অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ল্যাকেম্বা এলাকায় পবিত্র রমজান এলেই যেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে; যা শুধু ইফতারের জন্যই নয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, উৎসবমুখর পরিবেশ এবং রাতের বাজারের জন্যও বিখ্যাত।
‘রামাদান নাইটস ল্যাকেম্বা’র এ বছরের আয়োজনও হয়েছে জমজমাট। ল্যাকেম্বার হ্যালডন স্ট্রিটে প্রতি বৃহস্পতি থেকে রোববার পর্যন্ত চলছে এই উৎসব। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ আয়োজনে হাজারো মানুষ একত্র হচ্ছেন রমজানের পবিত্রতা ও উষ্ণতা উপভোগ করতে।
এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হলো রকমারি ইফতারি, যার মধ্যে কুনাফা, ক্যামেল বার্গার এবং বাঙালি ঐতিহ্যবাহী খাবার বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ল্যাকেম্বা এলাকাটি সিডনির মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রতিবছর রামাদান নাইটসের আয়োজন করা হয়। এবার এই আয়োজন চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত।
ল্যাকেম্বায় রামাদান নাইটসের আয়োজক ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের মেয়র বিলাল এল-হায়েক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রমজানের এই পবিত্র মাসে রামাদান নাইটস ল্যাকেম্বা যেন হয়ে উঠেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি আত্মিক ও সামাজিক বন্ধনের মাধ্যম। এখানে ১৬ লাখ মানুষের সমাগম হয়। বাণিজ্য হয় প্রায় চার শ কোটি টাকার।
ল্যাকেম্বার রামাদান নাইটসে বাঙালি ইফতারির বিশেষ স্থান রয়েছে। এখানে পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি এবং হালিমের মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর শেফ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি বাংলাদেশের স্বাদ এখানে ধরে রাখতে। পেঁয়াজু, বেগুনি আর জিলাপি আমাদের ইফতারের টেবিলকে পূর্ণতা দেয়।’
কুনাফা মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। এটি তৈরি হয় বিশেষ ধরনের নুডলস বা কদমা, পনির, চিনির সিরাপ ও বাদাম দিয়ে। কুনাফা তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে। স্থানীয় রেস্তোরাঁর শেফ আহমেদ হোসেন বলেন, ‘কুনাফা তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চিনির সিরাপ। এটা ঠিকমতো তৈরি না হলে কুনাফার স্বাদ পূর্ণতা পায় না। আমরা এখানে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে কুনাফা তৈরি করি, যাতে সবাই আসল স্বাদ পেতে পারেন।’
ক্যামেল বার্গার হলো আরেকটি জনপ্রিয় ইফতার আইটেম, যা বিশেষ করে মাংসপ্রেমীদের জন্য তৈরি করা হয়। এটি তৈরি হয় উটের মাংস দিয়ে, যা মধ্যপ্রাচ্যের একটি জনপ্রিয় খাবার। এখানে ক্যামেল বার্গার তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ হালাল পদ্ধতিতে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘ক্যামেল বার্গার শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষই নয়, অন্যান্য দেশের মানুষের কাছেও জনপ্রিয়। আমরা এখানে প্রতিদিন প্রচুর ক্যামেল বার্গার বিক্রি করি।’
এই উৎসবে অন্যান্য খাবারের মধ্যে রয়েছে তেহারি, বিরিয়ানি, রকমারি কাবাব, হালিম, ফুচকা, আরবি চা, কফি, জিলাপি, মিষ্টি, পিঠা ও ফলের রস, আখের রস, আলুর বিশেষ ধরনের চিপস।
রামাদান নাইটস ল্যাকেম্বা শুধু খাবারের জন্যই নয়, বরং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্যও বিখ্যাত। স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখানে আমরা শুধু খাবারই বিক্রি করি না, বরং আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও তুলে ধরি।’ ল্যাকেম্বার রাতের বাজারটি হয়ে ওঠে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে নানা রকম পণ্য বিক্রি হয়, যার মধ্যে পোশাক, গয়না, হস্তশিল্প এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক আইটেম বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
প্রবাসী বাংলাদেশি ওয়েলি পার্কের বাসিন্দা মাসুমা খান বলেন, ‘আমি প্রতিবছর প্রায়ই এখানে আসি। এখানকার রকমারি বাঙালি ইফতারি খেতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। এগুলো শুধু খাবার নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই একটি জায়গা যেখানে এলে মনেই হয় না আমি বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আছি।’
লেবাননের অধিবাসী লায়লা আহমেদ। থাকেন এখানকার ব্যাংকসটাউনে। তিনি বললেন, ‘আমি লেবাননে বড় হয়েছি, যেখানে কুনাফা আমাদের রমজানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে কুনাফা পেয়ে আমি খুবই খুশি।’
পাকিস্তানের সৈয়দ কায়েম রেজা তাঁর স্ত্রী আমরীন বিবি এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে এসেছিলেন ইফতার করতে ল্যাকেম্বায়। তিনি বলেন, ‘কুনাফা এবং ক্যামেল বার্গার আমার সবচেয়ে প্রিয়। এখানে এগুলো তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে। ফলে খাবারের একদম খাঁটি স্বাদটা পাওয়া যায়।’
কায়েম রেজা আরও যোগ করেন, বাংলাদেশের হালিম-পেঁয়াজুও আমার খুব প্রিয়, বিশেষ করে আমার বিবি ওগুলোই খাওয়ার জন্য এখানে আসে।’