হঠাৎ করে চোখে পড়ল গেট ১-এর একটা বিজ্ঞাপন। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। ১৪ দিনের সফর। দামটা কম মনে হলো। তিন বন্ধুকে ফোন করলাম। তিনজন রাজি। দুই মাস পরে যাত্রা। কোথা দিয়ে কেটে গেল দুটি মাস। আমরা রওয়ানা হলাম। নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস। সেখান থেকে সিডনি। সব মিলিয়ে উনিশ ঘণ্টার পথ। প্লেনে পরিচয় হলো দুই জনের সাথে। ওরাও একই প্যাকেজ নিয়েছে। প্লেনে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম আজ আর নেই। যাক বাঁচা গেল। এই ভেবে সীট বেল্টটা বেঁধে বসলাম। প্লেনে কোনদিনই আমি ঘুমাতে পারিনা। অথচ সেইদিন ঘুম এসে গেল। ছেলেমেয়েরা বলে দিয়েছে উঠে হাঁটা চলাফেরা করতে। করিনি যে তা নয়। তবে অতটা নয়।

অকল্যান্ড থেকে প্লেন চেঞ্জ করে সিডনিতে যখন এসে পৌঁছালাম তখন সকাল সাড়ে দশটা। হাতে ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের ট্যুর গাইড। পরিচয় হলো। নাম ডানা। আমাদের গ্রæপে সব মিলিয়ে ১৬ জন। সবাই আমরা আমেরিকা থেকে এসেছি। বিরাট বাসের ভিতর আমরা ১৬ জন। বাহিরে ঝলমলে রোদ। তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। নিয়ে এলো হোটেলে। Rydges World Square.  লোকেশনটা এমন এক জায়গায় যেখান থেকে বিখ্যাত অপেরা হাউস খুব বেশি দূরে নয়। দূরে নয় হাইড পার্ক।

লম্বা একটা ঘুম দিলাম রুমে এসে। রাতে ডিনারে সবার সাথে দেখা হলো। নাম আদান প্রদান হলো।

রাতের ঘুমটা খুব একটা ভালো হলো না। নাই বা হলো। এসেছি আনন্দ ফুর্তি করতে। ঘুম নিয়ে গবেষণা করলে তো চলবে না। সকাল সাতটার সময় নিচে নেমে এলাম। নয়টায় গাড়ি আসবে। ডাইনিং রুমে এলাম।

বিভিন্ন রকমের নাস্তা সাজানো। চার জনের একটা টেবিল নিয়ে আমরা চারজন বসলাম।

আব্বাস আর নাফিসা সুপ্রভাত জানালো টেবিলের কাছে এসে। ওরা এসেছে শিকাগো থেকে। পাশের টেবিলে বসা স্যান্ডি আর বারবারা।

এগ হোয়াইটের অমলেট অর্ডার দিয়ে কফির সরঞ্জামের দিকে এগিয়ে গেলাম। সকালের কফির স্বাদই আলাদা। ওটা নাহলে আমার দিনই অচল। বড় একটা প্লেটে সাজিয়ে নিলাম চিকেন সসেজ, পটেটো ফ্রাইজ, ডেনিশ আর টোস্ট। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েটার এসে দিয়ে গেল অমলেটটা।

খাওয়ার মাঝেই কাঁধের ওপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ফিরে তাকাতেই ডানা বলল, ঘুম হয়েছে কি?

-না তেমন আর হলো কই। বলে হাসলাম।

-নয়টায় আমরা বেরিয়ে পড়বো। পানি গাড়িতে আছে। বলে সে অন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

সিডনিতে আসবে আর অপেরা হাউস দেখবে না তাহলে তো এখানে আসাই বৃথা। দেখলাম। দেখলাম হারবার ব্রিজ।

সেলফি ওঠানোর চেষ্টা করছিলাম অপেরা হাউস আর ব্রিজটাকে নিয়ে,

-আমাকে দাও তোমাদের সবার ছবি উঠিয়ে দেই। সোনালি চুলগুলো ঘাড়ের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল, বারবারা।

-অবশ্যই।

বেশ কয়েকটা ছবি সে উঠিয়ে দিল।

বললাম তোমরা এসো আমাদের সাথে সেলফি করি।

স্যান্ডি আর বারবারা থাকে রোড আইল্যান্ডে।

বললাম অনেক বার গিয়েছি ওখানে। নিউ পোর্টের পানির পাশ দিয়ে হেঁটেছি।

-আমরা থাকি প্রভিডেন্সে। বলল বারবারা।

-তুমি আর স্যান্ডি দুজনে মিললে কিভাবে? একটা বেঞ্চে বসে জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।

