বাঙালি ভোজনরসিক, বাঙালি সংস্কৃতিতে এই ভোজনপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়।
বাঙালির ইতিহাস নিয়ে রচিত বইগুলোতে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস আর ভোজনপ্রিয়তার যেসব চিত্র ফুটে উঠেছে; তা থেকে বাঙালির বৈচিত্র্যময় খাদ্যরুচি আর সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
সেই প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের মূল কাঠামোটি মোটামুটি ঠিক থাকলেও সময়ের ব্যবধানে নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন এবং তাদের বয়ে আনা সংস্কৃতি, জীবনচর্চা ও খাদ্যাভ্যাস অনেক কিছুই আমাদের সমাজজীবনে যুক্ত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়তই যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সব অনুষঙ্গ।
আহারে কিছু আবশ্যক পদ যেমন আছে, তেমনি সাথে আছে নানা আনুষাঙ্গিক পদ এবং ব্যঞ্জন।
আর এই আবশ্যকের তালিকায় ভাতের ওপরে কোন পদ নেই।
প্রাচীনকালে বাঙালির খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন- “ইতিহাসের উষাকাল হইতেই ধান যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে-দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত, তাহাতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
ভাত-ভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান।
উচ্চকোটির লোক হইতে আরম্ভ করিয়া নিতম কোটির লোক পর্যন্ত সকলেরই প্রধান ভোজ্যবস্তু ভাত।”
তিনি আরো লিখেছেন, “ভাত রাঁধার প্রক্রিয়ার তারতম্য তো ছিলই, কিন্তু তাহার কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নাই বলিলেই চলে।”
এখনো দেশের সব জেলায় নানা ধরণের মানুষ থাকলেও ভাতই তাদের প্রধান খাবার।
প্রাচীন সময় থেকেই এ অঞ্চলের রন্ধনশিল্পীরা ভাতের সাথে নানা পদের খাবার তৈরি করার দিকে জোর দিতেন।
ফলে সময়ের আবর্তনে বিভিন্ন অঞ্চলে হরেক রকম খাবার তৈরি হয় ভোজনবিলাসীদের জন্য।
একথা জোর দিয়ে বলাই যায় যে, বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ হলেও এখানে রয়েছে খাবারের নানান বৈচিত্র্য।
বাংলাদেশের একেকটি জেলায় রয়েছে একেক রকমের খাবারের প্রচলন।
ইতিহাসবিদের মতে দেশের সব জেলাতেই রয়েছে তাদের নিজস্ব খাবার যা ভোজনরসিকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
যেমন সিলেটের খাবারে সাতকড়া বা খুলনায় চুঁই ঝাল ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও, অন্যান্য এলাকায় সেটি নেই।
এরকম ভিন্নতা রয়েছে প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই।
চলুন যেনে নেয়া যাক বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলের জনপ্রিয় কিছু খাবার সম্পর্কে।
বরিশালের মলিদা
বরিশাল অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী ও আকর্ষণীয় পানীয় হচ্ছে মলিদা।
এটি এক ধরণের শরবত জাতীয় পানীয়।
মলিদা বানাতে চিড়া অথবা চালের গুঁড়া, মুড়ি, কোড়ানো নারকেল, আদা কুঁচি এবং গুড় বা চিনি ব্যবহার করা হয়।
রন্ধন বিশেষজ্ঞদের মতে, বরিশালের মানুষদের কাছে মলিদা ঈদ বা যেকোনো উৎসবে এক অবশ্যম্ভাবী অংশ।
চট্টগ্রামে বড় ধরণের খাবারের আয়োজনকে বলে মেজবান আর সেই আয়োজনের মাংসের রয়েছে আলাদা ধরণের রন্ধন রীতি।
তাকে বলা হয় মেজবানির মাংস, যার খ্যাতি চট্টগ্রামের বাইরে দেশ জুড়ে।
বিয়ে, জন্মদিন, মৃত্যুবর্ষিকী, আকিকা ইত্যাদি নানা বিশেষ অনুষ্ঠানে মেজবানের আয়োজন করে থাকেন চট্টগ্রামের মানুষেরা।
সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে মেজবানির মাংস রান্না করা হয়, যেখানে বিশেষ মসলা ব্যবহার করা হয়।
রন্ধন বিশেষজ্ঞ কেকা ফেরদৌসী বলছিলেন, “চট্টগ্রামের মেজবানির মাংস কিন্তু ঘরে রান্না করলে টেস্ট আসে না। মেজবানি মাংসে গরুর সব অংশেরই কিছু কিছু মাংস দিতে হয়। সব একসাথে দিয়ে বেশি মাংস না রান্না করলে কিন্তু মেজবানির মাংসের স্বাদ পাওয়া যায় না।”
তিনি বলছিলেন, চট্টগ্রামের মানুষেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও তারা ঈদের সময়টায় মেজবানির মাংস করেন। কারণ এই সময়ে অনেক গেস্ট আসে।
ফলে বেশি রান্না করলেও মজা করে সবাই সব বেলাতেই খেতে পারে। মাংসটাও শেষ হয়ে যায়।
এছাড়া কালাভুনাও গরু ও খাসির মাংস দিয়ে তৈরি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার বলে উল্লেখ করেন রন্ধন বিশেষজ্ঞ মিজ ফেরদৌসী।
কালাভুনা রান্নার আসল কৌশল হচ্ছে এর মসলা।
বিশেষ মসলা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে রাঁধতে হয়। নানা ধরনের মসলার সংমিশ্রণে সঠিক উপায়ে রান্না করেই আনতে হয় কালাভুনার কালো রং।
সাতক্ষীরা, বরিশাল অঞ্চলে নারকেলের চিংড়ি বেশ জনপ্রিয়।
ঈদের সময়ও কোনও এক বেলায় এই নারকেল চিংড়ি পরিবেশন করা হয় বলে জানাচ্ছেন কেকা ফেরদৌসী।
“বরিশালের মানুষ খুব বেশি নারকেল দিয়ে রান্না করে। ঈদের দিন বিশেষ করে কলাপাতায় চিংড়ি মাছ নারকেল দিয়ে রান্না করতে দেখেছি দুপুর বেলায়।
এছাড়া দুপুরে অনেক বাসায় দেখা যায় কলাপাতায় চিংড়ি মাছ, বাইল্যা মাছ রান্না করে অনেকে ঈদের দিন”।
দুধ দিয়ে বিশেষ কোরমাও বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে জনপ্রিয় বলে জানান রন্ধন বিশেষজ্ঞ কেকা ফেরদৌসী।
এছাড়া বরিশাল অঞ্চলে মহিষের দুধের দইও বেশ বিখ্যাত। সেটাও ঈদ উৎসবে অনেকে পরিবেশন করে থাকেন।
খুলনা অঞ্চলের মাংস রান্নায় চুই ঝাল নামের একপ্রকার গাছের ব্যবহার রয়েছে।
মাংস ধুয়ে নানারকম মসলা মাখিয়ে সেদ্ধ করতে হয়।
একপর্যায়ে সেই মাংসের সঙ্গে চুই ঝাল মিশিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ ভুনে নিতে হয়।
খুলনায় গিয়ে চুইঝাল খেয়ে ফিরবে না এমন মানুষ খুব কমই আছে।
ঈদের সময়টাতে মেহমানদের এই রান্না পরিবেশন করেন সেই অহঞ্চলের অনেক মানুষ।
সিলেটে মাংস রান্নার একটি জনপ্রিয় অনুষঙ্গ সাতকড়া।
অনেকটা লেবু জাতীয় এই ফলটি মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে রান্না করা হয়।
কেকা ফেরদৌসী বলেছেন, “মেহমানদারি করতে গেলে বেশিরভাগ বাসাতেই রান্না হয় সাতকড়া। আগে আমরা মনে করতাম সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস দিয়ে হয়।
কিন্তু মুরগির মাংস দিয়েও ওরা রান্না করে। মেহমানদারি করতে গেলেই কিন্তু সিলেটের মানুষ সাতকড়ার আইটেম রাখে। তখন মূলত সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস রান্না করে তারা”।
সাতকড়ার আচারও বেশ জনপ্রিয়।
শহুরে মানুষেরা শখ করে এখন এই আচার নিজের ও প্রিয়জনেরপাতে তুলে দেন।
চট্টগ্রাম এবং সিলেটের ব্যাপক জনপ্রিয় খাবার আখনি।
সিলেট অঞ্চলে ইফতারে জনপ্রিয় খাবার এই আখনি।
তবে অনেকে ঈদেও এই খাবার তৈরি করে বলেন জানাচ্ছেন রন্ধন বিশেষজ্ঞ।
অনেকটা বিরিয়ানির মতো হলেও আখনি মসলাবহুল খাবার। খেতে কিছুটা ঝাঁঝালোও।
আখনি তৈরিতে সাধারণত সুগন্ধি চাল ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও কালিজিরা ও চিনিগুড়া চাল দিয়েও আখনি তৈরি করা হয়।
সঙ্গে মসলা হিসেবে থাকে পিঁয়াজ, রসুন, আদা, কাঁচামরিচ, ডালচিনি, এলাচ, মটরশুঁটি ইত্যাদি।
