বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৫৪ অপরাহ্ন

কম সুরক্ষার হার সত্ত্বেও ইইউতে বিপুল বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

২০২৪ সালের শুরু থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে তৃতীয় শীর্ষ তালিকায় আছে বাংলাদেশিরা। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের সুরক্ষা পাওয়ার হার খুবই কম।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর এসাইলাম (ইইউএএ) জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশিদের ইইউভুক্ত দেশগুলোতে সুরক্ষা পাওয়ার হার মাত্র ৫ শতাংশ।

মূলত ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে আফ্রিকার দেশ মালি এবং সেনেগালের পরেই আছেন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীরা।

চলতি বছরের মার্চ মাসে এনজিও ইমার্জেন্সির মানবিক উদ্ধার জাহাজ লাইফ সাপোর্টেরর একটি উদ্ধার অভিযান অনুসরণ করে ইনফোমাইগ্রেন্টস। সেখানে উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের ৭১ জনের মধ্যে ৬০ জনই ছিল বাংলাদেশি নাগরিক, যাদের অধিকাংশই তরুণ।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশিদের অভিবাসন প্রধান উপসাগরীয় দেশগুলো (সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত) প্রভৃতি দেশকেন্দ্রীক। যেখানে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে স্বল্প-দক্ষ এবং সস্তা শ্রমকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশিরা গিয়ে থাকে। এসব দেশে মালিক তথা স্থানীয় নিয়োগকর্তারাসহ পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা, বেতন না দেওয়া, অপব্যবহার এবং শ্রম শোষণের মতো হাজারো অভিযোগ রয়েছে।

অভিবাসীদের অনেকেই এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে লিবিয়ায় যান। যদিও লিবিয়ায় ৮০ দশক থেকে নিয়মিত বাংলাদেশিরা কাজের ভিসায় যাচ্ছেন। কিন্তু মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর দেশটির অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অনেকেই অবগত নন।

এর আগে ২০১৭ সালে ভূমধ্যসাগরের ঝুঁকি থেকে উদ্ধার হওয়া অনেক বাংলাদেশির সাথে কথা বলেছিল ইনফোমাইগ্রেন্টস। সাত বছর পর লাইফ সাপোর্টের জাহাজে একই গল্প শোনা গেল তাদের মুখে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ

২১ বছর বয়সি বাংলাদেশি অভিবাসী করিম*। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। লিবিয়ার ত্রিপোলিতে গিয়েছিলেন কাজের ভিসায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পরিচিত হন ঢাকার এক ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে। তাদের সহায়তায় তিন লাখ টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পূর্বে অবস্থিত তব্রুকে পৌঁছান তিনি।

জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন সেন্টার ফর ডিপেনডেন্সি অ্যান্ড স্লেভারি স্টাডিজের গবেষক আনাস আনসার বাংলাদেশিদের অভিবাসন নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “এটি একটি সাধারণ অনুশীলন।”

অভিবাসন নিয়ে বাংলা ভাষায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টিকটকে আছে প্রচুর আলোচনা। মানব পাচাকারীদের সাথে সংযুক্ত হয়ে ইউরোপের দিকে যাত্রার আগ পর্যন্ত অভিবাসীরা প্রায়শই তাদের লোভনীয় কথার ফাঁদে পা দেন। পাচারকারীদের দেয়া এসব তথ্যগুলো প্রায়ই মিথ্যা ও ভুল হয়ে থাকে।

ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের অনুপস্থিতি

আনাস আনসার ব্যাখ্যা করেন, “পাচারকারীরা সরাসরি কারো সঙ্গে দেখা করে না। সবকিছুই হয় সামাজিক মাধ্যমে। যেখানে অভিবাসন নিয়ে হাজার হাজার গ্রুপ ও পাতা আছে। মূলত এমন ব্যবস্থা চোরাকারবারিদের পক্ষে কাজ করে।”