-একই স্কুলে কাজ করতাম আমরা দুজনে। অনেক অনেক অনেক বছর ধরে। দুজনেই হারালাম দুজনের সঙ্গীকে। তাও তো দশ বছর হয়ে গেল। রিটায়ার করে এখন আমরা দুজনে একসাথে ঘুরে বেড়াই।

মনে হলো অনেক দিন পর সে পেয়েছে কাউকে তার মনের খবর উজাড় করে দিতে।

-জানো সেই দিনটা ভুলতে পারিনা। বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।

আমিও ওকে সময় দিলাম। ওর মনের কথা এক অপরিচিত মানুষকে বলতে চায়। হালকা হতে চায়।

দূরে সিডনি হারবারের শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, আস্তে আস্তে আমার দিকে তাকালো।

-আমার ছেলের সাথে কথা বলছিলাম ফোনে। দরজায় টোকার শব্দে উঠে গেলাম। দরজা খুলতেই দেখি দুজন পুলিশ দাঁড়ানো। ভয় পেয়ে গেলাম। পুলিশ কেন আমার দরজায়।

-তোমার স্বামীর নাম জন সেলবি? পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো আমাকে।

-হ্যাঁ, বলতেই বলল, আমাদের সাথে তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। তোমার স্বামী গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে।

আমি এলাম হাসপাতালে। ওকে নিয়ে গেছে অপারেটিং রুমে।

বসে রইলাম সারা রাত।

ওকে ওরা ফিরিয়ে আনতে পারলো না।

আমার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হলো না। ও আমাকে বিদায় জানাতে পারলো না। আমি একা হয়ে গেলাম।

আমি ওর চোখে পানির রেখা দেখতে পেলাম।

-কি রে তোরা যাবি না? স্যান্ডি জোরে ডাক দিল। ওদিকে ডানা অপেক্ষা করছে। বলে স্যান্ডি আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

সবাই বাসে উঠে গেছে। শুধু আমরা তিন জন বাকি।

বাস পার্লামেন্ট হাউজ, সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রাল, কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং ঘুরে বাঁক নিলো ডানে।

অবশেষে দি রক্স। ঐতিহাসিক এলাকা। প্রতিষ্ঠিত করেছিল আরথার ফিলিপস তার পড়হারপঃংদের দিয়ে। আমাদের কেউ কেউ লোকাল শপগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। দাম-দর করে পিছিয়ে এলো।

বাস দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এলাম বাসের কাছে।

সন্ধ্যায় ডিনার ক্রুজ। সিডনি হারবারে। জাহাজের নাম ক্যাপ্টেন কুক ক্রুজ। টেবিল রিজার্ভ ছিল আমাদের জন্য। ডিনার মেনুতে ছিল Barramundi fish filet, chicken cutlet সালাদ। সব শেষে ভেনিলা চকলেট কেক।

দেড় ঘণ্টার ক্রুজ। জাহাজটা চলছিল অপেরা হাউজের পাশ দিয়ে, বড় বড় নায়ক নায়িকাদের বাসার কোল ঘেঁষে। সময় পেরিয়ে গেল। আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।

পরের দিন যাবো Blue Mountain দেখতে। ডানা বলে দিয়েছিল সকাল সাড়ে আটটায় যেন আমরা লবিতে থাকি।

সকালে নামতে একটু দেরি হয়ে গেল। এসে দেখি সবাই নাস্তার রুমে এসে গেছে। রউফকে বললাম, আজ বোধহয় অমলেট খাওয়া হলো না।

-আমি ওটা না খেয়ে যাবো না। বলে সে দাড়িয়ে রইল অর্ডার দেওয়ার জন্য।

না, খুব একটা দেরি হয়নি। প্রধান বাবুর্চি তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিলো।

নাস্তা শেষে বাইরে এসে দেখি আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে।

লিলি পাশে এসে বলল, ক্রস ইওর ফিঙ্গার। যেন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। নচেৎ যাওয়াই বৃথা।

লিলি আর ক্যাথলিন এসেছে সানডিয়াগো থেকে।

বাস ছেড়ে দিলো ঠিক সাড়ে আটটায়।

যাবো Katoomba তে।

যাওয়ার পথে থামলাম Featherdale Wild Parkএ। আছে কোয়ালাস, ক্যাঙ্গারু, পেঙ্গুইন, বিভিন্ন রং এর কাকাতুয়া। ছোট্ট প্যাকেটে খাবার কিনে নিলাম ক্যাঙ্গারুকে খাওয়াবো বলে। ডানা বলে দিয়েছে বেশি সময় এখানে কাটানো যাবে না। কেননা যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় তাহলে Blue Mountain. যাওয়াটাই বৃথা।