আখনি গরু, মুরগি ও খাসির মাংস দিয়ে তৈরি হয়। যে মাংস যুক্ত করা হয়, সেই মাংসের নাম উল্লেখ করে আখনি পরিচিতি পায়।
রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার কালাই রুটি।
বিশেষভাবে তৈরি এই রুটি ভর্তা দিয়ে খেতে পছন্দ করেন ভোজনরসিকরা।
“ঈদে মিষ্টি জিনিসতো থাকেই। কিন্তু ওই অঞ্চলের অনেকে কালাই রুটি আর ভর্তা ঝাল আইটেম হিসেবে রাখে ঈদের দিন” বলেন কেকা ফেরদৌসী।
ঈদে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের এলাকার বিশেষ খাবার মেনুতে রাখার চেষ্টা করে।
কেকা ফেরদৌসী বলেন, “দুধ সেমাই জর্দা এগুলোতো সবাই করে। সেইসাথে কিন্তু যেই যেই অঞ্চলের স্পেশাল খাবার সেগুলোও কিন্তু রান্না করে।
পুরান ঢাকার কাবাবের আইটেমগুলো যেমন চাপড়ি কাবাব, টেংরি কাবাব বা সুতলি কাবাবসহ মাংসের যে আইটেম তারা কোরবানি ঈদে করে তা কিন্তু তারা রোজার ঈদেও তারা তৈরি করে অতিথিকে পরিবেশন করে”।
বিশেষ করে পুরান ঢাকায় যে বাকরখানি হয় সেই বাকরখানি সুতলি কাবাব দিয়ে ঈদ উৎসবে পরিবেশ ন করা হয় বলে জানান তিনি।
এটা বিক্রমপুরের জনপ্রিয় ও বিখ্যাত একটি পিঠা যেটা ঈদ উৎসব ও বিশেষ অনুষ্ঠানে তৈরি করা হয়।
বিবিখানা পিঠা বানানো হতো সাহেবদের জন্য কিন্তু নাম হয়েছে বিবিখানা, কারণ ঘরের বৌরা এটা বানাতো। এটা অনেকটা কেকের মতো।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে হরেক রকম পিঠা।
পিঠা জেলাভিত্তিক বিভিন্ন রকমের ও বিভিন্ন স্বাদের হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পিঠা প্রধানত মিষ্টি ও ঝাল এই দুই ধরনের হয়ে থাকে।
এমন কিছু পিঠা রয়েছে যেগুলো চিনির সিরায়, দুধে ভিজিয়ে তৈরি করা হয়।
আবার কিছু পিঠা ভাপে বা তেলে ভেজে তৈরি করা হয়।
সিলেটে যেমন কড়া ভাজির পিঠা। এর প্রধান উপকরণ বিরুন চাল হওয়ায় অনেকের কাছে এটি বিরুণ পিঠা হিসেবেও পরিচিত।
হাতে তৈরি চালের সেমাইও অনেক অঞ্চলে ঈদের প্রধান মিষ্টি আইটেম।
এটি তৈরি করে সঙ্গে সঙ্গে রান্না করে খাওয়া যায়।
তবে কেউ চাইলে রোদে শুকিয়েও রাখতে পারেন। পরে দুধ চিনি দিয়ে জ্বাল দিয়ে সেমাই তৈরি করা হয়।
কুমিল্লার রসমালাই
কুমিল্লার বিখ্যাত একটি খাবার রসমালাই।
ধারণা করা হয়, উনিশ শতক থেকে কুমিল্লা শহরে এই রসমালাই বিক্রি করা শুরু হয়।
মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডার নামের একটি দোকানে এই রসমালাই তৈরি হতো।
উত্তরবঙ্গের আলুর ঘাঁটি
উত্তরবঙ্গে এই খাবারটি জনপ্রিয় বলে জানান রন্ধনবিদ মিজ ফেরদৌসী।
আলু ভেঙে বিশেষভাবে রান্না করা হয়।
এছাড়া অনেক সময় মুরগির মাংস দিয়েও এই রান্না করা হয়ে থাকে। এটা ঈদের দিন পরোটা দিয়ে খাওয়া হয়।
বরগুনার চালের রুটি
অতিথি এলে বা বিশেষ বিশেষ উৎসবে চালের রুটি বরগুনার বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
নতুন ফসল উঠলেও চালের রুটি তৈরি করা হয়।
গরু বা মুরগির মাংসের সঙ্গে সাধারণত চালের রুটি খাওয়া হয়ে থাকে।
এছাড়া বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চালের ছিটা রুটি বেশ জনপ্রিয়, যা বিশেষ উৎসবেও পরিবেশন করেন অনেকে।
মুক্তাগাছার মণ্ডা
ময়মনসিংহের মুক্তগাছা এলাকার একপ্রকার মিষ্টি হচ্ছে মণ্ডা। দুধ ও চিনি দিয়ে মণ্ডা তৈরি করা হয়।
এ নিয়ে প্রচলিত একটি গল্প রয়েছে। প্রায় দুইশো বছর আগে মুক্তাগাছার একজন মিষ্টির কারিগর স্বপ্নে নির্দেশনা পান যে, কিভাবে মণ্ডা তৈরি করতে হবে।
সেই অনুযায়ী তিনি চুল্লি খনন করে মণ্ডা তৈরি করেন।
আর এভাবে মুক্তাগাছার মণ্ডার যাত্রা শুরু।
বিবিসি বাংলা