বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৭ অপরাহ্ন

কক্সবাজারে সমুদ্র ছোঁয়া বিমানবন্দর

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩

সমুদ্রের বুকে নামবে বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ। উড়ে যাবে একই পথ ধরে। দিবারাত্রি ফ্লাইটের ওঠানামায় কক্সবাজার হবে ব্যস্ততম সিটি। এটি এখন আর কোনো স্বপ্ন  নয়, একদম সত্যি। সমুদ্রছোঁয়া এমনই বিশ্বমানের বিমানবন্দর হচ্ছে এই দেশে। প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে জলভাগের ওপর দিয়ে রানওয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে। চলছে এক্সক্লুসিভ জোনসহ ইকোট্যুরিজম ও রেললাইনের কাজ। কক্সবাজারে সমুদ্রের জলে রানওয়ে নির্মাণের গ্রাউন্ড- ব্রেকিং হয়ে গেল গতকাল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে। সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের আদলে সাজানো হবে কক্সবাজারকে। সমুদ্রের জলে রানওয়ে নির্মাণের গ্রাউন্ড-ব্রেকিংয়ের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চূড়ান্ত রূপরেখা পাচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দর। অভ্যন্তরীণ থেকে রূপ পাবে আন্তর্জাতিকভাবে। জানা গেছে, সমুদ্রের জলরাশি ভেদ করে রানওয়ে নির্মাণশৈলী এ অঞ্চলে এটিই প্রথম। গোটা বিশ্বে হাতেগোনা এ ধরনের রানওয়ে রয়েছে। মালদ্বীপ, কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের রানওয়ের চেয়েও দীর্ঘ হবে কক্সবাজারের এই প্রকল্পটি।

পৃথিবীর উপকূলীয় শহরে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে এই বিমানবন্দর। কক্সবাজারের এই বিমানবন্দর হবে দেশের দীর্ঘ রানওয়ে। সমুদ্রের ভিতরেই থাকবে ১৩০০ ফুট। সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি ভেদ করে কক্সবাজারে অবতরণ করবে এ-৩৮০-এর মতো বিশালাকৃতির উড়োজাহাজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলেই বিমানবন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এই বিমানবন্দরকে রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সমুদ্রের ভিতরে ব্লক তৈরি করেই তৈরি হবে রানওয়ে। পাশাপাশি রানওয়ের আশপাশে ছোট ছোট কটেজও রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। এমনকি রি-ফুয়েলিং স্টেশনও করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেখানে। তাছাড়া বিমানবন্দরের আশপাশেই উন্নতমানের হোটেল-মোটেলও  তৈরি করা হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, এই বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটন নগরী হিসেবে মাস্টার প্ল্যানে নেওয়া হচ্ছে নৈসর্গিক সব স্থাপনা। অত্যাধুনিক স্থাপত্যরীতিতে এখানে তৈরি করা হবে কেবল-কার, সি মিউজিয়াম, ব্লু জোন, রেড পার্ক, পারাসুটিং হাই পার্ক ও অন্য সব স্থাপনা। বিনোদনের জন্য থাকবে বিশ্বমানের শীর্ষ ইভেন্ট। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সবই স্টাডি করছি। তিনি বলেন, মূলত দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যাতে সরাসরি ফ্লাইটে আসতে পারেন সেজন্যই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও শক্তি বৃদ্ধি, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী ৩৩ মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান জানান, মূলত প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হয়। ইতিমধ্যে রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬৭৭৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুট এবং প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে ২০০ ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৭ সালে সম্প্রসারিত রানওয়েতে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সময়ই এই বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফুট থেকে ১২ হাজার ফুটে উন্নীতকরণের নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফুট থেকে ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত হবে। এ ছাড়া প্রিসিশন এপ্রোচ ক্যাট-১ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। ফলে উড়োজাহাজ পূর্ণ লোডে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। যার কারণে বিমানবন্দরের ফ্লাইট সংখ্যার পাশাপাশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নয় হাজার ফুট দীর্ঘ একটি রানওয়ে রয়েছে। এটি ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত করার কাজ শুরু হলো।

এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ ফুট থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের মহেশখালী চ্যানেলের দিকে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হচ্ছে এই রানওয়ে। প্রকল্পটি এত অগ্রাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বারবার হোঁচট খেয়েছে। দরপত্র প্রতিযোগিতায় একটি গোষ্ঠী নানাভাবে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া ছিল। এদের কারণে প্রথম দফায় দরপত্রটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এতে বাধ্য হয়েই পুনঃদরপত্রের আহ্বান করা হয়। গত ২৯ ডিসেম্বর সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে ঠিকাদার কোম্পানি হিসেবে অনুমোদন পায় চায়না সিভিল ই্িঞ্জনিয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি)। বেবিচক সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠা-নামা করতে পারবে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করবে বেবিচক। বর্তমান করোনা মহামারীতেও চলছে এখানে কর্মযজ্ঞ। মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপের পাশেই সমুদ্রে বালি ভরাটের কাজ চলছে। বিমানবন্দরের ভিতরে টার্মিনাল ভবনটির কাজও দ্রুতগতিতে শেষ হচ্ছে। টার্মিনাল ভবনের অবকাঠামো ও ঢালাইয়ের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। শিগগিরই শুরু হবে ফিনিশিংয়ের কাজ।

চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি বেবিচক সদর দফতরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন জেভির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেবিচক অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে অন্তত ২১ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করে প্রতিষ্ঠান দুটি। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হয়। নির্মাণকাজের অনুমতি পাওয়া চীনের ওই দুই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ‘বেইজিং বিমানবন্দর’ নির্মাণের মতো অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতা। এই বিমানবন্দরেও থাকবে সব ধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া, যা দেখে প্রাণ জুড়াবে বিশ্বের সব পর্যটনপ্রেমীর।

বেবিচকের কর্মকর্তারা বলছেন, রানওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হলে যখন বিমান অবতরণ বা উড্ডয়ন করবে তখন বিমানের দুই পাশেই থাকবে সাগরের জলরাশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর কক্সবাজার হবে চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ১০ হাজার ৫০০ ফুট। কক্সবাজারের কাজ শেষ হলে ঢাকা হয়ে যাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম রানওয়ে। সমুদ্রে যতটুকু রানওয়ে যাবে সেখানে পানিতে ব্লক, জিওটিউবসহ অন্য সামগ্রী ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হবে। কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমে আমরা চেয়েছিলাম রানওয়েটি শহরের দিকে সম্প্রাসারণ করা যায় কি না। তাছাড়া শহরের দিকে করলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা বিমানবন্দরের দিকে চলে আসবে।

অনেকেই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। তবে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন সাগরের দিকে রানওয়ে থাকলে সেটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। আমরা তাতে সম্মতি জানাই। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মহেশখালী চ্যানেলের দিকেই রানওয়েটি হবে। বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল ভবনের কাজও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বসানো হচ্ছে গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম, সেন্ট্রাল লাইন লাইট, সমুদ্রের ভিতর ৯০০ মিটার পর্যন্ত প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইটিং, ইন্সট্রুমেন্টাল ল্যান্ডিং সিস্টেম, নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ ও বাঁশখালী নদীর ওপর সংযোগ সেতু। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রূপ পাওয়ার পর এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার পর ফ্লাইট ওঠানামা করবে কক্সবাজারে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com