সাবিনা ইয়াসমীন একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি একাধারে উদ্যোক্তা, সম্পাদক, কবি ও সমাজকর্মী। স্ব উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান প্রচিত আইএমসি লিমিটেড থেকে ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে প্রচিত আইটিএস, প্রচিত হলিডেজ এবং রোদসীতে। এখন তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রচিত আইটিএস-এর বাই প্রডাক্ট আমুজামু নিয়ে। এটি একটি ইন্টারন্যাশনাল টুরিজম প্লাটফর্ম।
সাবিনা ইয়াসমীনের জন্ম পাহারঘেড়া শহর চট্টগ্রামে। এরপর শৈশব-কৈশর কেটেছে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। এখন, ‘গ্রামের বাড়ি’ বলতে কুমিল্লাকেই বোঝেন। তবে পাহাড়ের স্মৃতি এখনো তাকে টানে। প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে যেতে চান সেখানে। শিক্ষা জীবনে পেয়েছেন বেশ কয়েকজন গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্য। এর মধ্যে আছেন কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ।
সফলতার পথে যেতে যেতে
সাবিনা ইয়াসমীনের ইচ্ছে ছিলো কপিরাইটার হবার। সেই বাসনা থেকেই বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থায় একটু-আধটু ঘোরাঘুরি। এরপর পড়াশোনার পাঠ চুকাতে না চুকাতে নিজেই খুলে বসলেন প্রচিত আইএমসি নামের একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে দীর্ঘ ১৯ বছর যাবত সফলতার সাথে করছেন বিজ্ঞাপনা সংস্থার ব্যবসা। এরই মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি নিয়েছেন।
বিয়ে এবং প্রথম সন্তানের মা হয়েছেন এরই মধ্যে। ব্যবসার শুরুটা শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটা ছোট্ট রুম থেকে। এরপর সেই ছোট্ট উদ্যোগ এখন মহিরুহ আকার নিয়েছে। এখন তার প্রতিষ্ঠানেই কাজ করছেন শ’খানেক স্বপ্নবান মানুষ। শুধু দেশে নয়, অফিস খুলে বসেছেন দেশের বাইরে সুদূরের দেশ থাইল্যান্ডে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের আরো বেশ কয়েকটি দেশে তার অফিস স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
সাবিনা ইয়াসমিন মনে করেন, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসই পারে সফলতার চূড়ায় পৌঁছে দিতে। কোন কিছু করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয় তাহলে সেই কাজে হাত দিতে হবে। বোঝাপড়াটা সবার আগে নিজের সাথে হতে হবে। নিজের জন্য সময় বের করতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। নিজেকে না ভালোবাসলে পৃথিবীর কোন কিছুই ভালোবাসা সম্ভব নয়। নিজের উন্নয়ন করতে না পারলে অন্য কোন কিছুর উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
সাবিনা ইয়াসমীন
সাবিনা ইয়াসমীনের অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রচিত আইএমসি লিমিটেড বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থার জগতে একটি পরিচিত নাম। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি সুদীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ সাফল্যের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি প্রেস অ্যাড এবং বুকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে এটিকে ৩৬০* ইন্ট্রিগেটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব কটি জাতীয় এবং আঞ্চলিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেডিও এবং টেলিভিশনের সাথে করার অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এবং এখনো সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি করছে বিভিন্ন কোম্পানির ইভেন্টের কাজ। এ প্রতিষ্ঠানটির ক্লাইন্টের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বেশ কিছু নামি দামি ব্রান্ড এবং গ্রুপ অব কোম্পানিজ।
সাবিনা ইয়াসমীন সম্পাদনা করছেন নারী প্রাধান্য পারিবারিক ম্যাগাজিন ‘রোদসী’। নারী জীবনের সমস্যা-সম্ভাবনা এবং সাফল্যগাথা তুলে আনাই এ পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য। মোটকথা, নারী জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গের পূর্ণতার ছবি এঁকে দেবার প্রত্যয় নিয়ে রোদসীর যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১৩ সালের জুন মাসে। পত্রিকাটি তার অগ্রযাত্রার চার বছরে পা দিয়েছে।
ভ্রমণ পিপাসু মানুষজন এই প্লাটফর্ম থেকে তাদের পছন্দের ট্যুর কিনতে পারবেন। আবার টুরিজম ব্যবসায়ীরা তাদের সুবিধামত ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করতে পারবেন এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে। বলা যায়, এটি ট্যুর বিজনেসের একটি ডিজিটাল সংস্করণ। বাংলাদেশে এ ধারণাটি একেবারেই নতুন। এমনকি সারা বিশ্বেও এমন প্লাটফর্ম খুব একটা নেই। বিশ্বব্যাপী এটির বিস্তার থাকবে।