আমরা সবাই এলাম গাড়িতে, কিন্তু বিল আর ভিকি কোথায়? ওরা তো এসে পৌঁছায়নি। ফোন এখানে কাজ করে না। ডানা বাইরে পায়চারি করছে। ১৫ মিনিট কেটে গেল। ডেভিড বলল, আমি গিয়ে দেখি ওরা কোথায়।

ডানা রাজি হলো না।

কিছুক্ষণ পরে দূরে দেখা গেল ওরা আসছে। হাসছে। বলল, কাকাতুয়াগুলো দেখেছ, কি সুন্দর। ওখানেই দেরি হয়ে গেল। স্যরি।

দূরের আকাশ কালো। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পড়ছে গাড়ির জানালায়। এখনো এক ঘণ্টার পথ। দূরে পাহাড় দেখা যায়। চলতে চলতে দেখতে পেলাম পাহাড়ের ওপর আলোর রেখা। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ডানা বলল, এ পাহাড় সে পাহাড় নয়।

এসে পৌঁছালাম রোদের ঝর্ণা নিয়ে। দূরের থেকে দেখলাম, মনে হলো নীল বø্যাংকেট পাতা আছে তাই এর নাম দিয়েছে ইষঁব গড়ঁহঃধরহ.

দূরের পাহাড় নীলাভ রঙ দিয়ে কে যেন এঁকেছে। আকাশ নীল রঙে ছেয়ে আছে। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য।

ঊপযড় চড়রহঃ থেকে দেখা ঔধসরংড়হ ঠধষষবু, ঞযব ঞযৎবব ঝরংঃবৎংএর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য।

দেখার কি শেষ আছে? ক্লান্ত হয়ে আমরা চারজন এসে বসলাম বেঞ্চে। হাঁটতে হাঁটতে এলো সফিয়া।

-কি ব্যাপার বসে কেন? পাহাড়ের নিচে নামোনি?

-নামতে তো পারবো, উঠতে পারবো তো? এই আশঙ্কায় আর যাওয়া হলো না। বলে বললাম, বসো।

ও এসে বসলো পাশে।

-ইব্রাহীম ভাই কোথায়? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সে নিচে গেছে, আমার হাঁটুতে ব্যথা। তাই আর সাহস করলাম না।

-ভালো করেছো।

কিছুক্ষণ চুপ চুপ আমরা সবাই।

সফিয়া কি যেন ভাবছে মনে হলো। তাকালও আমার দিকে। বলল, জানো আমার ছেলে অনী এখানে আমাদেরকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। চেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দেখবে।

-এবার তোমাদের সাথে আসতে পারেনি, পরে তোমাদেরকে নিয়ে আবার আসবে।

– না। সে আর হবার নয়। বলে তাকালো সামনে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো কবুতরগুলোর দিকে।

আমিও হতচ্ছাড়া, বলে বসলাম, তা হবার নয় কেন?

-সে চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে? বলে সজল নয়নে তাকালো আমার দিকে।

আমি আর কিছু তাকে জিজ্ঞাসা করিনি।

সেই বলেছিল, আমার ছেলে ছিল সোনার টুকরা। এখানেই জন্ম। সে ছিল াধষবফরপঃড়ৎরধহ তার ক্লাসে। ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। কার্ডিয়াক সার্জেন হয়ে যখন বের হলো, কত বড় বড় হসপিটাল থেকে ওর অফার এসেছিল। ও নেয়নি। পাছে আমাদের ছেড়ে বেশিদূর যেতে হয়। তাই মিশিগানের এক হসপিটালে চাকরি নিলো। ওখানেই পরিচয় হয়েছিল নাদিয়ার সাথে। সেও ডাক্তার। আমাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিল।

ওর বাবা বলেছিল, এবার বিয়ে করে ফেল। আমাদেরও তো বয়স হয়েছে।

বাঁধা আসেনি। ধুমধাম করে বিয়ে হলো।

দুই বছর পরে টুকটুকে একটা ছেলে এলো।

আমরা দাদা দাদি মিলে পালতাম। ওরা যেতো কাজে।

একদিন একটা অপারেশন শেষ করে বাসায় এসে সোজা শুতে চলে গেল। আমি এলাম ওর ঘরে।

বললাম, বাবা, খাবি না?