তিনি আরও বলেন, “ওয়েব জায়ান্টদের ব্যবহার অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্যকরভাবে বাংলা ভাষায় সম্প্রচারিত সব তথ্য যাচাই করতে সক্ষম নয়। এই সুযোগে অনেকেই এসব মাধ্যমে থাকা তথ্য বিশ্বাস করে।”

ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া পোস্টগুলোতে পাচার চক্র সাধারণত ইতিমধ্যে যেসব বাংলাদেশি সফলভাবে ইউরোপে পৌঁছতে পেরেছে তাদের সাফল্যের গল্প প্রচার করে। এটির মাধ্যমে তারা প্রাথমিকভাবে নতুন গ্রাহকের সন্ধান করেন। প্রচার হওয়া এসব গল্পের সব বাস্তবাতা নিয়েও নেই কার্যকর ফ্যাক্ট-চেকিং।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দম্পতিদের বিভিন্ন ভ্লগ ও ভিডিও তরুণদের ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোতে আসতেও আগ্রহী করে তুলছে। বিশেষ করে, যেসব বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বিয়ে করে জীবনের বিভিন্ন অংশ ভ্লগে তুলে ধরছেন তাদের ভিডিও লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখতে দেখা গেছে।

আনাস আনসার বলেন, “আপনি বাংলাদেশে গেলে তরুণদের সাথে কথা বললে তারা ভাইরাল দম্পতিদের সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করবে।”

লিবিয়ায় শোষণ

অভিবাসী করিম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, তিনি লিবিয়ার তব্রুকে আসার পর সেখান থেকে ত্রিপোলিতে গিয়েছিলেন। যেখানে তিনি নাইজেরিয়া এবং মিশর থেকে আসা অন্যান্য অভিবাসীদের সাথে একটি সুপার মার্কেটে কাজ করছিলেন। ছয় মাস পরে তাকে তার বেতনের একটি পয়সাও দেয়া হয়নি বলে জানান করিম।

এছাড়া লিবিয়ার তার নিয়োগকর্তারাও তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট রেখে দেন যাতে তিনি কোথাও যেতে না পারেন এবং কেবলমাত্র ওই ব্যক্তির আওতায় কাজ করতে বাধ্য হন।

করিম বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে আমি বাংলাদেশে ফেরা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই আমি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছি। আমি জানতাম এটা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।”

আরেক অভিবাসী ১৯ বছর বয়সি মাহমুদও ইনফোমাইগ্রেন্টসকে কাছাকাছি অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনিও ঢাকা থেকে এসেছেন।

তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে বিমানযোগে এসেছিলেন। সেখান থেকে তিনি ত্রিপোলি যান। তিনি নয় লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়ায় যাওয়ার তথ্য দেন।

মাহমুদ জানান, তিনি লিবিয়ায় কাপড়ের ব্যাগ তৈরির কারখানায় দুই মাস কাজ করেন। কিন্তু তাকে দুইপার হলেও বেতন দেওয়া হয়নি। বারবার টাকা দিতে বললে নিয়োগকর্তারা তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেন। তারা তাকে বারবার বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি কোন টাকা না পাওয়ার কথা জানান।

পারিবারিক অভিবাসন

উদ্ধার জাহাজে থাকা ৪৪ বছর বয়সি রহমান ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, তিনি ঢাকার একটি হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। যেখানে তিনি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা উপার্জন করতেন।

তবে তার বেতনের অর্ধেক তার ছেলের পড়ালেখার পেছনে খরচ হতো বলে জানান চার সদস্যের পরিবারের এই কর্তা। রহমান বলেন, ঢাকায় তার নিজের পরিবারের খরচ ছাড়াও গ্রামে তাকে তাকে তার মা, বাবা এবং ভাইবোনদের ভরণপোষণ দিতে হতো।

লিবিয়ায় এসে ইউরোপে যাওয়ার জন্য তিনি পাচারকারীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া পাঁচ হাজার ডলার পরিশোধ করতে তিনি পারিবারিক সম্পত্তি এবং স্ত্রীর ব্যবহৃত স্বর্নের গয়না বিক্রি করে দেন।

