করোনাপরবর্তী সময় থেকেই টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও ইউটিউব কনটেন্ট হারাতে শুরু করে দর্শক। টেলিভিশন থেকে দর্শকের এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। এই সুযোগে দর্শকের রুচির সিংহভাগ দখল করে নেয় ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মগুলো। কারণ দর্শক টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে বলেন, টিভি কেন দেখব? কী আছে দেখার? পর্ব বাড়ানো ছাড়া ধারাবাহিক নাটক গল্পে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে কি? এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলের আয়োজনে কি কোনো তফাত খুঁজে পাওয়া যায়?
প্রতি ঈদে টিভি আর ইউটিউব মিলে দর্শকের জন্য নিয়ে আসে কয়েক হাজার নাটক। সেখানে থাকে সব পরিচিত মুখ। কিন্তু এবার ঈদে অনেক মুখই ছিলেন না নাটকে। তবে ওটিটি কনটেন্টগুলো করেছে বাজিমাত। আলো কেড়ে নিয়েছে টেলিভিশন ও ইউটিউবের। এই ঈদে আলোচিত সব কাজই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর। আশফাক নিপুণ পরিচালিত ‘মহানগর’ ২০২১ সালে মুক্তি পায়। ঢাকা শহরের এক ক্ষমতাবানের দাপট ও তাকে অপরাধের শাস্তি দিতে চাওয়া পুলিশ অফিসারের গল্প এটি। ওসি হারুনের চরিত্রে ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। চরিত্রটি দর্শক মহলে এত জনপ্রিয় হয়, যা হয়তো কেউই শুরুতে ভাবেননি। ঈদ উপলক্ষে ২০ এপ্রিল হইচইয়ে মুক্তি পায় সিরিজটির নতুন পর্ব। আর মুক্তির পরই এটি ফেলে দেয় হইচই। আলোচনায় আছেন অ্যালেন স্বপন। চরকি ও শিহাব শাহীন উপহার দিয়েছেন ভিন্নধর্মী চরিত্র।
গত বছর ঈদুল আজহায় চরকিতে মুক্তি পেয়েছিল শিহাব শাহীনের ‘সিন্ডিকেট’। সিরিজটির অন্যতম চরিত্র অ্যালেন স্বপন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা, পূর্বসূত্রে রহস্যের সম্ভাবনা চরিত্রটিকে জনপ্রিয় করেছিল। এর পাশাপাশি অ্যালেন স্বপন চরিত্রে নাসির উদ্দিন খানের অভিনয় দর্শকের ভালো লেগেছিল। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য মিম। সে অ্যালেন স্বপনের গল্প নিয়ে শিহাব শাহীন নিয়ে এসেছেন ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। চরকিতেই স্ট্রিম হয় সিরিজটি। এবার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রাফিয়াথ রশীদ মিথিলা। ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছে বিঞ্জের ওয়েব ফিল্ম ‘কুহেলিকা’। নির্মাতা সামিউর রহমানের প্রথম ওয়েব ফিল্ম এটি। অভিনয়ে ছিলেন শাফায়েত মনসুর রানা, নাজিয়া হক অর্ষা, সাফা কবির, ইয়াশ রোহান, আবু হুরায়রা তানভীর ও শরীফ সিরাজ। বর্তমান সময়ের মানুষের সম্পর্ক, সমস্যা, উচ্চাকাক্সক্ষার বিষয়গুলো উঠে এসেছে সিনেমার গল্পে। ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার ফিল্মটি স্ট্রিম শুরু হওয়ার পর থেকেই দর্শকের মনোযোগ পেয়েছে। গল্পে একটা টেনশন ছিল, যা দর্শককে পুরোটা সময় ধরে রেখেছে।
ওয়েব ফিল্মের মতোই এবার ওটিটিতে ছিল ফ্ল্যাশ ফিকশন। দীপ্ত প্লেতে ছিল ‘শহরে অনেক রোদ’। এটি নির্মাণ করেছেন মিজানুর রহমান আরিয়ান। প্রধান চরিত্রে দেখা গেছে খায়রুল বাসার ও সাবিলা নূরকে। ছিলেন তানিয়া আহমেদ ও নাদের চৌধুরী। ওটিটির অন্যতম আকর্ষণের জায়গা অরিজিনাল সিরিজ। বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো সিরিজ আনতে পারছে না সেভাবে। তবে এ ঈদে সিরিজ ছিল। এর মধ্যে বঙ্গ এনেছে ‘হোটেল রিল্যাক্স’। কাজল আরেফিন অমি পরিচালিত এ সিরিজে অভিনয় করেছেন পূর্ণিমা। তাকে বাংলাদেশ পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের একজন অফিসার হিসেবে দেখা গেছে। মুক্তির আগেই সিরিজটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহের বেশ কিছু জায়গা ছিল। প্রথমত এ সিরিজ পরিচালনা করেছেন ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’খ্যাত নির্মাতা কাজল আরেফিন অমি। নতুন কী আনছেন তিনি, তা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে পূর্ণিমা হয়েছেন এ সিরিজের এক্স ফ্যাক্টর। সঙ্গে জিয়াউল হক পলাশ, মিশু সাব্বির, মারজুক রাসেল, শিমুল শর্মারা তো ছিলেনই।
টেলিভিশন যখন এবার দর্শক হারিয়েছে, বিপরীতে ওটিটির সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে। যদিও ওটিটির দর্শক একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির, টিভি দর্শকের সঙ্গে তাদের মেলানো ঠিক হবে না বলেই মনে করেন সবাই। তাদের মতে, মঞ্চে নাটক হতো। এরপর সিনেমা এলো, টিভি এলো, দর্শক বিনোদনের নতুন মাধ্যম খুঁজে পেল। একইভাবে এখন দর্শক ওটিটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আবার কোন মাধ্যম কতটা জনপ্রিয়Ñ তা নিয়ে তর্কবিতর্ক হতেই পারে। তবে এটা বাস্তব যে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দর্শকসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর ঈদে তো এই মাধ্যমের কাছে রীতিমতো ধরাশায়ী ছিল টেলিভিশন-ইউটিউব! নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই, আড্ডা টাইমস, জি ফাইভের পথ ধরে দেশেও আলাদা করে চরকি, দীপ্ত প্লে, সিনেমাটিক, বঙ্গ, বিঞ্জসহ আরও কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এর চেয়ে বড় বিষয়Ñ গত তিন বছরে টিভি নাটকগুলো নিয়ে যতটা আলোচনা শোনা গেছে, এর চেয়ে বেশি প্রশংসা শোনা গেছে ওটিটির কন্টেন্টগুলো নিয়ে। ‘মহানগর’, ‘তাকদীর’, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, ‘সাবরিনা’, ‘বলি’, ‘কারাগার’, ‘শাটিকাপ’, ‘ষ’, ‘আগস্ট ১৪’, ‘ঊনলৌকিক’, ‘সিন্ডিকেট’সহ আরও বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ ও ফিল্ম স্বল্প সময়ের মধ্যে দর্শক মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
সূত্র : আমাদের সময়