বলল, মাথাটা ভীষণ ধরেছে।

পীড়াপীড়ি করলাম না। ভাবলাম, খাটনি গেছে, তাই।

বৌমা এলো ঘণ্টা দেড়েক পরে। বললাম অনী তো শুয়ে পড়েছে মা, বলল মাথা ধরেছে।

-ওর ইদানিং প্রতিদিনই মাথা ধরছে। গত পরশু দিন তো বমিও করেছিল।

বললাম, তোমরা ডাক্তার, কেন একটা মাথার গজও করছ না।

-আমি ওকে বলেছি, শুধু আজ না কাল করছে। কালই আমি এপয়েন্টমেন্ট নেবো।

-গজও করেছিল? কেন যে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম। নিজেকে নিজে গালাগালি করলাম।

-হ্যাঁ করেছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক চিরে।

তাকাল নীল পাহাড়ের দিকে। আমিও চুপ করে রইলাম।

সফিয়া ফিরে এলো তার জগতে।

-টিউমার। ছোট নয়, বেশ বড়। আর মাথার এমন জায়গায় যে অপারেশনও করা যাবে না।

সে ডাক্তার সে নিজেই জানে বেশিদিন তার হাতে সময় নেই। শুধু যাওয়ার আগে আমাকে আর ওর বাবাকে বলেছিল, তোমরা তোমাদের নাতিটাকে দেখো। আর আমিও বলেছি, তোমরাও বলো, নাদিয়া যেন আবার বিয়ে করে। ওর জীবনটা যেন নষ্ট না হয়ে যায়।

আমি কেন জানি কেউ কাঁদলে কিছু বলতে পারিনা। আজও পারলাম না। সফিয়া কাঁদলো। এই জায়গায় তারা আসতে চেয়েছিল। অদৃষ্টের পরিহাস, এক সাথে আসা হলো না।

আস্তে আস্তে সবাই এলো বাসের কাছে। সফিয়া উঠে দাঁড়ালো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এসো।

ইব্রাহীম ভাই এসে ওর হাতটা ধরল, বলল, যাওনি ভালো করেছ, ভীষণ খাড়া রাস্তা।

সকালে রওয়ানা দিলাম ছধহঃধং অরৎধিুংএ করে মেলবোর্নের পথে। এক ঘণ্টা পয়ত্রিশ মিনিটের ফ্লাইট। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামলাম মেলবোর্নে। ঠান্ডা আর বাতাস। এমনতর হবে আশা করিনি। হোটেল চারটার আগে পাওয়া যাবে না। তাই ডানা ঘুরে ঘুরে দেখালো শহরটা। গবষনড়ঁৎহব ঈৎরপশবঃ এৎড়ঁহফ (গঈএ).

স্কুলে থাকাকালীন, রেডিওতে শুনতাম মেলবোর্নে খেলা হচ্ছে। পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া। হানীফ মোহাম্মদ ব্যাট করছে। আমরা গøুর মতো আটকে থাকতাম রেডিও ঘিরে। আজ এতকাল পরে দেখতে পেলাম সেই জায়গা। সেই ক্রিকেট পিচ। মনে আনন্দ ধরে না।

অস্ট্রেলিয়ায় শেষ দিন। এক সাথে বসে আজ ডিনার করব সবাই। বিদায় দেবো ডানাকে। এতদিন সে ছিল আমাদের সাথে। আমাদের দেখাশোনার ভার ছিল তার ওপর। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।

খাওয়ার টেবিলে সবাই ধরল ওর নিজের কথা বলতে।

কথার শুরুতে বললো, এই ট্যুর যখন বন্ধ থাকে, তখন আমি একটি কলেজে মাস্টারি করি। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে বারে যাই। ড্রিংক করি। তেমনি এক বারে দেখা হয়েছিল অ্যান্থনির সাথে। ও বারটেন্ডার। সেদিন খাওয়ার মাত্রাটা একটু বেশি হয়েছিল। ও আমাকে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেইনি। সে নিজে পৌছে দিয়েছিল আমার বাসায়।

তারপর প্রতিদিন যেতাম ওই বারে। বসতাম, ও গল্প করতো। বৌএর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে পাঁচ বছর হলো।

প্রতি রাতে আমি বসে থাকতাম। ওর ডিউটি শেষ হলে আমরা একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এসে বসতাম কোন বেঞ্চে। ওর কেয়ারিংটা আমাকে আরো ওর কাছে নিয়ে এলো।

এক রাতে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ও দাঁড়িয়ে রইল।

বললাম, কি ব্যাপার বাসায় যাবে না।

-যাবো, বলে সে আমার ঘরের দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, একটা ছোট্ট বাক্স থেকে আংটি বের করে বলল, উইল ইউ মেরি মি?