বন বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাস আনসার ব্যাখ্যা করেন, “অভিবাসন দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশিদের পরিবারগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতির এক ধরনের ‘কৌশল’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পরিবারের মধ্যে যা বিদেশে পৌঁছানোর সম্বানা সবচেয়ে বেশি তাকে সবাই সহায়তা করে থাকেন। পরবর্তীতে যিনি পৌঁছান তার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, ‘চেইন মাইগ্রেশন’ বা একের পর বাকিদের নিয়ে যাওয়া।”

অনিশ্চিত জীবন

ইউরোপে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন খুব কমই গৃহীত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর এসাইলাম অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ সুরক্ষা পেয়েছে।

বাংলাদেশি অভিবাসীরা যখন ইটালিতে পৌঁছান তাদেরকে আশ্রয় আবেদনের প্রক্রিয়া চলমান সময় সাধারণত আশ্রয় অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাখা হয়। সুরক্ষা পাওয়ার অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও, তাদেরকে অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়া ইটালীয় ভাষা শেখার কোর্সে অংশ নিতে হয় এবং। অস্থায়ী অনুমতিতে সাধারণত কাজ করার অনুমতি দেয়।

ভেনিসের সা ফসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফ্রান্সেসকো ডেলা পাপ্পা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমিতে’ কাজ করেন। ইটালিসহ বেশ কিছু দেশের অর্থনীতিতে এই সেক্টর আংশিকভাবে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে ক্যাটারিং বা হোটেল খাতে প্রচুর লোককে কাজ করতে দেখা যায়।”

এই অভিবাসী শ্রমিকরা অনেক নিয়োগকর্তাদের জন্য খুবই লাভজনক উপায় হয়ে দাঁড়ায়। অনেক কর্মিদের প্রতি ঘন্টায় মাত্র দুই ইউরো বেতন দেওয়া হয়।

এই গবেষক বলেন, “ইটালির একজন বাংলাদেশির সকল আশ্রয়ের আবেদন শেষ হয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে সাধারণত ইটালীয় কর্তৃপক্ষ নির্বাসনের নোটিশ জারি করতে পারে। তবে বাংলাদেশিদের খুব কমই জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয়। কারণ গণ প্রত্যাবাসন ইটালীয় সরকারের জন্য খুব ব্যয়বহুল একটি উদ্যোগ।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ইটালির পুলিশ জানে কোথায় অনথিভুক্ত অভিবাসীরা থাকেন এবং কাজ করেন। কিন্তু তারা এটা নিয়ে তেমন কোন চিন্তা করে না। আমরা জানি এসব খাঁতে সেখানে প্রচুর অভিবাসী আছে। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের প্রয়োজন। তাই তাদের নির্বাসনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয় না। অনিয়মিতদের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারের কাছে এটি একটি বিশাল খরচ।

বেড়েছে জোরপূর্বক ‘ডিপোর্ট’

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ এবং ২০২২ সালে দুই হাজারেরও কম বাংলাদেশিকে অভিবাসীকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

তবে গত বছরের ইউরোস্ট্যাট প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর হার ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩৫,৪ শতাংশ বেড়েছে।

গত বছরের নয় মাসের হিসেবে ফেরত পাঠানোর তালিকায় তৃতীয় শীর্ষে দেশ বাংলাদেশ।

ওই সময় মোট ৮৩৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ইইউর বিভিন্ন দেশ থেকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। যেখানে ২০২২ সালের পুরো সময়জুড়ে সংখ্যাটি ছিল ৫৩৫ জন।

স্পষ্টত ২০২২ সালের পুরো সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশিদের ডিপোর্টের হার ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৪ সালের শুরুতে ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস থেকে মোট ৫১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

সম্প্রতি ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছে, বিগত বছরগুলোতে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কনসুলার পাস পেতে জটিলতা ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এই ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নতি হয়েছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com