেজাজে ছিলেন ট্রাম্প। হাত তুলে জনতাকে শান্ত করে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের ক্ষোভ-রাগ-ভালবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি।’’ এর পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘কানাডা দখল’ সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ। অন্য দিকে, অটোয়ার শীর্ষকর্তারা একে ‘ট্রাম্পসুলভ রসিকতা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এ বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ভোট হয় আমেরিকায়। নির্বাচনে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর কানাডার উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করে দেন ট্রাম্প। যদিও এখনই তা কার্যকর করতে পারবে না ওয়াশিংটন। জানুয়ারিতে শপথ নেবেন ডোনাল্ড। তার পর নিজের শুল্ক নীতি প্রয়োগ করতে পারবেন তিনি।
কিন্তু ট্রাম্প শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করতেই চাপে পড়ে অটোয়া। কারণ, উত্তর আমেরিকার দেশটির অর্থনীতির ‘টিকি’ বাঁধা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ফলে ২৫ শতাংশ শুল্কর চাপ সহ্য করা তাঁদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। এ হেন কড়া পদক্ষেপ থেকে ওয়াশিংটনকে বিরত করতে দ্রুত ডোনাল্ডের কাছে ছুটে আসেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো।
গত ৩ ডিসেম্বর ফ্লোরিডার ‘মার-এ-লাগো’ এস্টেটে ট্রুডোকে নৈশাহারে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। ‘ফক্স নিউজ়’ সূত্রে খবর, সেখানেই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রস্তাব দেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। শুধু তা-ই নয়, জাস্টিনকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করার প্রতিশ্রুতিও নাকি দিয়েছেন ডোনান্ড।
মার-এ-লাগো এস্টেটের নৈশাহার শেষে নিজের সমাজমাধ্যম সংস্থা ‘ট্রুথ সোশাল ডট কম’-এ কৃত্রিম মেধা ব্যবহৃত একটি ছবি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তাঁকে কানাডার দিকে তাকিয়ে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। পাশেই উড়ছে কানাডার পতাকা। ছবিটির নীচে ‘ও কানাডা’ কথাটি লিখেছেন তিনি।
মজার বিষয় হল, ‘ম্যাপল পাতার দেশ’টির জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয় ‘ও কানাডা’ দিয়ে। ফলে দু’টি দেশের সংযুক্তিকরণের জল্পনাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে নারাজ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। ট্রাম্প-ট্রুডোর নৈশাহারে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক, স্বরাষ্ট্র দফতরের নেতৃত্ব পেতে চলা ডগ বার্গাম ও পরবর্তী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ়।
নৈশাহারের ছবিতে ডোনাল্ডের পাশে ‘দেঁতো হাসি’ হেসে ট্রুডোকে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে। তবে তিনি আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কথাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা জানা যায়নি। এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন কানাডার জন নিরাপত্তামন্ত্রী ডোমিনিক লেব্যাঙ্ক। তিনি একে ‘প্রেসিডেন্ট জোক্স’ বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
মন্ত্রীরা মুখে যাই বলুক, ‘আগ্রাসী’ ট্রাম্পের হাত থেকে পার পাওয়া যে খুব সহজ নয়, তা ভালই জানে অটোয়া। ফক্স নিউজ়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপালে কানাডার অর্থনীতি যে ধ্বংস হবে, ডোনাল্ডের কাছে তা একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন ট্রুডো। কিন্তু তাতে যে নতুন প্রেসিডেন্টের মন গলেছে, এমনটা নয়।
বর্তমানে ওয়াশিংটনকে দিনে ৪০ লক্ষ ব্যারেল খনিজ তেল সরবরাহ করে অটোয়া। ৬০ শতাংশ ‘তরল সোনা’ কানাডা থেকে আমদানি করে আমেরিকা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫ শতাংশ বিদ্যুৎও আসে ম্যাপল পাতার দেশ থেকে। বিশ্বের অন্যতম খনিজ সমৃদ্ধ দেশটির সংযুক্তিকরণ হলে আমেরিকার অর্থনীতি যে রকেট গতিতে ছুটবে, তা বলাই বাহুল্য।
ইউরেনিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়ামের মতো ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ রয়েছে কানাডায়। অতি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম পরমাণু হাতিয়ার তৈরিতে ব্যবহার হয়। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, অটোয়া-ওয়াশিংটন সংযুক্তি নিঃসন্দেহে আমেরিকার সামরিক শক্তিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে।
তবে কানাডার জাতীয়তাবাদীদের আমেরিকার অংশ হওয়া নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে। রোনাল্ড রেগন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ করে দুই প্রতিবেশী দেশ। এই সমঝোতার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন অটোয়ার জাতীয়তাবাদীরা। এটিকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির অংশ হিসাবেই দেখেছিলেন তাঁরা।
ফলে কুর্সিতে বসে অতি সহজেই যে ট্রাম্প অটোয়া কব্জা করতে পারবেন, এমনটা নয়। আগামী বছর (পড়ুন ২০২৫) কানাডায় নির্বাচন রয়েছে। সেখানে ট্রুডোর দল ক্ষমতা হারালে জাতীয়তাবাদীদের উত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে জোট সরকারে রয়েছেন জাস্টিন। কানাডার সংযুক্তিকরণ প্রশ্নে সেই জোটে ভাঙন ধরতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
কানাডার বিরোধী দলের নেতা পয়লিভরে এই নিয়ে ইতিমধ্যেই জোরকদমে পাল্টা প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘শুল্ক বৃদ্ধি করলে আখেরে আমেরিকানদেরই লোকসান হবে। ফলে ট্রাম্পের কথায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’’ ওয়াশিংটনের পরবর্তী নজর গ্রিনল্যান্ডের উপর রয়েছে বলেও স্পষ্ট করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকদের দাবি, জোর করে কানাডাকে সংযুক্ত করতে গেলে আন্তর্জাতিক মহলে চাপে পড়বেন ট্রাম্প। সে ক্ষেত্রে আরও কাছাকাছি আসতে পারে রাশিয়া ও চিন। আমেরিকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলির সুর চড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। ফলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের স্বপ্ন আদৌ সফল হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।