আমি আর নাজমুল হোসেন মাতুব্বর কলেজে পড়তাম। আর মইন মাতুব্বর পড়ত ক্লাস টেনে। আমরা তিনজন একসঙ্গেই চলাফেরা করতাম। এই চলতে চলতেই জীবনের নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো। কথা হতো ক্যারিয়ার নিয়েও। আমরা তিনজনই সচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান। তবে ইউরোপের জীবন আমাদের টানত। পড়াশোনা করে দেশে চাকরি–বাকরি খোঁজার চেয়ে বিদেশে গিয়ে জীবনের মোড় ঘোরানোর দিকেই আমাদের টান ছিল বেশি।
আমাদের এসব ভাবনার কথা এলাকার ইলিয়াস মাতুব্বর জানতে পেরেছিলেন। এলাকায় বিদেশে লোক পাঠানোর দালাল হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। তিনি আবার মইনের বাবার মামাতো ভাই। তাঁর সহযোগী ছিলেন শাহীন মাতুব্বর। ইলিয়াস মাতুব্বর মইনের আত্মীয় হওয়ায় বাড়িতে বোঝানোটা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল। এরপর আমার আর হোসেনের বাড়িতেও তাঁর আনাগোনা বেড়ে যায়। লিবিয়া হয়ে বড় নৌকায় সম্পূর্ণ নিরাপদে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। একসময় পারিবারিকভাবেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই তাঁর মাধ্যমেই ইতালি যাব। বাড়ির পাট ও পেঁয়াজ বিক্রি করে, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে আমরা প্রত্যেকে ১০ লাখ করে টাকা দিই।
২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর ফরিদপুর থেকে ঢাকায় যাই আমরা। সঙ্গে আমাদের বাবারাও যান। দালালদের ঠিক করা একটি মেসে গিয়ে উঠি। ১৬ নভেম্বর ওমান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজে ওমানের মাসকাটের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ি। ১৭ নভেম্বর মাসকাটে কয়েক ঘণ্টা থাকার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় দুবাই।
এই শহরে দালালদের জিম্মায় আমাদের দিন কাটতে থাকে। দিন চলে যায় কিন্তু আমাদের নিয়ে যাওয়ার নাম আর তারা করে না। এই নিয়ে এক দালালের সঙ্গে রাগারাগি পর্যন্ত করি। সে–ও আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। ১৯ দিনের মাথায় দেখি আমাকে বাদ দিয়েই হোসেন ও মইনকে লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। আমি হতাশ হয়ে পড়ি। একসঙ্গে এসেছি, একসঙ্গে যাব, তাহলে আমাকে কেন নিচ্ছে না। কান্নাকাটি করি। বুঝতে পারি, রাগারাগির কারণে ইচ্ছা করেই আমাকে দেরি করানো হচ্ছে। তবে বেশি দিন একা থাকতে হয়নি। চার দিন পর লিবিয়ায় পৌঁছে দুই বন্ধুকে পেয়ে যাই।
লিবিয়ার ত্রিপোলি শহরে তারিক মাতার নামের মহল্লায় একটি ক্যাম্পে আমাদের রাখা হয়। দুই দিন পর সেখান থেকে রাসেল নামের এক দালালের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলখানার মতো একটা জায়গা। একটি ঘর আর একটি টয়লেট। বের হওয়ার উপায় নেই। আমাদের যাতায়াত বলতে ঘর থেকে টয়লেট আর টয়লেট থেকে ঘর। সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখতে পেতাম না। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। এভাবে ২০২২ পার হয়ে যায়।
