মরুভূমির দেশ হলেও ওমান অবিশ্বাস্য সবুজ। কিছু কিছু জায়গায় গেলে তো মনেই হবে না মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আছেন, নাকি ট্রপিক্যাল কোনো অঞ্চলে। বিষয়টি সম্ভব হয়েছে ওমানের ঐতিহ্যবাহী ফালাজ প্রযুক্তির কারণে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চাষাবাদ করে আসছে ওমানিরা। এই ইউনিক ও ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তিকে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ফালাজ হচ্ছে ক্যানাল পদ্ধতি। এর সঙ্গে আমাদের দেশের শ্যালো মেশিন থেকে নালার মাধ্যমে ধানখেতে পানি দেওয়ার মিল আছে। তবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করে কয়েক কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি ফালাজের শুরুতে একটি কুয়া থাকে। সেটিকে বলা হয় উম্মুল ফালাজ, অর্থাৎ ফালাজের মা। সেটিই হচ্ছে পানির প্রধান উৎস।
ওমানের অর্থনীতি শুধু তেলের ওপর নির্ভরশীল না করার জন্য ওমানি সালতানাত অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কৃষি। আশির দশকের শুরুর দিকে ওমান ব্যাংক অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফিশারিজ চালু হয় কৃষক ও জেলেদের উন্নত এবং আরও কার্যকর করার জন্য। সে সময় ওমানিরা তাদের ফালাজ প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেছে এবং বড় বড় ফিশিং কোম্পানি খুলেছে। বর্তমানে ওমানে সবজি থেকে শুরু করে অনেক ধরনের ফুল ও ফলের চাষ হয়। ২০২৩ সালে ওমানের কোষাগারে ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ইউএস ডলার যোগ হয়েছিল কৃষি ও মৎস্য থেকে। ২০২৮ সালের মধ্যে তাদের টার্গেট এ খাতের অর্জনকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নিয়ে যাওয়া।
পুরো ওমানে একদিকে রয়েছে পাহাড়, আরেক দিকে সমুদ্র। পাহাড়ের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত দুটি হলো জাবাল শামস ও জাবাল আখদার। দুটিই তিন হাজার মিটারের বেশি উঁচু। এ দুটি পাহাড় দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। জাবাল শামসের ওপরে দারুণ এক রিসোর্টে এক রাত ছিলাম। কিন্তু জাবাল আখদারও যে ঘুরতে পারব, সে আশা ছিল না।
জাবাল শামসে নিজের গাড়ি চালিয়ে যেতে পারলেও জাবাল আখদারে সেটি সম্ভব ছিল না। জাবাল আখদারের প্রবেশপথে একটি পুলিশ স্টেশন রয়েছে। তারা প্রতিটি গাড়ি চেক করে। জাবাল আখদারে উঠতে হলে ফোর হুইলার গাড়ি থাকতে হবে। আমার সে রকম গাড়ি ছিল না বলে ধরেই নিয়েছিলাম, জাবাল আখদারে যাওয়া হবে না এযাত্রায়।
কিন্তু কথায় আছে না, কপালে থাকলে ঠেকায় কে!
ওমানের পুরোনো রাজধানী ও ঐতিহাসিক শহর নিজওয়া ভ্রমণের শেষ দিন সকালে ঘুরতে গিয়েছিলাম বির্কাত আল মুজ নামে একটি পুরোনো পরিত্যক্ত গ্রামে। ওই গ্রামের পাশের একটি দুর্গ দেখতে গাড়ি থামালে এক স্থানীয় ওমানি পেছন থেকে ডাক দিলেন। এগিয়ে গেলে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছি? দুর্গ দেখব বলার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকটি জানতে চাইলেন, আমি জাবাল আখদার দেখতে যাব কি না। জানালেন, তাঁর সঙ্গে ফোর হুইলার গাড়ি আছে। আমার প্রধান সমস্যা ছিল সময়। হোটেল থেকে ১২টার মধ্যে চেক আউট করতে হবে। আর তখন বাজে প্রায় ১১টা। জানা গেল, এখান থেকে জাবাল আখদার যাতায়াতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সিদ্ধান্ত নিলাম, পাহাড়টা দেখেই আসি। আবার কবে আসতে পারব, তার কোনো ঠিক নেই। লোকটির সঙ্গে দরদাম করে ২৫ রিয়ালে রাজি করিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
এই গরমের মধ্যেও পাহাড়ের ওপর পরিবেশ ছিল শীতল। কিছুক্ষণ পাহাড়ে ওঠার পর ড্রাইভার গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলেন। ওমানে দিনের বেলা এত গরম থাকে যে গাড়ির জানালা খুলে রাখার উপায় নেই। ওমান যাওয়ার পর এই প্রথম কাউকে গাড়ির জানালা খুলে ড্রাইভ করতে দেখছি। পাহাড়ের ওপরে তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক। ড্রাইভার জানালেন, শীতে সেখানে নাকি তাপমাত্রা শূন্যের নিচে চলে যায় এবং তুষারপাত হয়।
পাহাড়ের ওপর গ্রামটির নাম আল আইন। উঁচু থেকে একটু একটু করে নিচে নেমেছে এবং পুরো গ্রামজুড়ে হচ্ছে চাষবাস। দেখে মনে হচ্ছিল যেন ভিয়েতনামের পাহাড়ি ধানখেত দেখছি। এসব খেতের মাঝে কিছুক্ষণ পর পর ফালাজের পুল দেখা যাচ্ছে। সেগুলোয় নেমে গোসল করা যায়। পরিবেশ চমৎকার।
জাবাল আখদার পাহাড়টি ভ্রমণের সেরা সময় হচ্ছে মার্চ-এপ্রিল মাস। তখন এই খেতগুলোয় বিভিন্ন ফুল ও ফলের মৌসুম থাকে। পৃথিবীতে ওমানি গোলাপ বেশ পরিচিত। তার চাষ হয় এখানে। তা ছাড়া প্রচুর পরিমাণে আনার চাষের জন্যও পরিচিত জাবাল আখদার পাহাড়ের গ্রামগুলো।
সময় কম থাকায় ফিরতে হলো দ্রুত। ভাবলাম ভবিষ্যতে এলে অবশ্যই হাতে বেশি সময় নিয়ে আসতে হবে।