ভারতীয় উপমহাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী প্রাচীন নগরী কলকাতা। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এই জনবহুল শহরটি ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ও একমাত্র প্রধান নদী বন্দর। বিখ্যাত সব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদরেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে আনন্দ নগর হিসেবে খ্যাত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ ভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ভ্রমণের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নিন।
কলকাতার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
বিশাল শ্বেত-শুভ্র এই মার্বেল ভবনটি কলকাতার গর্ব বুকে ধারণ করে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। রাণী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই স্থাপনাটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট।
ফোর্ট উইলিয়াম
ফোর্ট উইলিয়াম গঙ্গার প্রধান শাখা হুগলি নদীর পূর্ব তীরে নির্মিত একটি দুর্গ। চমৎকার কাঠামোটি ৭০ দশমিক ৯ একর জুড়ে বিস্তৃত। শত শত খিলানযুক্ত জানালা দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে যা সবুজ বাগানগুলোকে ছাপিয়ে যায়।
হাওড়া ব্রিজ
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর ওপর অবস্থিত হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু হাওড়া এবং কলকাতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। দিনে ও রাতে হুগলি নদী ও এর আশপাশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য ব্রিজটি স্থানীয় ও বিদেশিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বিজ্ঞান নগরী
ভারতে এই অত্যাধুনিক ধরনের এলাকাটি ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই উদ্বোধন করা হয়েছিল। এটি কলকাতার বাসিন্দাদের পাশাপাশি পর্যটকদের একটি প্রধান আকর্ষণ। এটি বিশ্বের সেরা ও বৃহত্তম বিজ্ঞান জাদুঘরগুলোর মধ্যে একটি।
পার্ক স্ট্রিট
পার্ক স্ট্রিট কলকাতার একটি প্রধান প্রবেশ পথ, যা আনুষ্ঠানিকভাবে মাদার তেরেসা সরণি নামেও পরিচিত। রাস্তাটি চৌরঙ্গি রোড বা জওহরলাল নেহেরু রোড থেকে শুরু হয়ে পার্ক সার্কাস ক্রসিং পর্যন্ত প্রসারিত। বলা হয় যে পার্ক স্ট্রিট কখনই ঘুমায় না এবং সর্বদা ব্যস্ত থাকে।
কলকাতা ভ্রমণের সেরা সময়
গ্রীষ্মকাল বাদে বছরের সারা সময়ই কলকাতা ঘোরা যায়। তবে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির শীত কলকাতা ভ্রমণের সবচেয়ে সেরা সময়।
ভারতের ভ্রমণ ভিসা পাওয়ার উপায়
কলকাতায় ঘুরতে যেতে প্রথমেই যে কাজটি প্রয়োজন তা হলো ভারতের ভ্রমণ ভিসা পাওয়ার। এর জন্য অনলাইনে ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
আবেদনপত্র পূরণ করার সময় তিনটি জিনিস লাগবে।
– কমপক্ষে ছয় মাস মেয়াদ সম্পন্ন পাসপোর্টের স্ক্যান কপি (যে পৃষ্ঠাগুলোতে পাসপোর্টধারীর তথ্যাদি দেয়া থাকে)
– সদ্য তোলা অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যে তোলা পাসপোর্ট সাইজ ছবির স্ক্যান কপি
– ভারতে যেয়ে যে হোটেল থাকার জন্য ঠিক করা হয়েছে তার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার
আবেদনপত্র পূরণ করার পর সেটা প্রিন্ট করে তাতে ছবির অংশের নিচে ও শেষ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করতে হবে। স্বাক্ষরটি অবশ্যই পাসপোর্টের স্বাক্ষরের সঙ্গে হুবহু মিলতে হবে। ছবির অংশে আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ছবিটি আঠা দিয়ে যুক্ত করতে হবে।
পরে অনলাইনে ভারতীয় ভিসার প্রসেসিং ফি বাবদ ৮০০ টাকা জমা দিতে হবে। এরপর ভিসার জন্য আনুষঙ্গিক কিছু কাগজপত্র জমা দেয়ার পালা।
এর মধ্যে যা করবেন, তা হলো- পাসপোর্টের ফটোকপি। পুরোনো পাসপোর্ট থাকলে সেগুলোও সঙ্গে দিতে হবে।
আবেদনকারীর বর্তমান ঠিকানার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ কোন বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাস বিলের ফটোকপি।
চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে পেশার প্রমাণ স্বরূপ অফিস থেকে একটা সনদ সংগ্রহ করতে হবে। যেখানে অফিসের নাম ও আবেদনকারীর পদবীসহ উল্লেখ থাকতে হবে যে, ভারত ভ্রমণে অফিসের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। শিক্ষার্থী হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার্থী আইডি কার্ডের ফটোকপি দিতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত হলে সর্বশেষ চাকরির ছাড়পত্র সংযোজন করতে হবে।
আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ স্বরূপ আবেদনকারির পাসপোর্ট-এ ব্যাংক থেকে ১৫০ ডলার এনডোর্স করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পাসপোর্টের ক্রেডিট কার্ড এনডোর্স করা পৃষ্ঠাটি ফটোকপি এবং ক্রেডিট কার্ডের উভয় অংশের ফটোকপি দিতে হবে।
আবেদনকারীর ন্যাশনাল আইডি কার্ডের উভয় পিঠের ফটোকপি। এই আইডি কার্ড না থাকলে জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি দিতে হবে। এগুলোর তথ্যাদি অবশ্যই পাসপোর্টের তথ্যের সঙ্গে মিল হতে হবে।
অতঃপর কাগজগুলোসহ আবেদনপত্র নিকটস্থ ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভ্যাক)-এ জমা দিতে হবে। এ সময় আইভ্যাকের কর্মকর্তারা পুরো আবেদনসহ পাসপোর্ট জমা রেখে একটা টোকেন দিবে। এই টোকেনে উল্লেখিত দিনেই আবেদনকারি ভিসা সহ পাসপোর্টটি সংগ্রহ করতে পারবেন।
ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার উপায়
ঢাকার শ্যামলী থেকে সরাসরি কলকাতার বাস পাওয়া যায়। এগুলোতে বাসের ধরন ভেদে নন-এসিতে মাথাপিছু ভাড়া ৮৯০ থেকে ৯০০ টাকা আর এসিতে ১৫০০ থেকে ১৯০০ টাকা। এখানে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা।
ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ট্রেনে করে সরাসরি কলকাতায় যাওয়া যায়। এখানে ৫০০ টাকা ট্রাভেল ট্যাক্সসহ এসি সিটের খরচ ৩,৪৩৫ টাকা ও নন এসি চেয়ার ভাড়া ২,৪৫৫ টাকা। এই যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় ১৩ ঘণ্টা।
বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে কম সময়ে এবং আরাম-আয়েশে কলকাতা যাবার উপায় হলো আকাশপথ। ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন ফ্লাইট কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে গিয়ে নামে। এখানে এয়ারলাইন্স কোম্পানি ভেদে টিকেটের মূল্য ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা, আর সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টার মত।
ভ্রমণের সময় কলকাতায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
কলকাতায় ভ্রমণকারিদের থাকার জন্য অনেক হোটেল ও গেস্ট হাউজ রয়েছে। কলকাতার মারকুইস স্ট্রিট পার্ক, নিউমার্কেট, রফি আহমেদ রোড ও সদর স্ট্রিটের হোটেলগুলোতে বাজেট অনুযায়ী থাকা যায়। মোটামুটি ভালো মানের নন এসি রুম এখানে ৮০০ থেকে ১২০০ রুপির মধ্যে এবং এসি রুম ১৭০০ রুপির মধ্যে পাওয়া যায়। তবে ঘোরাঘুরির সিজনগুলোতে পর্যটকদের চাপ বেশি হলে পাল্লা দিয়ে ভাড়াটাও বেড়ে যায়।
কলকাতায় স্থানীয়দের কাছে মিষ্টি বেশ প্রিয় খাবার। তাই শহরের অলিতে-গোলিতে মিষ্টি, রসগোল্লা আর সন্দেশের দোকানে ভরপুর। কলকাতার স্ট্রিট ফুডের মধ্যে মমো, চা সিঙারা, আলু পরোটা, পানি পুরি, মোগলাই পরোটা, চীনা টাউনের চীনা খাবার, কাচুরি ও মাটির ছোট ভারে চা বেশ জনপ্রিয়।
সবশেষে যা বলবো, তা হলো বাস, ট্রেন, বিমান যেকোনো মাধ্যমে কলকাতা যাওয়ার টিকেট কাটার সময় পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে হবে। যেহেতু কলকাতার ভাষাও বাংলা, তাই বাংলাদেশি ভ্রমণকারীরা মার্জিত ব্যবহারের বিনিময়ে নিমেষেই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আশা করতে পারেন। পাশাপাশি ভ্রমণের সময় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা পরিহার করে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল থাকা ও সঙ্গীদেরও তা করতে উৎসাহিত করা আবশ্যক।