২৭ জানুয়ারি বন্দিশালা থেকে আমাদের সাগরপাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখি ছোট আকারের একটি স্পিডবোটে গাদাগাদি করে মানুষ তোলা হচ্ছে। কথা বলে বুঝলাম সবাই বাংলাদেশি। ওই স্পিডবোটে আমরা উঠতে চাইনি। কিন্তু দালাল চক্র বোটে উঠতে বাধ্য করে। লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার কথা ছিল, সেটাও দেওয়া হয়নি।
স্পিডবোট চলতে শুরু করার পর কেন যেন মন খারাপ ভাবটা কমে যেতে থাকে। লিবিয়ার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার অল্প পরই গাঢ় অন্ধকারে ঢুবে যায় ভূমধ্যসাগর। এর মধ্যেই চলতে থাকে স্পিডবোট। শুরুতে সাগর ছিল শান্ত। বাতাসও তেমন ছিল না। বোটও চলছিলও ভালো।
আমরা তিন বন্ধু পাশাপাশি গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা। পাশে বিভিন্ন জেলার মানুষ। রাতে যেন ঘুমিয়ে না পড়ি, তাই নিজেরা আলাপ করতে থাকি।
ভোর চারটার দিকে বোট মাল্টার জলসীমা অতিক্রম করছিল। এভাবে আরও কয়েক ঘণ্টা চলতে পারলেই ইতালিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু এমন সময় শুরু হয় বাতাস। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার তোড়ে বোটটি উল্টে যায়। আমরা অথই সাগরে পড়ে যাই। বোট যাঁরা ধরতে পেরেছিলেন, তাঁরা ভেসেছিলেন। আর যাঁরা ছিটকে পড়েন, ঢেউয়ের তোড়ে অনেক দূরে ভেসে যান তাঁরা। আমি আর মইন তাকিয়ে দেখি, পানির ঝাপটায় দূরে চলে যাচ্ছে হোসেন। আরেকটা ঢেউ সামলে তাকিয়ে দেখি হোসেন আর নেই।
এভাবেই ঘণ্টাখানেক বোটটি ধরে ভেসে থাকি আমি আর মইন। মাঝে সমুদ্র কিছুটা শান্ত হয়। আশপাশে মানুষের আহাজারি। বাঁচার জন্য আকুতি। আমরা দুজনও কাঁদছিলাম। এভাবেই কি আমাদের জীবন শেষ হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই বড় আরেকটি ঢেউ আসে। মইনের হাত বোট থেকে ছুটে যায়। মইনও দূরে চলে যায়। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে থাকে। ক্লান্ত শরীরে কিছু আর করার থাকে না।
কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে আসে। আমার মধ্যে তখন মৃত্যুভয়। দিনের আলোয় দেখি, একটু আগেই যাঁদের সঙ্গে ছিলাম তাঁরা লাশ হয়ে ভাসছেন। মইন আর হোসেনের পরিণতি ভেবে ভেতরটা গুমরে ওঠে।
পথে যেন টয়লেট না চাপে, সে জন্য বোটে ওঠার ছয় ঘণ্টা আগেই খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষুধা–তৃষ্ণায় কাতর শরীর আর পারছিল না। তবু বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাই।
আরও কয়েক ঘণ্টা এভাবে ভেসে থাকার পর লিবিয়ার কোস্টগার্ডের একটা জাহাজ আসে। তারা আমাদের উদ্ধার করে। ৩৭ জনের মধ্যে আমরা মাত্র ৭ জন বেঁচে ছিলাম। উদ্ধারের পর আরেকজন মারা যান।
সবাইকে লিবিয়ার একটা জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন দিন পর নেওয়া হয় আরেকটা জেলে। সেখানে আমরা ৬ জনসহ ৩৫০ জন বাংলাদেশি ছিলাম। সে আরেক অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন। এই জেল থেকেই ২ মার্চ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে দেশের বিমানে উঠি।
আসতে আসতে শুধু মনে হচ্ছিল গেলাম তিন বন্ধু, ফিরে যাচ্ছি একা। ভূমধ্যসাগরে চিরকালের জন্য ফেলে আসা প্রাণের দুই বন্ধুর জন্য এখনো মনটা কাঁদে। ওদের মা-বাবার দিকে তাকালে ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়।