রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ন

ঈদে গন্তব্য পরিবর্তন বিদেশমুখী পর্যটকের

  • আপডেট সময় শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৩

ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। আর চিকিৎসা, কেনাকাটাসহ ভ্রমণের জন্য অন্যতম গন্তব্য ছিল ভারত। তবে এবারের ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বিদেশগামী পর্যটকদের গন্তব্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে।

এবার বাংলাদেশীদের প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। আর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী অবকাশযাপনে ছুটছেন শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে। গন্তব্য হিসেবে থাইল্যান্ড জনপ্রিয়তা ধরে রাখলেও আকর্ষণ কমেছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার। তবে ভারতগামী পর্যটকদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

তীব্র তাপদাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। রোদের উত্তাপ ও প্রচণ্ড গরমের কারণে ঈদুল ফিতরে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন ঘিরে কিছুটা শঙ্কা দেখা দিলেও কক্সবাজারসহ দেশের প্রধান পর্যটন এলাকাগুলোর তথ্য বলছে, এরই মধ্যে আবাসিক হোটেল-রিসোর্টগুলোর ৮০-৯০ শতাংশ বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। ঈদ ও অভ্যন্তরীণ পর্যটন ঘিরে দেশী এয়ারলাইনস সংস্থাগুলোর ব্যবসাও জমে উঠেছে।টিকিটের দাম বাড়ানোর পরও অভ্যন্তরীণ রুটে  এয়ারলাইনসগুলোর কোনো আসন ফাঁকা থাকছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা কম। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির পাশাপাশি উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্য ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। ঈদের পর পরই ৩০ এপ্রিল থেকে দেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষার চাপও রয়েছে। এসব কারণে বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যা কম বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন, ঈদের আগে বৃষ্টি হলে বা তাপমাত্রা কিছুটা কমলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন বেশ জমে উঠবে।

দেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়ছে বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যাও। ঈদসহ যেকোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের তুলনায় বিদেশে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশীরা প্রধানত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ভুটান, নেপালসহ এশিয়ার দেশগুলোয় ঘুরতে যান। গত কয়েক বছরে এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই।তবে এ মুহূর্তে দুবাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশীদের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য।

এবারের ঈদে বাংলাদেশী পর্যটকদের বিদেশ যাত্রার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে ডলারের সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন। ২০২২ সালের এপ্রিলেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকিং চানেলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকায়। যদিও খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলার বেচাকেনা হচ্ছে ১১৩ টাকারও বেশি দরে। বিদেশে ঘুরতে যাওয়া বাংলাদেশীরা সাধারণত কার্ব মার্কেট থেকেই ডলার সংগ্রহ করেন। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় প্রতি ডলারের জন্য প্রায় ২৭ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। শতাংশের হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ডলার কিনতে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি অর্থ। ডলারের এ বিনিময় হার বৃদ্ধি বাংলাদেশী পর্যটকদের বিদেশ যাত্রায় নিরুৎসাহিত করছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ উল আলম জানান, দেশের ধনীরা এবারো ঈদে বিদেশ যাচ্ছেন। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরা এবার বিদেশ যাচ্ছেন খুবই কম। এয়ারলাইনসগুলোর টিকিটের দাম অস্বাভাবিক। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ কারণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন কিংবা মাঝারি মাপের ব্যবসা করেন এমন লোকেরা বিদেশ যাওয়া কমিয়েছেন।

অন্যদিকে প্রায় দুই বছর ধরে দেশে এয়ারলাইনসের ভাড়া বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় সব গন্তব্যেই উড়োজাহাজের ভাড়া দ্বিগুণ-তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের ভাড়া ছিল ৩০-৩৫ হাজার টাকা। কয়েক মাস ধরে মালয়েশিয়া যাওয়ার ভাড়া ৮০-৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। স্বাভাবিক সময়ে থাইল্যান্ড যেতে উড়োজাহাজের ভাড়া লাগত ১৭ হাজার টাকা। সে ভাড়াই এখন ৩০-৩৫ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আকাশপথের এ ব্যাপক মাত্রায় ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি শেয়ার ট্রিপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সোহেল বিন মাজেদ বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত বিদেশগামী বাংলাদেশী পর্যটকদের সংখ্যা কম। আগামী কয়েক দিনে এ সংখ্যা বেড়েও যেতে পারে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ পর্যটকদের প্রধান সব গন্তব্যের দেশে উড়োজাহাজের ভাড়া অনেক বেশি। আবার সিঙ্গাপুরে হোটেলের ভাড়াও আগের তুলনায় অনেক বেশি পড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশীরা এবার আরব আমিরাত, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে বেশি যাচ্ছেন। ভারতেও যাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী।’

