ইতালির রোমকে বলা হয় চির শান্তির নগরী। ভাবলে অবাক হতে হয়, এ নগরীতেই রয়েছে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ আর রোমান সাম্রাজ্যে টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক, রক্তাক্ত লড়াইয়ের মঞ্চ কলোসিয়াম। কলোসিয়াম প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন যা একই সাথে রোমানদের হিংস্রতা আর নির্মাণশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হয়ে টিকে আছে শত শত বছর ধরে। ইউনেস্কো কলোসিয়ামকে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়। এটি পৃথিবীতে মনুষ্যসৃষ্ট আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে নির্বাচিত হয় ২০০৭ সালে।
কলোসিয়াম ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। রোমান সাম্রাজ্যে নির্মিত এই গ্যালারি বা মঞ্চকে, সেসময়ের শাসকরা গ্লাডিয়েটরসদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রতিযোগিতার প্রদর্শনী বা জনগণের উদ্দেশ্যে অন্য কোন প্রদর্শনীর কাজে ব্যবহার করত। এটিকে রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় স্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি নির্মাণ করতে ব্যাবহার করা হয়েছিল পাথর এবং কংক্রিট।
কলোসিয়াম ৬ একর ভূমির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১৮৯ মিটার এবং প্রস্থ ১৫৬ মিটার। কলোসিয়ামে ছিল ৮০টি প্রবেশদ্বার। সেখানে ৫০ হাজার দর্শক একসাথে বসে গ্লাডয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে পারত। রোমান সাম্রাজ্যের সকল নাগরিকের এই জায়গায় বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার ছিল।
ভেসপাসিয়ানের মৃত্যুর পর মঞ্চটির নির্মাণকাজ শেষ করেন তার পুত্র । দশ বছর ধরে ৬০,০০০ ইহুদি দাসকে কাজে লাগিয়ে ৮০ খ্রিস্টাব্দে কলোসিয়ামের নির্মাণ কাজ শেষ করেন টাইটাস। তিনি এটিকে অফিসিয়ালি “ফ্লেবিয়ন এ্যাম্পিথিয়েটর (গ্যালারি)” নাম দিয়ে জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দেন এবং শুরুতে ১০০ দিনব্যাপী এক উৎসবের আয়োজন করেন সেখানে। সেই উৎসবে, আয়োজন করা হয় গ্লাডিয়েটরসদের মধ্যে মল্লযুদ্ধ ও বিভিন্ন ধরণের পশুর লড়াইয়ের। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী চারশ বছর ধরে এটি হয়ে ওঠে রোমানদের রক্তাক্ত লড়াইয়ের মঞ্চ।
রোমান সম্রাটদের নির্দেশে রাজকোষের অর্থে সে সময় এক বিশেষ খেলার আয়োজন করা হতো কলোসিয়ামে। লড়ায়ের জন্য উত্তর আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হতো হাজারে হাজারে হাতি বুনো মহিষ বা গন্ডার সিংহ। ভাল্লুকের সঙ্গে হাতি, হাতির সঙ্গে বুনো মহিষ বা গন্ডারের সঙ্গে হাতির লড়াই দেখতে কলোসিয়ামের গ্যালারিতে জড়ো হতো হাজারো রোমান অধিবাসী। পশুদের মৃত্যুবেদনার হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো গ্যালারি। কলোসিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৯ হাজারেরও বেশি পশুর প্রাণ গিয়েছিল।
এভাবে, দীর্ঘদিন পশুর লড়াই আর এগুলোর করুণ মৃত্যু দেখতে দেখতে একঘেয়েমি বোধ করেন সম্রাট টাইটাস। তাই, পশুর পরিবর্তে মানুষে মানুষে লড়ায়ের হিংস্র আর অমানবিক চিন্তা মাথায় আসে তার। ফলস্বরূপ, শুরু হয় মানুষে-মানুষে লড়াই আর মৃত্যুর করুণ ও বীভৎস কাহিনী।
প্রথমে যুদ্ধবন্দিদের মরণপণ লড়াই দিয়ে শুরু। যতক্ষণ না দুইজনের একজনের মৃত্যু হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত চলত লড়াই। পরে প্রচলন হয় গ্লাড়িয়েটরসদের লড়াইয়ের। ‘গ্ল্যাডিয়াস’ অর্থ খাটো তরবারী। এ তরবারী দিয়ে লড়াইকারীদের বলা হতো গ্ল্যাডিয়েটর। রোমান ভ্যতায় গ্লাডিয়েটররা ছিল সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। গ্লাডিয়েটরদের কোন সামাজিক মর্যাদা থাকত না। তাদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করা হতো, ব্যবহার করা হতো এ ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের মঞ্চে। লড়াই চলাকালে কোনো এক গ্ল্যাডিয়েটর আহত হয়ে পড়ে গেলে উল্লাসে ফেটে পড়ত পুরো কলোসিয়াম।
মৃত্যু ভয়ে ভীত, ক্ষত-বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটর রেওয়াজ অনুযায়ী হাত তুলে সম্রাটের করুণা প্রার্থনা করত, প্রাণভিক্ষা চাইত। মঞ্জুর করা না করা সম্পূর্ণ সম্রাটের মেজাজের ওপর নির্ভর করত। সম্রাট ক্ষমা করলে সে যাত্রায় বেঁচে যেত পরাজিত গ্লাডিয়েটরস আর না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত রক্ত ঝরেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে রোমের কলোসিয়াম এর এক চিলতে মাটিতে।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে আঠার শতক পর্যন্ত কলোসিয়াম ছিল প্রায় অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। যদিও এর মাঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সেসময়কালে এটি রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোন প্রচেষ্টা ছিল না বললেই চলে। বহু বছরের অবহেলায় কলোসিয়ামের মূল স্থাপত্যের দুই-তৃতীয়াংশ ই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু আজও এই কলোসিয়াম পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় একটি টুরিস্ট স্পট হিসেবে খ্যাত। ইতালির সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট এটি। কলোসিয়াম দেখার জন্য প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায় ইতালিতে।
কলোসিয়াম দেখতে বহু মানুষই যায়। গ্লাডিয়েটরদের লড়াইয়ের জন্য বিখ্যাত এটি। তবে তাদের হয়ত জানা নেই, কলোসিয়ামের নাম আগে কলোজিয়াম ছিল না। এটি অতীতে যখন নির্মিত হয় তখন তাকে ‘বড় কিছু’ বলে ডাকা হত। পরবর্তীতে প্রায় এক হাজার বছর আগে এর নাম হয় কলোসিয়াম।
রোমের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটারটি নির্মিত হয়েছিল বিজয়ী রোমান সৈন্যদের পুরস্কৃত করার জন্য এবং রোম সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা তুলে ধরার জন্য। এর পরিকল্পনা ও নকশা আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক এবং আজ ২০০০ বছর পরেও ওই কলোসিয়ামের অতুলনীয় নকশার অমোঘ ছাপ আধুনিক যুগের প্রায় প্রতিটি ক্রীড়াঙ্গনেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেইসময়ের দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য ওই কলোসিয়ামের আঙিনায় ঘটে যাওয়া নৃশংস মারামারি এবং খেলাধুলো সম্পর্কে আজকাল ছায়াছবি এবং ইতিহাসের বইপত্রের মাধ্যমে আমরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল, যা তখনকার দর্শকদের আনন্দ দিত।