কলকাতা শহরে প্রধান সড়কের মাঝে কোনো কোনো অংশে ট্রেনের লাইনের মতো দেখে অবাক হলাম! এখানে কি একসময় ট্রেন চলতো? কিন্তু এই ট্রেনের লাইন ছোট কেন? হঠাৎই লক্ষ্য করলাম, বাসের মতো দেখতে এক ধরনের বিশেষ যান। যানবাহনটির মেশিন চলে বিদ্যুতে, জানালা-দরজাও রয়েছে। ভেতরে অল্প সংখ্যায় যাত্রী। এটাই হলো ট্রাম। ট্রাম হলো এক ধরনের পৌর রেল, যা শহরের রাস্তার ওপর বিছানো ট্র্যাকের ওপর দিয়ে চলাচল করে। ট্র্যাকের কিছু অংশ রাস্তার থেকে পৃথকও হতে পারে। উত্তর আমেরিকায় ট্রামকে ট্রলি বা স্ট্রিটকার নামে অভিহিত করা হয়। কলকাতার ট্রামের কথা ভাবলেই কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায়। যদিও তার মৃত্যু দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে আজও রহস্য রয়ে গেছে।
কলকাতায় ট্রাম
ট্রাম কলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা এবং ভারতের প্রথম ও একমাত্র পরিষেবা প্রদানকারী। ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা কলকাতায় প্রথম চালু হয় ১৮৭৩ সালে আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত। যার দৈর্ঘ ছিল ৩.৯ কিলোমিটার। সেই সময় যাত্রীর অভাবে ট্রাম পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি নামে একটি লন্ডনভিত্তিক কোম্পানি এরপরে কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে। প্রথমদিকে ঘোড়া টানা ট্রাম ব্যবহার করা হলেও পরে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহৃত হতো ট্রাম চালানোর জন্য। ১৯০২ সালে ট্রাম চালানোর জন্য এশিয়ায় প্রথম বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে ট্রাম
বিশ্বজুড়ে প্রায় আটশ ট্রাম ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১০টি ট্রাম ব্যবস্থা চালু হয় এবং বেশ কিছু প্রসারিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ট্রাম ব্যবস্থা চালু ছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বিভিন্ন কারণে বেশিরভাগ কানাডীয়, ফরাসি, ব্রিটিশ ও মার্কিন শহরজুড়ে এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছিল। নেদারল্যান্ডসে ট্রাম অজনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের বহু প্রধান শহরে ট্রাম ব্যবস্থা এখনো প্রচলিত। বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাম ব্যবস্থা হলো মেলবোর্ন ট্রাম, যার দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার। আশির দশকে তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ ট্রাম নেটওয়ার্কটি কিছুকালের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাম নেটওয়ার্ক হিসেবে ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে’ স্থান পেয়েছিল।
বর্তমানে কলকাতার ট্রামের একটি ডিপো, দুটি টার্মিনালে যাত্রী চলাচল রয়েছে। ট্রাম চলে ঘরিয়াহাট থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত এবং এসপ্ল্যানেড থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত। নিকট অতীতে সচল ট্রামের সংখ্যা বেশি ছিল। তখন ট্রামের সচল ডিপো ও টার্মিনালের সংখ্যাও বেশি ছিল। বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ, কালিঘাট ও খিদিরপুর হলো কলকাতা ট্রামের সাতটি ডিপো। ট্রামের টার্মিনাল ছিল নয়টি; শ্যামবাজার, গালিব স্ট্রিট, বিধাননগর, বালিগঞ্জ, এসপ্লানেড, বিবাদিবাগ ও হাওড়া ব্রিজ। বালিগঞ্জ থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত ট্রাম চলাচল রাস্তার নির্মাণ কাজের জন্য সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।
ট্রামের কমপক্ষে দুটি কামরা থাকে। ইদানীং এক কামরার ট্রামও চলতে দেখা যায়। ভোর ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ট্রাম চলার কথা থাকলেও মূলত সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ট্রামের সার্ভিস মেলে। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে ট্রামের সর্বোচ্চ ভাড়া মাত্র ৭ টাকা। কালেভদ্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম চলে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রামের ভাড়া পঁচিশ টাকা।
ট্রামে বসার সিট বড্ড সেকেলে। নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক সুবিধা যুক্ত না করা, সময় সাপেক্ষ হওয়ায় ট্রাম যাত্রীদের প্রথম পছন্দ নয়। তবে আমার মতো পর্যটকদের ট্রাম পছন্দ। আসলে ট্রাম অলাভজনক প্রজেক্ট। ট্রাম চালিয়ে বাণিজ্যিক কোনো লাভ আসে বলে মনে হয়নি। ট্রামের অধিকাংশ সিট ফাঁকা থাকে। কারণ পর্যাপ্ত যাত্রীর অভাব। কলকাতার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ট্রাম উন্নত পরিষেবাসহ চালু রাখতে হবে। ট্রাম শুধু কি ট্রাম? বরং ট্রামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে দেড়শ বছরের ইতিহাস।
ঢাকার বুকে ট্রাম পরীক্ষামূলক চালিয়ে দেখা যেতে পারে। মেট্রোরেলের পাশাপাশি ট্রামও নাগরিকদের সেবা দিতে পারবে। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে ও বেসরকারি বাহনগুলোর প্রতি নির্ভরতা কমাতে ট্রাম উপযুক্ত হবে। ট্রাম চালু হলে আমরাও শুনতে পাবো ট্রামের টং টং বেলের শব্দ। যে শব্দ শুনে রোজ দিনাতিপাত করেছেন কলকাতার রথী-মহারথী ও সাধারণ মানুষ। কলকাতার ট্রাম এক নির্মম সত্য, যা নিপুণভাবে তুলে ধরেছে কলকাতার জনসংস্কৃতি।