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলেছিলাম, ইয়েস, আই উইল মেরি ইউ।

আমাদের একমাত্র মেয়ে আমেরিকার ড্যুক ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েট করে ফিরে এসেছে।

এত সুখের মাঝে ওপরওয়ালা একটু যদি কল কাঠি না নাড়ে তবে সুখটা কি তা তুমি বুঝবে কি করে।

তাই তো দুটো ব্রেস্ট ফেলে দিতে হলো। ক্যান্সারের বিষ ওখানে ঘোরাফেরা করছিলো।

বেশ আছি। ছয় মাস পরপর শুধু চেক করতে হয়।

এই আমার কাহিনী।

আমারও তাই মনে হলো শুধু সুখই যদি থাকে জীবন ভর, তবে দুঃখ কি তা বুঝবে কিভাবে।

এয়ারপোর্টে ডানাকে বিদায় দিয়ে আমরা প্লেনে উঠলাম। যাবো নিউজিল্যান্ড।

ঞধংসধহ ংবধ পাড়ি দিয়ে ঈযৎরংঃ ঈযঁৎপযএ প্লেন পাল্টিয়ে আমরা এসে পৌঁছালাম উঁহবফরহ।

কধৎবহ দাঁড়িয়েছিল আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। নিউজিল্যান্ডে সে আমাদের গাইড।

উঁহবফরহএ একদিন কাটিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম ছঁববহংঃড়হিএর দিকে। সকাল তখন নয়টা।

পথে লাঞ্চ করবো ঈষুফব শহরে। ঙষরাবৎং জবংঃধঁৎধহঃএ। চোখটা লেগে এসেছিল। শোয়েব ভাইয়ের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।

-কি হয়েছে?

-দুই চোখ খুলে দেখো চারিদিকে। কি অপূর্ব।

সত্যিই রাস্তার দুই দিকের সৌন্দর্য মুগ্ধ করল আমাকে। আঁকা বাঁকা রাস্তা। কখনো অনেক নিচে নেমে গেছে। কখনো অনেক ওপরে উঠছে। দূরে সবুজ পাহাড়। তার মাঝে হলুদ ফুল। আল্লাহর সৃষ্টি। চোখ ভরে দেখো।

পাঁচ ঘণ্টা পার করে ছঁববহংঃড়হিএ ঢুকলাম। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের সাথে। ছোট্ট নদী বয়ে চলেছে নিচে। আমরা এলাম হোটেল মিলিনিয়ামে।

মনে হচ্ছিল, অনেক দিন বাইরে। ঘরটা আমার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নাতি বলছে আর কতদিন থাকবে দাদা। নাতনী ডাকছে, নানা ফিরে এসো।

আসব, গরষভড়ৎফ ঝড়ঁহফ টা দেখে নেই। যেখানে ঝরছে উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণা। সাদা কালো মেঘগুলো আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। পাথরের ওপর শুয়ে আছে তিনটি বাচ্চা ঝবধ খরড়হ। আমাদের বোটটা কাঁপছে ঢেউএর তালে তালে।

বাচ্চা পেঙ্গুঈন দুটো ঝুপ করে ঝাঁপ দিলো পানিতে।

আমাদের বোট এসে ভিড়ল ঘাটে।

এবার ফেরার পালা। অকল্যান্ড হয়ে ফিরব আমরা যার যার গন্তব্য স্থানে। চঁষষসধহ অঁপশষধহফ ঐড়ঃবষএ ফেয়ারওয়েল ডিনার খেয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিলাম। চৌদ্দটা দিন আমরা কাটিয়েছি একসাথে। শুনেছি অনেকের জীবন কাহিনী। দেখেছি চোখের জল।

শুনেছি বিল তার ছেলেকে দেখে না দশ বছর হলো। দশ বছর হলো সে আসেনি বাবাকে দেখতে। কারণ সে দেখতে চায় না তার সৎমাকে।

সব স্মৃতি গেঁথে নিলাম আমার হৃদয়ে।

প্লেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম নিচের আকাশটাকে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল আমার প্রিয় মুখগুলো।

বলছে যেন, আমার জন্য কি এনেছ দাদা, আমার জন্য কি এনেছ নানা।