আকাশপথের পাশাপাশি স্থলবন্দর দিয়েও প্রতিবেশী ভারতে যাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী। স্বাভাবিক সময়ে যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে যাতায়াত করে চার হাজার মানুষ। বুধবার বেনাপোল বন্দর হয়ে ছয় হাজার জন ভারত গিয়েছেন

বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবীব  জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত যাওয়ার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্তই ছয় হাজারের বেশি মানুষ বন্দর দিয়ে যাতায়াত করেছেন। সন্ধ্যা নাগাদ এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। আজ এ সংখ্যা আরো বাড়বে।

দিনাজপুরের হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়েও বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের ভারত যাওয়া বেড়েছে। হিলি ইমিগ্রেশন কার্যালয় সূত্রমতে, প্রতিদিন ওই চেকপোস্ট দিয়ে ৪০০-৪৫০ পাসপোর্টধারী পারাপার হয়। গতকাল ৬৫০ জনের মতো পারাপার হয়েছেন। ওই ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আশরাফুল আলম বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দিনে ১৫০-২০০ বেশি যাত্রী হিলি ইমিগ্রেশন দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। ঈদুল ফিতরের লম্বা ছুটিতে বাংলাদেশীরা ভারত ঘুরতে যাচ্ছেন বলেই মনে করছি।’

বেনাপোল, হিলির মতো দেশের অন্য সব স্থলবন্দর দিয়েও ভারতগামী বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ পর্যটন জমে ওঠার আশা

দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের বড় অংশই কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাকে ঘিরে। এরই মধ্যে ঈদের ছুটিতে প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। পর্যটকদের বরণ করতে হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টগুলো প্রস্তুত বলে কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদে ফেডারেশনভুক্ত আবাসিক হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিশেষ ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচদিন সরকারি ছুটি রয়েছে। আমাদের হোটেলগুলোয় এরই মধ্যে অনলাইনে বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। এবার প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ হাজার পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসবেন। আশা করছি, এবারের ঈদে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যবসা হবে।’

পাঁচ তারকা মানের সি-পার্ল রিসোর্টের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার নাভিদ আহসান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের হোটেলের ৮০ শতাংশ রুম আগাম বুকিং হয়ে গেছে। ঈদের আগেই শতভাগ বুকিং সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে মনে করছি। পর্যটকদের জন্য আমরা বিশেষ ছাড়ও দিচ্ছি।

আরক তারকা মানের হোটেল কক্স-টুডের এজিএম আবু তালেব জানান, ঈদের ছুটির পাঁচদিনে তাদের হোটেলেরও সব রুম বুকিং হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা, ঈদের পরে ১০ দিন পর্যন্ত কক্স-টুডেতে পর্যটক ভরপুর থাকবে।

কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, ‘রমজানে পর্যটক কম আসে কক্সবাজারে। আবার সারা দেশে রেকর্ড পরিমাণ গরমও পড়ছে। তাপদাহ অব্যাহত থাকলে পর্যটন খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আশা করি, হালকা বৃষ্টির সঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তন হলে ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকদের ঢল নামবে।’

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট বিভাগের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণ করতে আমরা প্রস্তুত। এরই মধ্যে সমুদ্র সৈকতসহ গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় ট্যুরিস্ট পুলিশের তত্পরতা শুরু হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে সৈকতের প্রবেশপথে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হবে। সৈকতে পোশাকধারীর পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবে। সৈকতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য দল গঠন করা হয়েছে।’

কক্সবাজার ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির পর্যটন স্পটগুলোর হোটেল-রিসোর্টের আগাম বুকিং বেশ ভালো বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম পর্যটন এলাকাগুলোর একটি সিলেট। সারা বছরই সিলেট বিভাগের জেলাগুলোয় পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে ঈদসহ যেকোনো উৎসবের সময়ে সিলেট অঞ্চলের হোটেল-রিসোর্টগুলো পর্যটকে পূর্ণ হয়ে যায়। এবারের ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে সিলেট অঞ্চল পর্যটকদের পদভারে মুখর হবে বলে মনে করছেন হবিগঞ্জের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুর রহমান।

পাঁচ তারকা মানের রিসোর্টটির এ কর্ণধার বলেন, ‘এবারের ঈদের ছুটি বেশ লম্বা। আগামী ৬ মে পর্যন্ত দেশের মানুষ ছুটির আমেজে থাকবে। প্যালেসসহ সিলেট অঞ্চলের হোটেল-রিসোর্টগুলোর বুকিং পরিস্থিতি খুবই ভালো। পর্যটকদের জন্য স্বস্তির সংবাদ হলো সিলেটে এরই মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা কমে আসছে। প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টে আমরা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি, পর্যটকরা এবারের ঈদ ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com