গত দুই বছর ধরে প্রজেক্টটি চলমান আছে এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে ইতোমধ্যে সফটওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে। এখন চলছে এটির ডেভলপমেন্ট প্রসেস। অচিরেই খুব আড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সফটওয়ারটির শুভযাত্রা হবে। এটির মূল অফিস থাইল্যান্ডে। সেখানে সাবিনা ইয়াসমীনের ছেলে, বিন্দু জামাল এটির তত্ত্বাবধানে আছেন। বাংলাদেশেও আমুজামুর একটি অফিস রয়েছে। সাবিনা ইয়াসমীন আমুজামু’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করে আসছেন।
অন্য অনন্য পরিচয়ের সাবিনা ইয়াসমিন: মা হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিন
দুই সন্তানের মা সাবিনা ইয়াসমীন মনে করেন, মা হওয়ার মধ্যে নারী জীবনের সবচেয়ে বড় স্বার্র্থকতা। তাই তার দুই সন্তানকেই জীবনের পরম পাওয়া মনে করেন তিনি। তার বড় সন্তান বিন্দু জামাল পেশায় একজন আইটি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে যুক্ত আছেন আমুজামু.কম এর সাথে। করছেন সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট। ছোটবেলা থেকেই থাইল্যান্ডে বড় হওয়া বিন্দু জামাল পড়াশোনা করেছেন থাইল্যান্ডের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট মেয়ে দোলন বিনতি বনানী বিদ্যানিকেতনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
খুব অল্প বয়সে, মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয় সাবিনা ইয়াসমীনের। জীবনের এতোটা পথ যার সাথে সংসারের সুখ-দু:খ ভাগ করেছেন তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। বিয়ের পরও লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। এসএসসি পাশ করে বিয়ে হওয়া সাবিনা ইয়াসমীন নিয়েছেন স্নাতোকত্তোর ডিগ্রি। এরই মধ্যে প্রথম সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। তবে দমে যাননি। সব সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে শেষ করেছেন লেখাপড়া।
শিল্পানুরাগী সাবিনা ইয়াসমিন
শিল্পকে, সংস্কৃতিকে তিনি ভালোবাসেন। লালন করেন আপন মনে। শুধু তাই নয় সাবিনা ইয়াসমীন একজন কবি মানুষ। মনের কথাকে ছন্দে ছন্দে গেথে, ভাবকে ভাষায় প্রকাশ করেন। লেখার ক্ষেত্রে তিনি ‘কাজী সাবিনা শ্রাবন্তী’-এই নামটিকেই বেছে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতার বই। ২০১৬ সালের বই মেলায় পাঠক সমাবেশ থেকে ‘একগুচ্ছ অনুভূতি’ নামে বইটি প্রকাশ পায়।
বইটি প্রকাশের পরপরই সুধীজনের নজর কারতে সক্ষম হয়েছে। আরো একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে রেখেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি লিখছেন ছোটগল্প, ভ্রমণ এবং শিশুসাহিত্য। আগামী বই মেলায় তার অন্তত একটি ছোটগল্প, একটি ভ্রমণ এবং একটি কবিতার বই প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। শিল্পের সাথে এই সংসার তিনি গেঁথে যেতে চান আজীবন।
সমাজকর্মী হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিন
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সাবিনা ইয়াসমীন যুক্ত আছেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে। ছাত্র থাকাবস্থায় সম্পাদনা করেছেন ‘আমরা বাউল’ নামে একটি লিটলম্যাগ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন সেসময়। এখনো মানব সেবাকে নিজের নৈতিক দায় মনে করে কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্নভাবে।
সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছেন অনলাইন হ্যারাসমেন্ট নিয়ে কাজ করার। অনলাইনে নারীদের হ্যারাসমেন্টের বিভিন্ন ঘটনা তাকে পীড়িত করেছে। তাই চান সমাজের নারীদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলবেন। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন এসব ঘটনার বিরুদ্ধে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সেমিনার করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কথা ভাবছেন তিনি।
তার বিশ্বাস, সবাই সচেতন হলে অনলাইন হ্যারাসমেন্ট শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। শুধু তাই নয়, নারীকে প্রযুক্তিগতভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণের কথাও ভাবছেন তিনি। সাবিনা ইয়াসমীন যুক্ত আছেন সমাজ উন্নয়নে নিয়োজিত সংগঠন ‘লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘে’র সাথে।
সবুজ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রচুর বৃক্ষরোপন করেছেন। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারীশিক্ষাসহ সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সংগঠনটির জোড়ালো ভূমিকা রয়েছে। সাবিনা ইয়াসমীন এ সামাজিক সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
তথ্যসূত্র: মানব কন্ঠ